শাফকাত শুভ্র:
সময়টা বড্ড খারাপ। অফিস থেকে ঈদের ছুটি মিলেছে। কতদিন গ্রাম দেখি না। গ্রামের সবুজ মাঠ, মেঠোপথ, রসিক মানুষ, সহজ-সরল কত পবিত্র মুখ আর মায়ের আদর। সবই যেন ভুলতে বসা। কিন্তু ভুলে থাকা বেশিক্ষণ জমিয়ে রাখা কারো জন্যই উচিত নয়। সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বাড়ীর পথে রওনা। ঈদের আগের দিন বাসে চড়া। সামাজিক দূরুত্ব নিয়ে টেলিভিশনের বড় বড় বুলি সবই যেন হাওয়াই মিঠাই খোদ টার্মিনালেই। যাহোক, বাসের আগের ভাড়া এখন দ্বিগুণ, কিন্তু আসনে আসনে লোক ভর্তি। সবার তাড়া, বাসের সংকট, প্রতিবাদী হলে বাসওয়ালা সোজা নামিয়ে দেবে। হাল্কা প্রতিবাদ করায় পাশের সিট খালি রাখতে বাধ্য হলো বাসওলা। বুঝলাম! প্রতিবাদী হলে সফলতা আসবেই। অতঃপর ছুটে চলা, গন্তব্যে, আপন ঠিকানায়। যেখানে বিশুদ্ধতায় ঘেরা চারপাশ। বিকালের ¯িœগ্ধতায় পঞ্চিম আকাশে যখন সোনালী আভা। পৌঁছলাম, পালগিরী বাস স্টেশন।
সেকি! স্টেশনে মানুষের জটলা কেন? মারামারি হলো নাকি? একটু সামনে এগুতেই দেখি কিছু চেনা মানুষের মুখ! অভাব-অনটন আর সীমাবদ্ধতায় যাদের জীবন, ঘন্টায় বন্দি। তাদের মুখে হাসি, কারো হাতে, কারোর কাঁধে বড় বড় প্যাকেট। পরিচিতজনদের কাছ থেকে জানা, গ্রামের বাসিন্দাদের অনলাইন প্লাটর্ফম, পালগিরী! আমার গ্রাম, আমার প্রাণ এর পক্ষ থেকে দরিদ্র মানুষের মাঝে উপহার সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবকদের গায়ে পালগিরী! আমার গ্রাম, আমার প্রাণ সম্বলিত টি-শার্ট যেন তার প্রামাণিক দলিল। এমন উদ্যোগ, সাধারণত শহুরে অঞ্চলে দেখা যায়, পিছিয়ে থাকা একটা গহীন গ্রামে তারুণ্যের এমন উদ্যোগ সত্যি বুকটা ভরিয়ে দিলো। মনে মনে তাদের স্যালুট দিলাম।
ঈদের বিকেলে গ্রামের বন্ধুদের কাছ থেকে গ্রুপটি সর্ম্পকে আরও বিস্তারিত জানলাম। সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারী গ্রামের সব বয়সী মানুষের বড় অংশ তাতে সম্পৃক্ত। একটু খারাপ লাগলো, দূরে বলে এখনো যুক্ত না হওয়ার বেদনায়। বন্ধুরা আমন্ত্রণ জানালো, পালগিরী! আমার গ্রাম, আমার প্রাণের আগামীকালের অনুষ্ঠানের যোগদানের জন্যে। সেখানে রচনা প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ করা হবে। যথারীতি ঠিক সময়ে অনুষ্ঠানস্থলে হাজির। এক ঝাঁক তারুণ্য আর প্রবীণদের মিলনমেলা। উপস্থাপক আরেফিন শাকিল একে একে বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করছেন। মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের ‘ক’ গ্রুপের জন্য রচনা ছিলো ‘আমার গ্রাম’ আর উচ্চ মাধ্যমিক থেকে বড়দের ‘খ’ গ্রুপের জন্য ‘করোনার প্রকোপ: সমস্যা আর সম্ভাবনা’ শীর্ষক রচনার আয়োজন। মজার বিষয়। মহা-দূযোর্গ করোনা থেকে সম্ভাবনা দেখার স্পর্ধা! শব্দটা এজন্য, তামাম দুনিয়ার কাছে করোনা এখনো বড় অভিশাপ। কিছু রচনা পড়তে চাইলাম গ্রুপের এডমিন আরেফিন শাকিল আর আকতার হোসেন রানার কাছে। পড়লাম, কী দারুণ লেখা! ভুল ভাঙ্গলো, অবহেলিত আর পিছিয়ে থাকা শব্দে ওরা বন্দি নয়, ওরা অজুহাত খোঁজে না, উদাহরণ তৈরি করে। আধুনিক সুযোগ-সুবিধা না থাকলেও হিমালয়সম ইচ্ছা আর অনন্য মেধায় তারা এগিয়েছে। তীব্র লড়াই করে দুই গ্রুপের ছয়জন পুরস্কার পেয়েছে। গ্রুপের মডারেটর আবু হানিফ সবুজ জানালো, আগামীদিনে তারা বৃত্তি, বৃক্ষরোপন, শিক্ষামূলক প্রতিযোগিতাসহ গ্রামের উন্নয়নে কয়েক ধরণের পদক্ষেপ নিয়েছে। অভিভাবকের ছায়া তাদের সমর্থন দিচ্ছে গ্রামের প্রবাসী আর বিত্তশালী চাকুরীজীবিরা। রানা আর শাকিল বললো, এক ঝাঁক অদম্য স্বেচ্ছাসেবক কঠিন সব কাজ সহজ করে দিচ্ছে। সাব্বির হোসেন রিয়াদ, ইমাম হোসেন, ফারুক, মনির, পারভেজ, মোহন, সাইফুল, মাহবুবসহ এমন অন্তত কয়েকজন সম্মুখ যোদ্ধা গ্রামের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। পরিচিত হলাম, টুপি খোলা অভিনন্দন জানালাম তাদের। রিয়াদ জানালো, ‘আমাদের কাজের বড় শক্তি, গ্রামের বড় ভাইরা। মুকুল ভাই, বাবু ভাই, কবির ভাই, ইকবাল ভাই, জামসেদ ভাইসহ বড়দের সমর্থন আর সহযোগিতা ছাড়া এমন কাজ অসম্ভব’। ধন্যবাদ তাদেরও। তিনদিন গ্রুপটির আরও কাজ দেখলাম। সত্যি তো, তরুণরা এগিয়ে না এলে সমাজ বদলাবে কেমন করে? প্রজন্ম এগিয়ে যাবে কোন ধারায়? ফেইসবুকে এখন লক্ষাধিক গ্রুপ। প্রতিনিয়ত ইনভাইট আর ইনভাইট। তবে, তারমধ্যে পালগিরী! আমার গ্রাম, আমার প্রাণের মত গ্রুপ যত হবে, ততোই মঙ্গল দেশের, জাতির। তাতে বদলাবে সমাজ, পিছিয়ে থাকবে না কোন মানুষ। শুভ কামনা তারুণ্য, এগিয়ে যাক সমাজ, এবার ভিন্নরকম গ্রাম দেখানোয় ধন্যবাদ, পালগিরী! আমার গ্রাম, আমার প্রাণ। লেখক : বেসরকারী চাকুরীজীবি, ঢাকা।