নজরুল ইসলাম আতিক:
দুই হাত না থাকলেও জীবন যুদ্ধে হার না মানা এক অদম্য সৈনিক চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার প্রতিবন্ধী দেলোয়ার হোসেন। ১৯ বছর আগে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে গিয়ে একটি দুর্ঘটনায় কেটে ফেলতে হয় দুটি হাত। তবে দুটি হাত না থাকলেও চায়ের দোকান দিয়ে সাবলীলভাবে ব্যবসা করেছেন তিনি। ভিক্ষাবৃত্তি না করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে নিজের প্রবল ইচ্ছা শক্তিকে কাজে লাগিয়েই নেমে পড়েন জীবন সংগ্রামে।
নিজের শারীরিক দুর্বলতাকেই বানিয়েছেন চলার পথের হাতিয়ার। প্রথম প্রথম সমস্যা হলেও এখন ব্যবসার সকল কাজ একাই পরিচালনা করতে পারেন তিনি। হাত ছাড়াই ক্রেতাদের জন্য বানাচ্ছেন চা আর পান। বিক্রি করছেন বিস্কুট সহ দোকানের নানান পণ্য সামগ্রী। শুধু তাই নয় পাশাপাশি করছেন মোবাইলে রিচার্জ। দুটি হাত না থাকলেও এসব কাজে এখন আর কোন প্রতিবন্ধকতাই কাজে আসছে না তার।
চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার রূপসা উত্তর ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ড উত্তর গাবদের গাঁও গ্রামের সফিউল্লাহ খান হাজীর ছেলে মো. দেলোয়ার হোসেন (৩৯)। ৬ ভাই ২ বোনের মধ্যে ৪র্থ সে।
আলাপকালে দেলোয়ার খান জানান, ২০০৩ সালে পাড়ালেখা বন্ধ করে ঢাকার কালিগঞ্জ ইকোরিয়া হাসনাবাদ এলাকায় নির্মাণ শ্রমিকের কাজে যোগ দেন। কাজের এক পর্যায়ে বৈদ্যুতিক তারে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন তিনি। লোমহর্ষক ওই দুর্ঘটনায় ডাক্তারের পরামর্শে কেটে ফেলতে হয় তার হাতের কনুই পর্যন্ত। পরে দীর্ঘ প্রায় পাঁচ থেকে ছয় বছর চিকিৎসা নিতে তার। পরিবারের খরচ হয় প্রায় ৬ লাখ টাকা। তিনি বলেন, ভিক্ষাবৃত্তি করতে আমার লজ্জা লাগে। তাই কখনো ভিক্ষার কথা চিন্তাও করেননি। তাই কিছু একটা করার জন্য ইচ্ছা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে শুরু করেছি চায়ের দোকান। এতে ভালোই কাটছিলো আমার দিন। তবে এখন একটু সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি।
তিনি জানান, চায়ের দোকানের আয় দিয়ে সংসার চালানো পাশাপাশি নিজের দুই ছেলে ও এক মেয়েকে পড়ালেখা করাচ্ছেন দেলোয়ার। তবে অভাগা এই মানুষটির সামান্য সুখেও আঘাত করছে চোরের দল। গত কয়েক বছরে নিজ বসত ঘরে দুইবার ও দোকানে দুইবার চুরির ঘটনায় পুঁজি হারা এখন এই যুদ্ধা। তার উপর পড়েছে বৈশ্বিক করোনার প্রভাব। বর্তমানে সেই চায়ের দোকানের আয় দিয়েই খুব কষ্টে দিনানিপাত করছেন তিনি। হয়েছেন প্রায় আড়াই লাখ টাকা দেনা।
অসহায় দেলোয়ার কষ্ট নিয়ে জানান, জীবনে কখনো কারো সহযোগিতার প্রত্যাশা না করলেও সংসার বড় হওয়ায় এখন তিনি একটু সহযোগিতা প্রত্যাশী। সেটা সরকারি অথবা বেসরকারি যেভাবেই হোক না কেন। যদি কেউ আমাকে দীর্ঘমেয়াদি কিস্তি দিতো তাহলে আরেকটু ভালোভাবে সংসার চালাতে পারতাম।
দেলোয়ারের বাবা শফিউল্লাহ খান জানান, ১৯ বছর আগে ছেলের দুর্ঘটনার খবরে চিন্তাও করতে পারেননি জীবিত ছেলেকে আর দেখতে পাবেন শফিউল্লাহ খান। মানুষের কাছে কখনো হাত না পেতে নিজে কর্ম করে জীবন পরিচালনা করায় খুশি এই পিতা। তবে তিনি বলেন, এক সময় মনে হয়েছিলো আমার ছেলের জীবন শেষ। সে জীবনে কীভাবে কী করবে তা ভেবে আমি নিজেই দুশ্চিন্তায় থাকতাম। তবে ছেলে কাজ করে সংসার চালাতে দেখে আমার নিজের এখন অনেক গর্ব হয়।
স্থানীয় বাসিন্দা আমিন পাটওয়ারী সহ বেশ কয়েকজন জানান, প্রতিবন্ধী দেলোয়ার যে পরিমাণ পরিশ্রম করে তা এলাকার অনেক সুস্থ সবল মানুষও করে না। তার দোকানের চা এলাকার অনেকের প্রিয়। তাছাড়া সে প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, সদালাপি এবং সদা হাস্যজ্জল একজন মানুষ হওয়ায় এলাকাবাসীর কাছে তার ব্যাপক সুনাম রয়েছে। তারা আরো জানান, দেলোয়ারের কাজ দেখে অনেকেই অবাক হন।
সুজন (সুশাসনের জন্য নাগরিক)-এর চাঁদপুর জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক রহিম বাদশা জানান, একজন প্রতিবন্ধী দেলোয়ার হতে পারেন সমাজের অসংখ্য প্রতিবন্ধীদের বেঁচে থাকা ও জীবনে তার মত সংগ্রামী হওয়ার অনুপ্রেরণা। একজন মানুষ তার ইচ্ছে শক্তিকে কাজে লাগিয়ে জীবনে কী করতে পারে তার উজ্জ¦ল দৃষ্টান্ত হলো প্রতিবন্ধী দেলোয়ার। তাই সমাজের এমন যোদ্ধাদের পাশে বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহŸান জানান তিনি।
চাঁদপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি মো. গিয়াসউদ্দিন মিলন বলেন, যেখানে এখনকার সমাজে অনেকে স্বাভাবিক হয়েও কাজ না করে দিব্বি ঘরে বসে থাকে। সেখানে আমাদের দেলোয়ার তার জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। তাই আমাদের সমাজে যারা বিত্তবান আছে তাদের উচিৎ দেলোয়ারের মতো এমন প্রতিবন্ধী মানুষের পাশে দাঁড়ানো। হয়তো একজন দেলোয়ারকে দেখে সমাজের অন্য প্রতিবন্ধীরাও জীবনে নিজ পায়ে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা পাবেন।
একজন দেলোয়ার হতে পারেন সমাজের হাজারো প্রতিবন্ধী নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন। তাই সমাজের কোন বিত্তবান যদি অসহায় প্রতিবন্ধী দেলোয়ার খানকে সহযোগিতা করতে চান তাহলে তার ব্যক্তিগত মোবাইল ০১৭১৫৪৪১৬৮৫ নাম্বারে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারেন।