॥ আল ইমরান শোভন ॥
কিভাবে শুরু করবো, কিংবা কিভাবে তাঁর প্রতি সম্মান জানাবো; সেই ভাষা আমার জানা নেই। শুধু একজন ক্ষুদে সংবাদ কর্মী হিসেবে বলবো, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুস্কর! হাসিমুখ, বন্ধুসুলভ, অল্প সময়ে দ্রুত যে কাউকে আপন করে নেন যিনি, তিনি আমাদের শ্রদ্ধেয় ইকরাম ভাই। তাঁর অকাল মৃত্যু কোনোভাবে মেনে নেয়া যায় না। বিশ^াসই হচ্ছে না, ইকরাম ভাই আমাদের মাঝে নেই।
ইকরাম ভাই এর সম্পাদনায় প্রকাশিত দৈনিক চাঁদপুর দর্পণ এর অফিস যখন হাসান আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে ছিল তখন থেকেই ইকরাম ভাইয়ের সাথে পরিচয় আমার। অবশ্যই এক্ষেত্রে আমাকে পরিচয়পর্বের সুযোগ করে দেন আমার আরও এক বড় ভাই, দৈনিক চাঁদপুর প্রবাহের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক রহিম বাদশা। সম্ভবত ২০০২ কি ২০০৩ সাল। ব্যক্তিগত কাজে ইকরাম ভাইয়ের সাথে দেখা করবেন রহিম ভাই। দৈনিক চাঁদপুর প্রবাহে একই অফিসে কাজ করার সুবাদে তখন রহিম ভাই বললেন, চলেন- ইকরাম ভাইয়ের অফিসে যাবো। আপনাকে পরিচয় করিয়ে দেব। তখন থেকেই ইকরাম ভাইয়ের অফিসে যাওয়া-আসা শুরু হয়।
যখনই ইকরাম ভাই এর অফিসে যেতাম, তখন ইকরাম ভাই তাঁর দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনের নানা অভিজ্ঞতা ও স্মৃতিকথা ব্যক্ত করতেন। নানাভাবে পরামর্শ দিতেন- কিভাবে সাংবাদিকতা করতে হয়।
এক্ষেত্রে আরও একজন বড় ভাইয়ের কথা না বললেই নয়, তিনি হচ্ছেন শ্রদ্ধেয় ইকবাল ভাই। তিনি দৈনিক চাঁদপুর দর্পণে থাকাকালীন সুবাদে তাঁর সাথেও আমার পরিচয় হয়। খুবই ভালো মানুষ। তিনিও প্রায়ই সময় আমাকে ইকরাম ভাইয়ের সাংবাদিকতা সম্পর্কে অনেক অভিজ্ঞতার কথা বলতেন।
ইকরাম ভাইকে দেখেছি, অনেক সাংবাদিক তৈরি করেছেন। তাঁর হাতেখড়ি সাংবাদিকরা দেশেরা শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যমে চাঁদপুর প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। অনেককে তিনি সাংবাদিক নেতা হতে শিখিয়েছেন।
২০০৬ সালে আমি যখন এনটিভিতে পরীক্ষামূলকভাবে কাজ করি, তখন ইকরাম ভাই আমাকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। বিশেষ করে টেলিভিশন চ্যানেলে কিভাবে দ্রুত নিউজ বা ভিডিও পাঠাতে হয়, তা তিনি শিখিয়েছেন। তাঁর সেই হাত ধরেই দেশের অন্যতম একটি টেলিভিশন চ্যানেলে কাজ করার সুযোগ হয়েছে।
২০০৭ সালে যখন আমি দেশের প্রথম অনলাইন সংবাদ সংস্থায় কাজ করার সুযোগ হয়, তখনও ইকরাম ভাই আমাকে অনেক সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন।
বিশেষ করে ইকরাম ভাই, জেলার অধিকাংশ ঘটনা সম্পর্কে অবগত থাকতেন। অর্থাৎ জেলার কোনো স্থানে কখন কি ঘটনা ঘটেছে সে সম্পর্কে তিনি অবগত থাকতেন। আর এসব গুরুত্বপূর্ণ নিউজ শুধুমাত্র আমিই নই, অনেক সাংবাদিক তার সহযোগিতায় জাতীয় গণমাধ্যমে পাঠাতেন।
ইকরাম ভাই এর মৃত্যুতে চাঁদপুরের সাংবাদিক জগতের অপূরনীয় ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতি কোনোভাবেই পূরণ হবার নয়।
