মাওলানা এসএম আনওয়ারুল করীম:
মাহে রমজান একদিকে যেমন মহিমান্বিত কোরআন নাজিলের মাস, অন্যদিকে এটি ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ ও মক্কা বিজয়েরও মাস। ১৭ রমজান সংঘটিত হয়েছিল ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ। আর ২০ রমজান মক্কা বিজয়ের মধ্য দিয়ে ইসলাম লাভ করে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। এই রমজান মাসেই ইসলামের সুমহান আদর্শবাণী বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। তৎকালীন পরাশক্তির মাঝে ইসলাম হয়ে ওঠে এক নয়া শক্তি। বদর প্রান্তে মুসলমানদের বিজয় ও মক্কা বিজয় মূলত মানবতার মহাবিজয়। ইতিহাসের নয়া উত্থান।
সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নির্দেশক গ্রন্থ কোরআনুল কারিম নাজিলের মাস রমজানুল মোবারক। এ মাসের ১৭ তারিখ অসাধারণ তাৎপর্যের অধিকারী। কারণ এদিন ঐতিহাসিক বদর দিবস। ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দ তথা দ্বিতীয় হিজরির ১৭ রমজান বদর প্রান্তরে সংঘটিত হয় ঐতিহাসিক যুদ্ধ। প্রতিপক্ষ ছিল মক্কার মুশরিক বনাম মদিনার মুসলিম। মদিনা থেকে প্রায় ৭০ মাইল দূরে বদর প্রান্তরে সংঘটিত হয়েছিল আল্লাহর একত্ব ও তার পাঠানো রাসুলের প্রতি অবিশ্বাসী বিশাল সুসজ্জিত বাহিনীর বিরুদ্ধে বিশ্বাসী একটি ক্ষুদ্র দলের প্রত্যক্ষ সশস্ত্র লড়াই। তাতে মানুষের সব ধারণা নাকচ করে দিয়ে প্রায় উপকরণহীন মুষ্টিমেয় দলটিকে জয়ী করেন মহান রাব্বুল আলামিন। সত্য-মিথ্যার চিরন্তন দ্বন্দ্বের ইতিহাসে সংযোজিত হয় নতুন অধ্যায়। তাই শুধু ইসলামের ইতিহাসে নয়, বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে বদর দিবস অনন্য অবস্থান দখল করে রেখেছে।
একইভাবে এ মাহে রমজানের ২০তম দিবসে মুসলমানদের পদচুম্বন করে মহাবিজয়। মক্কা বিজয়। ৮ম হিজরির ২০ রমজান। পৃথিবী দেখে এক বিস্ময়কর ঘটনা। ইসলাম পায় রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। বিশ্বনবি সা. মাত্র দশ হাজার সাহাবিসহ জন্মভূমিকে শত্রুর কবল থেকে মুক্তির আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ফলে বিজয় তাঁদের পদচুম্বন করে। ইতিহাসে এ ঘটনা মক্কা বিজয় নামে খ্যাত। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা হুদায়বিয়ার সন্ধিকে প্রকাশ্য বিজয় ঘোষণা দিয়েছিলেন। আল্লাহর সেই প্রকাশ্য বিজয় ৮ম হিজরির ২০ রমজান বাস্তবতার আলো দেখে। মক্কার মুক্ত বাতাসে প্রশান্তির সুঘ্রাণ লাভ করেন বিশ্বনবি। কৃতজ্ঞতায় সেজদায় লুটিয়ে পড়েন প্রিয় কাবা চত্বরে। ২০ রমজান শুধু মক্কা বিজয়ই হয়নি; বরং প্রিয়নবি সা. স্বমহিমায় নিজ জন্মভূমিতে ফিরে এসেছিলেন। বিশ্বনবি সা. ১০ হাজার সাহাবি নিয়ে ১০ রমজান মদিনা থেকে মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। ১০ হাজার সাহাবির বিশাল মুসলিম বাহিনী বিশ্বনবি সা.-এর সফল নেতৃত্বে বিনা রক্তপাতে ঐতিহাসিক মক্কা বিজয় করে। এ বিজয়ের ফলে ইসলামের ইতিহাসে ২০ রমজান ঐতিহাসিক অমরত্ব লাভ করে।
