বিশাল দাস:
সাপ্তাহিক শপথ শুধু একটি নাম নয় বর্তমানে পাঠকদের কাছে ভালোবাসার একটি প্রতীক। এটি সুদক্ষ সম্পাদক দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। ২০১৯ সালের ২৬ আগস্ট সাপ্তাহিক শপথের পথচলা শুরু হয়। আমি শপথের একজন কর্মী হতে পেরে গর্বিত ও আনন্দিত।
পত্রিকায় কাজ করা নিয়ে একটু স্মৃতিচারণ না করলেই নয়। চাঁদপুর জজ কোর্টে বড় ভাইয়ের ছোট একটি ব্যবসা পরিচালনা করেন। ভাই ১০/১২ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে ব্যবসাটিকে দাঁড় করিয়েছে। ২০১২ সালের এস.এস.সি পরীক্ষা দেই। পরীক্ষা শেষ হওয়ার সাথে সাথে ভাই নিজের সাথে নিয়ে গেলেন কম্পিউটার শেখাতে। দোকানে মামলার কাজগুলো কম্পোজ করা হতো। কাজ করতে করতে কম্পোজ এ হাত দ্রুত গতিতে চলতে লাগলো। তখন মোটামোটি ভাইয়া দোকানে না থাকলেও চালিয়ে নিয়ে যেতাম। ভালোই চলছিল। পাশাপাশি পড়াশোনাও চলছিল। ২০১৪ সালে এইচ.এস.সি তেও মোটামোটি ভালো ফলাফল করলাম। পরে অনার্স এ সুযোগ না পেয়ে ডিগ্রীতে ভর্তি হলাম। ডিগ্রী পরীক্ষায়ও ২য় স্থানে উর্ত্তীণ হলাম। একদিন হঠাৎ ভাইয়ের কথায় রাগ করে দোকান থেকে চলে আসলাম। কঠোর ভাবে জিদ করেছি আর যাবো না দোকানে। কোন মতেই না। যতোই যাই হোক। প্রায় ৬/৭ মাস দোকানে নিজের ছাঁয়াকেও পরতে দিলাম না। বাবা মা অনেকবারই দোকানে যাওয়ার জন্য বললেন। কিন্তু গেলাম না। বাসায় ছিলাম অবসর। কোন কাজ কাম করি না। মা প্রতিদিনই বলতো একটা কাজ কাম কর। এভাবে কতো দিন থাকবি। দোকানে না গেলে কোথাও একটা কাজ খুঁইজা বের কর। অন্তত নিজে তো চলতে পারবি। বড় হয়া গেসস। এখন তোরা আইনা দিবি, আর তোদেরকে এখনো দিতে হয়। প্রতিদিনই এমন নানা কথা বকাবকি শুনতে হত। একদিন মনে মনে জিদ ধরলাম। আর মাকে বললাম ঠিক আছে। চাকরী করতে বের হলে আর বাসায়ই আসব না। ফেসবুকে একটি কোম্পানির চাকুরীর নিয়োগ পেলাম। বাংলাদেশ সিকিউরিটি ফোর্স কোম্পানীতে। ১৫/১৬ হাজার টাকা বেতন দিবে। রিক্রুটিং অফিসার পদে আবেদন করলাম। কোম্পানী থেকে ফোন করে আমাকে ঢাকা গাজীপুর চৌরাস্তায় তাদের অফিসে আসতে বলল ডকুমেন্টগুলো নিয়ে। কাপড় চোপড় গুছিয়ে রাত ১২.১৫ মিনিটে চাঁদপুর থেকে ছাড়া ময়ুর-৭ লঞ্চে উঠলাম। ঢাকা থেকে গাজীপুর যেতে বাসে উঠতে হবে। কিন্তু বাসে যাতায়াত করতে কষ্ট হয় আমার। তাই ভাবলাম যদি সকালে বাসে উঠি রাস্তা খালি থাকবে। ৪০/৫০ মিনিটে গাজীপুর চলে যেতে পারব। কষ্টটা একটু কম হবে। ৬টায় সদরঘাট থেকে বাসে উঠলাম। ভালোই চলছিল বাস। এরমধ্যে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। বৃষ্টির পানি রাস্তায় জমে যাওয়ায় বাস আস্তে আস্তে চলতে লাগলো। প্রায় ১ ঘন্টা বোর্ড বাজারেই বাস থেমে রইলো। একটু যায় আবার থামে। যায়, থামে। শরীরটা খুব অস্বস্তিকর লাগা শুরু করল। পাশে বসা একজকে জিজ্ঞাসা করলাম ভাই চৌরাস্তা যেতে আর কতো সময় লাগবে? লোকটি বলল আরো ১৫ মিনিট সময় লাগতে পারে। বললাম এখান থেকে রিক্সায় যাওয়া যাবে? লোকটি বললো যাবে। নেমে পড়লাম বাস থেকে। রাস্তায় পানি ভর্তি। জুতা পরে হাঁটা সম্ভব নয়। তাই প্যান্ট একটু উঠিয়ে জুতা হাতে নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম চৌরাস্তার