ইকরাম ভাই এর অন্যতম একটি গুণ হচ্ছে, তিনি সবসময় হাসিমুখে কথা বলতেন। তাঁর সাথে পরিচয়ের সুবাদে তাঁকে কখনো কারও সাথে রাগান্বিত কিংবা উত্তেজিত হয়ে কথা বলতে দেখিনি। যে কেউ যখনই তাঁর সাথে কথা বলতেন, তিনি সবসময় হাসিমুখে কথা বলতেন। যে কোনো কাজ করতে সবাইকে উৎসাহ দিতেন।
আমি ২০০৮ সালে সম্ভবত চাঁদপুর প্রেসক্লাবের সদস্যপদ লাভ করি। ওই সময় দেশের প্রথম অনলাইন গণমাধ্যম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম- এ নিয়োগ লাভ করি। তখন নিয়োগপত্রের কপি ও দরখাস্ত নিয়ে প্রেসক্লাবের সদস্য পদের জন্য ইকরাম ভাই এর সাথে দেখা করি। তখন তিনি বলেছিলেন, তুমি নিয়োগ পাওয়াতে খুব খুশি হয়েছি। তোমার এই দরখাস্ত আমি রাখলাম। তুমি প্রেসক্লাবের সদস্য হবে। দরখাস্ত দেয়ার কিছুদিন পর প্রেসক্লাবের কার্যকরী পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় সর্বসম্মতিক্রমে আমি প্রেসক্লাবের সদস্য পদ লাভ করি। সভা চলাকালে শ্রদ্ধেয় ইকবাল ভাই জানালেন, শোভন, তুমি প্রেসক্লাবের সদস্য হয়েছো। তোমাকে অভিনন্দন। অবশ্য পরবর্তীতে ইকরাম ভাইও আমাকে অভিনন্দন জানালেন।
ইকরাম ভাই এর চাঁদপুর দর্পণ কার্যালয়টি পর্যায়ক্রমে হাসান আলী হাইস্কুলের সামনে থেকে সরিয়ে অনন্যা সুপার মার্কেট এবং পরবর্তীতে বিপণীবাগ এলাকায় নিজস্ব জায়গায় নিয়ে আসা হয়। বিপণীবাগ এলাকায় চাঁদপুর দর্পণ কার্যালয় থাকার সুবাদে প্রায় প্রতিদিনই ইকরাম ভাইয়ের সাথে দেখা করতে যেতাম। দৈনিক চাঁদপুর প্রবাহের কাজ শেষে রাতে যখন চাঁদপুর দর্পণ অফিসে যেতাম, তখন দেখতাম-ইকরাম ভাই বসে কাজ করছেন। দেখা হলেই বলতেন, শোভন কি খাবে? কেমন আছো? তোমাদের পত্রিকার কাজ কতটুকু হয়েছে? আরও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতেন।
চাঁদপুর দর্পণ অফিসে বলতে গেলে আমি সপ্তাহের অন্তত ৪/৫ দিন যাওয়া হতো। ইকরাম ভাইয়ের অফিসে বসে দীর্ঘ সময় আড্ডা দিতাম। সেই সুযোগে সাংবাদিকতার নানা বিষয় তাঁর কাছ থেকে জানতাম।
তিনি শুধুমাত্র টেলিভিশনই নয়, কিভাবে অনলাইন মিডিয়া ও জাতীয় পত্রিকায় কাজ করতে হয়; সেই বিষয়েও নানাভাবে পরামর্শ দিতেন।
জাতীয় ও স্থানীয় গণমাধ্যমে কাজ করার সুবাদে ইকরাম ভাইয়ের সাথে প্রায়ই নিউজের বিষয়ে কথা হতো। আমরা একে অপরের সাথে নিউজ শেয়ার করতাম। বিশেষ করে জাতীয় গণমাধ্যমে দ্রুত নিউজ পাঠানোর জন্য সহযোগিতার ক্ষেত্রে ইকরাম ভাই ছিলেন অন্যতম। সকলকে সহযোগিতা করতেন। এছাড়া স্থানীয় পত্রিকায় কাজ করার সুবাদে তাঁর সাথে বিভিন্ন নিউজ আদান-প্রদান হতো।
ইকরাম ভাই ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী। তিনি ভোর বেলায় ছুটে যেতেন বিভিন্ন ধরনের নিউজ করার জন্য। চ্যানেল আইতে কাজ করার সুবাদে জেলার কৃষকদের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে তিনি কৃষি সংক্রান্ত প্রচুর নিউজ করেছেন। এছাড়া জাতীয় ও স্থানীয় গণমাধ্যমে সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেছেন।