কোরাইশ কাফেরদের সাথে আল্লাহর নবি ও তার সাথিদের কয়েকটি ছোটখাট সংঘর্ষের পর প্রথম সরাসরি সশস্ত্র মোকাবেলা হয় মদিনা থেকে বেশ দূরে বদর প্রান্তরে। এ যুদ্ধে দু’পক্ষে কোনো দিক দিয়েই সমতা ছিল না। আল্লাহর নবির সাথে মাত্র ৩১৩ জন মুজাহিদ। তারা প্রায় নিরস্ত্র। অপরপক্ষে আবু জাহলের নেতৃত্বে ছিল এক হাজার প্রশিক্ষিত সৈন্যের সুসজ্জিত বাহিনী। কিন্তু প্রায় নিরস্ত্র মুষ্টিমেয় মুজাহিদের কাছে পরাজিত হয় সুসজ্জিত বিশাল বাহিনী। কোরাইশদের দর্প চূর্ণ হয়ে যায়। তাদের পক্ষে নিহত হয় ৭০ জন। বন্দি হয় আরও ৭০ জন। আর মুসলমানদের মধ্যে শহিদ হন মাত্র ১৪ জন। যুদ্ধের এ ধরনের ফলাফল ছিল সম্পূর্ণ অভাবনীয়। মূলত তা ছিল আল্লাহর কুদরতের নমুনা। তিনি স্বল্পসংখ্যক মানুষকে বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে জয়ী করে দেখিয়ে দিলেন অবিশ্বাসী লোকদের প্রকৃত দুর্বলতা ও অসহায়তা। তাই বদরের ইতিহাস তাবৎ দুনিয়াবাসীর জন্য এক ঐতিহাসিক ম্যাসেজ। বিশ্বসভ্যতার মোড় ঘুরে যায় এ থেকে। বদরের প্রান্তর থেকে ইসলামের বিজয়ধারা সূচিত হয়। তাই প্রতি বছর ১৭ রমজান মুসলিম উম্মাহকে স্মরণ করিয়ে দেয় গৌরবময় বিজয়ের ইতিহাস, নতুনভাবে প্রত্যয় জাগায় খোদায়ী কুদরতের অসীমতার সামনে নিজের সব কামনা বিলীন করে দেওয়ার।
এদিকে অষ্টম হিজরিতে বিশ্বমানবতার কেন্দ্রভূমি মক্কাকে পঙ্কিলতামুক্ত করার জন্য বিশ্বনবি সা. নীরব আয়োজন করলেন। তিনি ধ্বংযজ্ঞ চান না, তিনি কোরাইশদের রক্ষা করতে চান। তিনি চান প্রেম ও ভালোবাসা দিয়ে জয় করতে। তাই ১০ রমজান ১০ হাজার সাহাবিসহ মদিনা থেকে মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। মক্কার উপকণ্ঠে এসে ‘মারাউজ জাহরান’ নামক গিরি উপত্যকায় তাঁবু স্থাপন করেন।
২০ রমজান মহানবি সা. ক্রীতদাস উসামা ইবনে জায়েদের সঙ্গে উটে চড়ে অবনত মস্তকে সবার শেষে মক্কায় প্রবেশ করলেন। হজরত সা. মক্কাবাসীকে নিয়ে একটি সভা করলেন। তিনি ভাষণে সাম্য, মৈত্রী ও একতার কথা বললেন : ‘হে কোরাইশগণ! অতীতের সকল ভ্রান্ত ধারণা মন থেকে মুছে ফেলো। কৌলীন্যের গর্ব ভুলে যাও, সকলে এক হও। সকল মানুষ সমান, এ কথা বিশ্বাস করো। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “হে মানুষ! আমি তোমাদের সকলকেই এক নারী ও পুরুষ হতে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে গোত্রে ও শাখায় পৃথক করেছি, যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পারো। নিশ্চয় তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই বেশি সম্মানিত, যে বেশি পরহেজগার।’ (সুরা হুজুরাত, আয়াত ১৩)