উদ্দেশ্যে। রাস্তায় পানি থাকার কারণে কোন রিক্সা ওদিকে যেতে চাচ্ছিল না। প্রায় একঘন্টা জুতা আর ব্যাগ হাতে নিয়ে হেঁটে হেঁটে চৌরাস্তায় পৌঁছালাম। দুই মামার বাসা গাজীপুরে। চৌরাস্তা থেকে রিক্সায় ১০ মিনিট সময় লাগে মামার বাসায় যেতে। আগেই মামীকে ফোন দিয়েছিলাম। মামী আমি আসছি। মামি বললো রিক্সা নিয়ে সরাসরি বাসায় চলে আসো। রাস্তায় কাঁদা আর পানি থাকার কারণে রিক্সাও যেতে চাচ্ছিলো না। পরে একটি মালবাহী পিকআপ এ উঠে কিছুদুর গেলাম। অনেক বছর পরে যাওয়ার কারণে রাস্তাও ঠিক মনে পড়ছিলো না। মামী ফোন দিল, বললো কোথায়? বললাম মামী রিক্সায় উঠব এখন। রিক্সায়ালাকে ফোন ধরিয়ে দিলাম। মামী ঠিকানা দিলো ড্রাইভারকে। কিন্তু রিক্সায়ালা কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে সন্দেহ হলো। একটা গল্লিতে রিক্সাটা মোড় দেওয়ার আগেই উচ্চ কন্ঠে বললাম কোথায় নিয়ে যান? গাড়ী ঘুড়ান। যেখান থেকে নিয়ে আসছেন ওখানেই নিয়ে যান। রিক্সায়ালা বললো মামা এদিকেইত ঠিকানাটা বললো। বললাম রিক্সা ঘুরাইতে বললাম ঘুরাও। রিক্সায়ালা আমার দিকে তাকিয়ে সেই আগের স্থানে এসে নামিয়ে দিলো। ভাড়া দিয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে থেকে মামীকে ফোন দিলাম। এর ফাঁকে মামী অনেকবার কল দিয়েছে। বলল এত সময় লাগে নাকি আসতে। বললাম মামী রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি। মামী বলল আচ্ছা সোনুকে পাঠাচ্ছি। সোনু আমার মামার ছেলে। সাইনবোর্ড দেখে বললাম আমি এখানে আছি। তখনও বৃষ্টি হচ্ছে। আর পুরোটাই ভিজে গেছি তখন। মামতো ভাই এসে বাসায় নিলো। বাসায় গিয়ে গোসল করে নাস্তা করলাম। নাস্তা করেই অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হলাম। আরেক মামতো ভাইকে ফোন দিলাম। বললাম চাকুরীর জন্য ইন্টারভিউ দিতে এসেছি। আমার সাথে একটু অফিসে যেতে হবে। বলার সাথে সাথে চলে আসলো। বলল দাদা কোথায়? ঠিকানা বললাম অফিসের। দু’জন বেরিয়ে পরলাম অফিসের উদ্দেশ্যে। ওয়েটিং রুমে বসলাম। রিসিপশন ডেস্কে পরিচয় দিলাম। ১০/১৫ মিনিট পরে ডাকলো আমাকে। শিক্ষাগত যোগ্যতার কাগজপত্রসহ সকল কাগজপত্র দেখলো। প্রশ্ন করল কেনো চাকুরী করতে চান? উত্তর দিলাম। আরো কয়েকটি প্রশ্ন করল যথাযথ উত্তর দিলাম। বলল আপনি চাইলে আগামীকাল থেকে চাকুরীতে যোগদান করতে পারেন। যে পদে আবেদন করেছি সেই পদের কাজ সম্পর্কে আমাকে বুঝানো হলো। কোম্পানির কর্মচারীদের বদলী করা, নতুন আবেদনকারীদের পরীক্ষা নেওয়া, অনলাইনে আবেদনের নোটিশ ছাড়া। আর কোম্পানী থেকে আমাকে একটি ফোন, একটি সিম কার্ড (কার্ডে সবসময় ৪হাজার টাকা ব্যালেন্স থাকবে) যার জন্য আমাকে ৮ হাজার টাকা জামানত দিতে হবে। ১হাজার টাকা দিয়ে ফরম পূরণ করলাম। বললাম ২/১দিনের মধ্যে যোগদান করব। বাসায় ফোন করলাম বাবাকে। জানালাম যে চাকুরী হয়ে গেছে। কিছু টাকা লাগবে। বাবা বলল ঠিক আছে তোর মা’র সাথে কথা বলে পাঠিয়ে দিতেছি। কিছুক্ষণ পর বাবা ফোন করে বলতে লাগল যে তোর মা খুব কান্নাকাটি করছে, বলতেছে যে চাকুরী করা লাগবে না বাসায় চলে আসতে। মা ভেবেছিলো এতদূরে একা একা কিভাবে থাকবে? বাবাকে বললাম না আমি চাকুরী করব। অনেক কষ্ট করে এসেছি চাকরীর জন্য। মা মামাকে ফোন দিয়ে বলল আমাকে বুঝিয়ে পাঠিয়ে দিতে। অবশ্য মামা মাকে বলেছিল যে অসুবিধা নাই আমরা তো আছি। চাকুরী করুক। কিন্তু মা মানলো না। সর্বশেষ মায়ের মায়ায় চাঁদপুরে চলে আসলাম। বড় ভাই বুঝালো, পরামর্শ দিলো।
