রিয়াজ শাওন:
ঘড়ির কাঁটায় সকাল ১১টা ৫৯ মিনিট। ঠিক তখন চাঁদপুর জেলা গণগ্রন্থাগারে দ্বিতীয় তলায় ভীষণ মনযোগ দিয়ে বই পড়ায় মগ্ন মাত্র ৬জন পাঠক। তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়। তারা অর্নাস মার্স্টার শেষ করে চাকরির পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাই সময় পেলে গ্রন্থাগারে এসে বই পড়েন।
যখন ঘড়ির কাঁটায় ১২টা ১৪ বাজে ঠিক তখন লাঠিতে ভর দিয়ে একটি বইয়ের ব্যাগ হাতে নিয়ে দ্বিতীয় তলায় সাধারণ পাঠকের হল রুমে প্রবেশ করেছে সত্তরোর্ধ্ব বয়সের একজন পাঠক। আলাপকালে তিনি জানান, মাঝে মাঝে এখানে আসেন তিনি পত্রিকা পড়তে। দুপুর দেড়টা পর্যন্ত চাঁদপুর জেলা গণগ্রন্থাগারের রেজিস্ট্রার খাতায় পাঠকের সংখ্যা মাত্র ৮জন। গত সোমবার (২২ নভেম্বর) সরজমিনে চাঁদপুর জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগারের এমন চিত্র দেখা গিয়েছে।
চাঁদপুর শহরের ষোলঘর বিটি রোড়ে অবস্থিত এই গণগ্রন্থাগার। ৫ হাজার বর্গফুট আয়তনের ৩তলা ভবন বিশিষ্ট আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্পূর্ণ এই গণগ্রন্থাগারটি। এখানে দেশী-বিদেশী বই আছে ৩০ হাজারেরও বেশি। পাশাপাশি পাঠকদের জন্য সকল সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থাও বয়েছে। তবে নেই শুধু পর্যাপ্ত পাঠক।
গণগ্রন্থাগারের রেজিস্ট্রার খাতার তথ্য অনুযায়ী, গত ২১ নভেম্বর পাঠক সংখ্যা ছিলো ২৮জন, ২০ নভেম্বর ৩০জন, ১৭ নভেম্বর ২২জন, ১৬ নভেম্বর ১০জন, ১৫ নভেম্বর ২৮জন। এছাড়াও বাসায় নিয়ে বই পড়ার নিবন্ধিত পাঠকের সংখ্যা মাত্র ৩৭জন। যার মধ্যে পুরুষ ২৮জন ও নারী ৯জন।
৩০ হাজার বই সম্বৃদ্ধ জেলার একমাত্র সরকারি এই গণগ্রন্থাগারটিতে পাঠকের উপড়ে পড়া ভীড় থাকার কথা ছিলো। শিক্ষক-শিক্ষার্থী, নবীন-প্রবীণ, লেখক-পাঠকের উপস্থিতি থাকার কথা ছিলো চোখে পড়ার মত। সকল শ্রেণির পাঠকের উপস্থিতিতে একটি আনন্দেরময় পরিবেশ বিরাজমান থাকা কথা ছিলো। কিন্তু এখানে দেখা গেলো তার চিত্র। খালি পরে আছে পাঠকের জন্য তৈরি চেয়ারগুলো।
কিন্তু কেন? এত বই এত সুযোগ সুবিধা এবং উন্নত পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও পাঠক কেন গ্রন্থাগার বিমুখ? কি কারণে পাঠকের আগ্রহ নেই, এই গণগ্রন্থাগারে প্রতি? এই সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজতে দৈনিক শপথ কথা বলেছে। বেশ কয়েকজন পাঠকের সাথে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন পাঠক জানান, আসলে এই জায়াগাটা গণগ্রন্থাগারের জন্য একেবারে অনুপযুক্ত। এখানে আসতে আমাদের অনেক সমস্যা হয়। কারণ জায়গাটি শহরের একেবারে উল্টো দিকে। পাঠাগার স্থাপন করতে হয় স্কুল কলেজকে কেন্দ্র করে। কিন্তু কেন এটা এখানে করা হলো তা আমরা বুঝতে পারছি না।
পাঠক এখানে আসতে কি ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হন? এমন প্রশ্নের উত্তরে কয়েকজন জানান, শহরের কেন্দ্র থেকে একটু দূরে। আর যাতায়াতের সমস্যার জন্যই পাঠক এখানে পড়ার প্রতি আগ্রহী না।
২০১৯ সালে ৩১ জুন থেকে জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগারটি তাদের নতুন ভবনে কার্যক্রম শুরু করে। আর গণগ্রন্থাগারে জন্য স্থান নির্বাচন নিয়ে তৎকালীন সময় ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়। কারণ যে স্থানে ভবনটি স্থাপন করা হয়েছে। সেটি ছিলো শহরের কেন্দ্র থেকে একটু দূরে। এই স্থান গণগ্রন্থাগারে জন্য একেবারে অনুপযুক্ত। বই পিপাসুদের সুবিধার্থে জেলায় সরকারি গণগ্রন্থাগার স্থাপন করা হয়। কিন্তু সেটা শহরে কেন্দ্র থেকে দূরে হওয়ায় পাঠক শূন্য হয়ে পড়ছে দিন দিন।