মক্কার কাফেররা নিজেকে খুব ক্ষমতাবান মনে করত। আত্মঅহমিকা ও অহংকারের কারণে কেউ তাদের সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারত না। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে তারা মক্কায় মুসলমানদের ওপর বর্ণনাতীত নির্যাতন করেছিল। যুদ্ধের দিনও মুসলমানদের তুলনায় তাদের সেনা সংখ্যা ও যুদ্ধ সুরঞ্জাম অনেক বেশি ছিল। এ নিয়ে তারা অহংকারও করেছিল। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাদের অহংকার ও ক্ষমতার দাপট মাটিতে মিশিয়ে দিলেন। বদর যুদ্ধে আবু জাহল, উতবা, শায়বা ও উমাইয়ার মতো কুরাইশদের বড় বড় সর্দার নিহত হয়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, কাফের সম্রাট আবু জাহল করুণভাবে নিহত হয় শিশু সাহাবি মায়াজ ও মুয়াওয়াজের হাতে।
এদিকে মক্কা বিজয় হয় বলতে গেলে বিনা রক্তপাতে। মহানবি সা. বিনা রক্তপাতেই বিজয়ীরূপে মক্কায় প্রবেশ করলেন এবং এমন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন, যুগযুগান্তরে সবার মুখে আজও যা আলোচিত হয়ে আসছে। যেই কোরাইশরা মুসলমানদের ক্ষতি সাধনে সামর্থ্যরে শেষ সময় পর্যন্ত অপচেষ্টা চালিয়েছিল, তাদেরকে তিনি ‘সাধারণ ক্ষমা’ ঘোষণা করেন। তাও কখন! যখন তিনি মক্কার অধিপতি, ইচ্ছে হলে নিয়মানুযায়ী সবাইকে মৃত্যুদণ্ডও দিতে পারতেন।
ইসলামের শ্রেষ্ঠ বিজয় ও মানবতার চূড়ান্ত বিজয় সংঘটিত হয় ২০ রমজান। প্রমাণিত হয় মানবতার জন্য ইসলাম; সত্য, সুন্দর, ন্যায় ও কল্যাণের জন্য ইসলাম; ইসলাম শান্তি, সম্প্রীতি, মৈত্রী, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য। মূলত প্রিয়নবি সা. মক্কা জয়ের আগেই মক্কাবাসীর মন জয় করে বড় বিজয় অর্জন করেছিলেন। মক্কা বিজয় ছিল মানবতারই জয়।
বদর যুদ্ধ থেকে আমরা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি। এক. পরামর্শ করে কাজ করা। কারণ নবিজি সাহাবিদের সাথে পরামর্শ স্বাপেক্ষেই বদর প্রান্তে উপনীত হয়েছেন। দুই. উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা। তিন. আল্লাহর কাছে দোয়া করা। মহানবি সা. আল্লাহর দরবারে লুটিয়ে পড়ে মুসলমানদের বিজয়ের প্রার্থনা করেছিলেন। চার. সাহায্য এসে থাকে একমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকে। পাঁচ. মুনাফিকদের ষড়যন্ত্র অবশ্যই সময়ের ব্যবধানে অপসৃত হয়ে পড়ে। বদর দিবস ও মক্কা বিজয় দিবস মুসলিম জীবনে বীরের ন্যায় বেঁচে থাকার প্রেরণা যোগায়। বদর ও মক্কা বিজয়ের মধ্য দিয়ে সত্য-মিথ্যার চিরন্তন দ্বন্দ্বের ইতিহাসে সংযোজিত হয় নতুন অধ্যায়। তাই শুধু ইসলামের ইতিহাসে নয়, বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে বদর ও মক্কা বিজয় দিবস অনন্য অবস্থান দখল করে আছে।
লেখক : মুহাদ্দিস, গবেষক ও প্রাবন্ধিক; বিভাগীয় প্রধান (হাদিস), আল ফাতাহ পাবলিকেশন্স