চাঁদপুর এসে বড় ভাইয়ের বন্ধু বাবু ভাই সহ ১৮ জুলাই সন্ধ্যায় কাদের পলাশ ভাইয়ের সাথে দেখা করলাম তার অফিসে। কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে যোগ দিলাম তাঁর অফিসে। হয়তো আমার এই রাগই আমাকে একজন ভালো মানুষের সংস্পর্শে এতে সহযোগিতা করেছে। এই রাগ না করলে হয়তো ভাইয়ের সাথে দেখা হতো না। জানতাম না যে চাঁদপুরে একজন ভালো মনের মানুষ আছে। ভাবিনি যে এতো সময় থাকা হবে ভাইয়ের সাথে। কিন্তু কাদের পলাশ ভাইয়ের ভালোবাসা হয়তো আমার মনকে জয় করে নিয়েছিলো। কখনো ধমক দিয়ে কথা বলে নি। কখনো তার কর্মচারী ভাবেনি। আপন ভাইয়ের মতো করে রেখেছিল, এখনো রাখছে। তার ব্যবহার আচরণ দেখে উপলব্ধি করতে পারলাম যে তিঁনি একজন ভালো মনের মানুষ। একজন “ঋৎবয যধৎফবফ সধহ”। অনেক বিশ্বাসও করে আমাকে। একদিন বলল বিশাল পত্রিকাগুলো দিতে পারবি? বললাম জ্বি ভাই পারব। বলল হকার দিয়ে যদি পত্রিকাগুলো দেই তাহলে তারা ফাঁকি দিবে। নিয়মিত দিবে না। আর আমাদের পত্রিকা নতুন। মানুষের কাছে না পৌঁছালে জানবে কিভাবে যে শপথ পত্রিকা আছে। বললাম ভাই অসুবিধা নাই আমি দিব। ভাই সাইকেল কিনে দিল। আমি মানুষ ছোট হলেও মিশেছি বড় মানুষগুলোর সাথে। প্রথমদিন পত্রিকা দিতে কেমন জানি লাগছিল। তাই মুখে রুমাল বেধে পত্রিকা দিতাম যাতে কেউ না চেনে। মাঝে মাঝে কাদের পলাই ভাই তার জীবনের গল্প বলত। যে কিভাবে সে যুদ্ধ করেছে জীবনের সাথে। অনেক সময় না খেয়েও কাজের পিছে ছুটে যেত। তার কথাগুলো শুনে কাজের প্রতি ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা এসে পরল। তারপর থেকে খোলা মনেই সাইকেল নিয়ে পত্রিকা দিতাম। তখন থেকে অদ্যবধি পত্রিকা দিতে গিয়ে নিজেকে ছোট মনে হলো না। ভাবতাম এটা কাজ। কে কি বললো সেটা নিয়ে আর মাথা ঘামাই না। সোমবার এলেই যেনো দায়িত্ব বেড়ে যেতো। রাতে ঘুম আসতো না। ভাবতাম কখন সকাল হবে। কখন পত্রিকাগুলো দিবো। অনেক সময় রাত ২টা, ভোর ৪টায় ঘুম ভেঙ্গে যেতো। ভাবতাম সকাল হয়ে গেছে। সোমবার রাতে ঘুমাতাম বললেই চলে। অনেক সময় সাইকেল নষ্ট হয়ে গেলেও হেঁটে হেঁটে শহর জুড়ে পত্রিকা দিতাম। এখনো দিচ্ছি। মহামারী করোনাও থামিয়ে রাখতে পারেনি শপথকে। গত ৪ মাস দেশ লকডাউন থাকলেও শপথের পথচলা থেমে থাকেনি। নিয়মিতই প্রকাশিত হয়েছে বস্তুনিষ্ট সংবাদ নিয়ে। শপথ দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। পত্রিকার সম্পাদক কাদের পলাশ ভাইয়ের ভালোবাসায় সিদ্ধ হয়ে শপথের প্রতি ভালোবাসা। আপন ছোট ভাইয়ের মতোই আগলে রেখেছেন এখনো। শপথ সাপ্তাহিক হিসেবে পাঠকের মনে যেটুকু জায়গা করে নিয়েছে ভবিষ্যতে শপথের প্রতি পাঠকের ভালোবাসা আরো সুদৃঢ় হবে প্রত্যাশা করছি। শপথকে তার লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছে দিতে শপথ পরিবার দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। শুভ হোক শপথের পথচলা। শুভ জন্মদিন ভালোবাসার শপথ, প্রাণের শপথ।