বিশেষ প্রতিনিধি :
চার মেয়ের পর একমাত্র ছেলে। সংসারে বাঁধ ভাঙা আনন্দ। মায়ের কী উল্লাস! মা আদর করে নাম রেখেছিলেন সুখ। জীবনের সাথে সুখ নামটা মিশে গেলেও আসল সুখ উড়ে গেছে ছয় বছর বয়সেই। ছয় বছর বয়সে অবুজ সুখ মা হারান। এ বয়সে মা হারা হলে কারো জীবন আর সুখের হওয়ার সুযোগ খুব কম। তারপর যদি আবার সড়ক দুর্ঘটনায় বাম হাত অকেজো হয়। এ যেন সত্যি সত্যি মরার উপর খাড়ার ঘাঁ। হিন্দু ধর্মাবলম্বী বলে সুখ এর পুরো নাম সুখ রঞ্জন সরকার।
চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার বড় হায়াৎপুর গ্রামের পরেশ চন্দ্র সরকারের একমাত্র ছেলে সুখ রঞ্জন সরকার। ভাগ্য বিড়ম্বিত সুখ এখন অসুখের সাথে সংসার পেতেছেন। বর্তমানে হকারি করে চলে জীবন সংসার। দিনের বেলায় চাঁদপুর শহরের বিভিন্ন স্কুলের সামনে মটর সেদ্ধ করে যা আয় হয় তা দিয়ে চলে স্ত্রী এক ছেলে ও এক মেয়ের সংসার। বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের সামনে সেদ্ধ বুট বিক্রি করেন।
সম্প্রতি সাপ্তাহিক শপথ এর এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপ চারিতায় উঠে আসে তার জীবনের রূঢ় বাস্তবতা।
প্রায় ত্রিশ বছর আগে গ্রাম ছেড়ে চাঁদপুরের নতুন বাজারের একটি ভাড়া বাড়িতে উঠে সুখ এর পরিবার। বাবা পরেশ চন্দ্র সরকার পেশায় কাঠ মেস্ত্রী। শহরে উঠার একবছরের মাথায় মারা যান মা। তখন সুখ এর বয়স ছয় বছর। লাথির উপর বড় হয়েছি। তারপর একসিডেন্টে জীবন আরো থেতলে যায় বলে জানায় সুখ রঞ্জন সরকার।
সুখ রঞ্জন বলেন, ২০০২ হাজীগঞ্জের বিলবাড়িয়া এলাকার রাস্তার পাশের খালে পড়ে যায় কচুয়াগামী ঈগল বাসটি। আমার দুই হাত খুব ক্ষতিগ্রস্থ হয়। টাকার অভাবে নরমালি চিকিৎসা করানো হয়। বাম হাতের নিচের দুইটা নালি রগ কেটে যায়। যে কারণে হাত মুঠ করা যায় না। প্রাথমিক চিকিৎসা করানোর কারনে হাতে শক্তি পাচ্ছিলাম না। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্যে ঢাকা যাই। ততোদিনে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। ডাক্তার বললেন হাত আর ভালো হবে না। তারপরেও যেটুকু চিকিৎসা করানো হয় বিনিময়ে একগ্লাস পানি তুলতে পারি। মা যে বাসায় জি’র কাজ করতেন সে বাসার মালিকের ছেলে তখন আট হাজার টাকা অপারেশনের জন্যে দেয়। সে টাকায় এখন জীবন নিয়ে কোনো মতে বেঁচে আছি বলেন সুখ রঞ্জন।
বর্তমানে নতুন বাজারে হলদি ফ্যাক্টরির পাশে তিন হাজার টাকা খরচে বাসা ভাড়া থাকা হয়। দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করা হলেও দুর্ঘটনার পর আর পড়ালেখা আগায়নি। নিজে মেট্রিক পরীক্ষা দিতে পারেনি। ছেলেটা ছোট আর মেয়েটা চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে। ছেলে মেয়েকে শুধু মেট্রিক পাস করানোই আমার স্বপ্ন। আর কোনো স্বপ্ন নেই। নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখাতো ভুলে গেছি ছয় বছর বয়সেই। যেটুকু সাহস নিয়ে এগুচ্ছিলাম তাতো শেষ হয়ে গেছে বাস একসিডেন্টেই।
দুর্ঘটনার পর অনেকের সাথে আলাপ করেছি প্রতিবন্ধি ভাতার জন্যে। একটা প্রতিবন্ধি ভাতা কার্ডের জন্যে অনেকের কাছে ঘুরেছি। কিন্তু পাইনি। আজো পেলাম না। আর পাই কি না তাও জানি না।
চাঁদপুর পৌরসভার ভোটার আমি অনেকবার ভোট দিয়েছি। কিন্তু বিনিময়ে কিছুই চাইনি পাওয়াও হয়নি। মার্কা পছন্দ হয়েছে যেটা সেটাতেই ভোট দিয়েছি। কাকে ভোট দিয়েছি মনে করতে পারছি না। তবে আমি সরল বিশ্বাসে ভোট দিয়েছি। যারা শহরের উন্নয়ন করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে শুনেছি সেই প্রতিকেই ভোট দিয়েছি।
এখন হকারি করি সংসার চালাই। ছয়-সাতশ টাকার পূঁজি। এদিয়ে কোনো মতো সংসার চালাই। এখন কাঁচামালের দাম বেশি হয় তখন লাভ কম হয়। কিন্তু শীত মৌসুমে ভালোই লাভ হয়। কোনো কোনো দিন ভালো ব্যবসার হলে কিছু টাকা সঞ্চয় করি। সে টাকা দিয়ে অসুস্থ্য হলে চলি। আগে পাঁচ কেজি বুট বিক্রি করেছি। এখন সাড়ে তিন কেজি বেচতে পারি। এর বেশি পারি না। শরীরও সায় দেয় না। যা আয় হয় তা তিন ভাগে রাখি। বাসা ভাড়া, সংসার খরচ, সঞ্চয়। সঞ্চয়ের টাকা বিপদের সময় খরচ করি। কিছু দিন আগে স্ত্রী অসুস্থ্য হয়েছিলো তখন ১৫হাজার টাকা খরচ হয়।
এ জগতে বিপদে পড়লে আপন পর বুঝা যায়। অবশ্য আমার আপন মানুষরাও ভালো নাই। কোনো মতে তারা জীবন চালায়। বাবা আবার সংসার পেতেছেন। যা আয় করেন তা দিয়ে তার সংসার চলে। চার বোন সংসার পেতেছেন অনেক আগে।
এখন নিজের কোনো স্বপ্ন নাই। গরম কালে হাত খুব চাবায় কামড়ায় ব্যাথা হয়। শীত কালে অবসের মতো হয়ে যায়। একটা প্রতিবন্ধি ভাতা কার্ড পেলে হয়তো একটু শান্তি পেতাম। কে দেবে এতোটুকু সুখ? অবশ্য শুধু জীবনের প্রয়োজনে একটা ভাতা কার্ড পাবার স্বপ্ন দেখি। সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে রাতে ঘুম হয় না। আমার জীবনতো শেষ সন্তানদের জীবনের কী হবে এ ভেবে শান্তিতে একটু ঘুমাতেও পারি না।
আজ,
মঙ্গলবার , ২৮ মার্চ, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ , ১৪ চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম:
প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।