ইকরাম ভাইয়ের অবদান কোনো কিছুতেই ভুলার নয়, তাঁর কাছ থেকে কত কি শিখেছি, বা জেনেছি তা বলেও শেষ করা যাবে না। বিশেষ করে গণমাধ্যমে তরুণদের তিনি বেশি উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি বলতেন, এই তরুণদের যদি উদ্বুদ্ধ করা না হয়, তাহলে এখানে ভালো সাংবাদিক তৈরি হবে না।
ইকরাম ভাইয়ের সাথে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাফেরার সুযোগ হয়েছে। বিশেষ করে আমি যখন টেলিভিশন সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি নির্বাচিত হই, ২০১৮ সালে বার্ষিক বনভোজনের আয়োজন করা হয়। সেই সময় ইকরাম ভাই ও তাঁর সহধর্মিনী আমাদের সাথে বান্দরবান ও কক্সবাজার ঘুরতে যান। তখন ইকরাম ভাই আমাদের এই আয়োজন দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন। বলেছিলেন, এই ধরনের পিকনিক ভালো লেগেছে। পাহাড়ি এবং সমুদ্র এলাকায় ঘুরে বেড়ানোর জন্য দুটি স্থান নির্বাচন করায় তিনি খুশি হয়েছিলেন। ওই সময় তিনি এই স্মৃতি ধরে রাখার জন্য নিজ হাতে ছবি তোলা ও ভিডিও ধারণ করেন। ঘুরেছেন নিজের মতো করে। অসংখ্য ছবি তুলেছেন সহকর্মীদের সাথে।
টেলিভিশন সাংবাদিক ফোরামের পক্ষ থেকে একসাথে দুটি জেলায় বড় ধরনের বনভোজনের আয়োজন দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন ইকরাম ভাই। ওই বনভোজন শেষে চাঁদপুর আসার পথে তাঁর কাছে টেলিভিশন ফোরামের পক্ষ থেকে স্বপরিবারে দেশের বাইরের ভ্রমণের ব্যাপারে পরামর্শ চাওয়া হলে, তিনি বলেন-অবশ্যই করবে। আমি যাবো, তোমাদের সাথে। দুর্ভাগ্য! ওই সময় থেকেই ইকরাম ভাই শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন। পরের বছর ২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো টেলিভিশন সাংবাদিক ফোরামের পক্ষ থেকে দেশের বাইরে স্বপরিবারে ভ্রমণের উদ্যোগ নেয়া হয়। শারীরিক অসুস্থতায় ইকরাম ভাই দেশের বাইরে তথা ভারতের আগরতলা ও কলকাতা ভ্রমণে যাওয়া হয়নি। যখন আমরা বিদেশ থেকে ঘুরে আসি; তখন তিনি ভ্রমণের গল্প শুনে বলেছিলেন, আমি তোমাদের সাথে আগামীতে যাবো। এজন্য তিনি সব ধরনের প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে আমরা যখন দ্বিতীয়বারের মতো ভারতের আগরতলা ও কলকাতার দর্শনীয় স্থান ভ্রমণে যাই, তখন ইকরাম ভাই শারীরিক অসুস্থতা বেড়ে যাওয়ায় তার আর যাওয়া হয়নি। শুধুমাত্র তাঁর মেয়ে ইয়ানা আমাদের সাথে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়।
যাঁর এতো উৎসাহ-উদ্দীপনায় এগিয়ে চলার চেষ্টা, সেই ইকরাম ভাই আমাদের সাথে দেশের বাইরে যাওয়া হলো না। শারীরিক অসুস্থতা বেড়ে যাওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার সব প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও মহামারি করোনা প্রভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ থাকায় তার উন্নত চিকিৎসা করা সম্ভব হয়নি।
ইকরাম ভাইয়ের মতো এমন অভিভাবক, খুঁজে পাবো কি-না জানি না। ওপারে ভালো থাকবেন…শ্রদ্ধেয় ইকরাম ভাই।
লেখক : আল ইমরান শোভন, সভাপতি, চাঁদপুর টেলিভিশন সাংবাদিক ফোরাম; বার্তা সম্পাদক; দৈনিক চাঁদপুর প্রবাহ।