গণগ্রন্থাগারে পাঠকের উপস্থিতি এত কম থাকে কেন? এই বিষয়ে জানতে চাইলে, লাইব্রেরিয়ান রাফিয়া সুলতানা বলেন, আসলে আমাদেরও বিষয়টি মেনে নিতে কষ্ট হয়। মানুষ আসে না কেন? তবে যাই হোক যতটুকু মনে হয় এটা একেবারে শহরে থেকে দূরে হওয়ায় মানুষের সংখ্যা কম হয়।
সরজমিনে চাঁদপুর জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগারে গিয়ে দেখা যায়। তাদের সেবা তালিকায় থাকা নয়টি জাতীয় পত্রিকা রাখার কথা থাকলেও, দৈনিক নয়া দিগন্ত, দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক ইনকিলাব, ডেইলি স্টার পত্রিকাটি পাওয়া যায়নি। এছাড়াও স্থানীয় মাত্র দুইটি পত্রিকা পাওয়া গেছে। কেন জাতীয় এই পত্রিকাগুলো নাই? এবং স্থানীয় পত্রিকাগুলো কেন রাখা হচ্ছে না। এই বিষয়ে লাইব্রেরিয়ান রাফিয়া সুলতানা বলেন, আপাতত আমরা ইনকিলাব পত্রিকাটি রাখছি না। আর বাজেটের স্বল্পতার জন্য বাকী স্থানীয় পত্রিকাগুলো রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তবে কেউ যদি সৌজন্য কপি দেয় আমরা রাখবো। এরপরই তার নির্দেশে একটি প্রথম আলো পত্রিকায় হল রুমে এনে রাখা হয়।
মূলত পাঠককে গণগ্রন্থাগার মুখী করার নানা উদ্যোগ নেওয়ার কথা থাকলেও। দৃশ্যমান কোন উদ্যোগ চোখে পড়েনি। এই বিষয়ে গণগ্রন্থাগারে লাইব্রেরিয়ান রাফিয়া সুলতানা বলেন, আমরা বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তারই অংশ হিসেবে ইতিমধ্যে চাঁদপুর সরকারি কলেজ এবং চাঁদপুর মহিলা কলেজের শিক্ষকদের সাথে কথা বলেছি। তারা বলেছেন, তারা শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানাবেন।
গণগ্রন্থাগারে পাঠক সংখ্যা বৃদ্ধি জন্য কি ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়? এমন প্রশ্নের জবাবে রাফিয়া সুলতানা বলেন, আমরা বিভিন্ন দিবসে রচনা প্রতিযোগিতা, কুইজ প্রতিযোগিতাসহ নানামুখী কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকি।
এত সুযোগ সুবিধা থাকা সত্ত্বেও পাঠক গ্রন্থাগারমুখী হচ্ছে না কেন? এই বিষয়ে জানতে চাইলে গল্পকার ও প্রবান্ধিক মুহাম্মদ ফরিদ হাসান বলেন, চাঁদপুরের গণগ্রন্থাগারটি বর্তমানে যে স্থানে নেয়া হয়েছে, সেটি শহরের কেন্দ্রে নয়। চাঁদপুর কলেজ, মহিলা কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষার্থী এবং লেখক-পাঠকদের জন্যে সেখানে যাওয়া সহজতর নয়। একই সঙ্গে প্রচার-প্রচারণার অভাবে চাঁদপুর শহরে যে একটি গণগ্রন্থাগার আছে, তা অনেকে জানেন না।
কিভাবে পাঠককে এই গণগ্রন্থাগার মুখী করা যাবে? জানতে চাইলে। তিনি জানান, পাঠক বৃদ্ধির জন্যে গণগ্রন্থগার কর্তৃপক্ষকে তাদের সুবিধাদি সম্পর্কে প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। লেখক-পাঠকদের নিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যেতে পারে। সম্ভব হলে তাদের সংগ্রহে যে বইগুলো আছে, তার তালিকা ওয়েবসাইট বা অনলাইনে দেখার ব্যবস্থা করতে পারে। তবে পাঠকদেরকেও এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে।
এত বই এবং সুযোগ সুবিধা থাকা সত্ত্বেও পাঠক কেন এই গণগ্রন্থাগারে যাচ্ছে না? এই বিষয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন’ এটা গণগ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষ ভালো বলতে পারবে। সেখানে কি কি সমস্যা আছে। পাঠক কেন যাচ্ছে না!।