এম এ লতিফ:
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা চাঁদপুরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ছাড়াও নিরস্ত্র অগণিত মানুষকে হত্যা করে। আর চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনা-ডাকাতিয়া নদীর মিলনাস্থল ‘বড়স্টেশন’ মোলহেড ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতনের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র। এই বধ্যভূমিতে রাজাকারদের সহযোগিতায় ৫ থেকে ৭ হাজার মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ মানুষকে ধরে এনে নির্যাতন করে হত্যা করে মরদেহ নদীতে ফেলে দেয়। আর এখানেই ২০১১ সালে নির্মিত হয় ‘রক্তধারা’ নামের একটি স্মৃতিস্তম্ভ। পরবর্তীতে তা জেলা প্রশাসন ও পৌর প্রশাসন মিলে সংরক্ষণ করেন।
এছাড়াও ১৯৮১ সালে হাজীগঞ্জের নাসিরকোর্ট গ্রামের বধ্যভূমি ‘নাসিরকোর্ট স্মৃতিসৌধ’, ১৯৯৭ সালে ৪ ডিসেম্বর মতলব দক্ষিণ উপজেলার মতলব জেবি হাইস্কুল মাঠে ‘দীপ্তবাংলা’, ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর মতলব উত্তর উপজেলা পরিষদ চত্বরে ‘চান্দ্রাকান্দি স্মৃতিসৌধ’ নামে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে স্থানীয়দের উদ্যোগে। কিন্তু সেগুলোসহ এর বাহিরে জেলায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও স্মৃতিবাহী স্থানগুলো সংরক্ষণের কোন উদ্যোগ নেয়নি স্থানীয় প্রশাসন।
যদিও চাঁদপুর জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, চাঁদপুরে ১৯টি বধ্যভূমি চিহিৃত করা হয়েছে। সাবেক জেলা প্রশাসক প্রিয়তোষ সাহা বিভিন্ন লেখকের বই থেকে ওইসব স্থানগুলো সংকলন করেন। স্থানগুলো হলো- সদর উপজেলার বাগাদী গ্রামে ২৪ অক্টোবরের গণহত্যা, দাসাদী ও শিলন্দিয়া গ্রামে ৬ ডিসেম্বরের গণহত্যা, ছোটসুন্দর গ্রামে ১০ আগস্টের গণহত্যা, ফরিদগঞ্জ উপজেলার গৃদকালিন্দিয়া গণহত্যা, দত্রা গণহত্যা, চরভাগল গণহত্যা, হাজীগঞ্জের লাওকরা গণহত্যা, বড়কূল গণহত্যা, রঘুনাথপুর গণহত্যা, শাহরাস্তির আহমদনগর গণহত্যা, রায়শ্রী গণহত্যা, কচুয়ার রহিমানগর গণহত্যা, সাচার গণহত্যা, কাদলা গণহত্যা, মতলব দক্ষিণের কাশিমপুর গণহত্যা ও মতলব উত্তর উপজেলার রসুলপুর ও এনায়েতনগর গণহত্যা।
শুধু তাই নয় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধরে রাখতে জেলার বিভিন্ন স্থানে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভগুলোও রয়েছে অযতœ-অবহেলায়। তাই নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে গড়ে তুলতে ও ইতিহাস জানাতে বধ্যভূমির স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণের দাবি জানায় মুক্তিযোদ্ধারা।
তবে পর্যায়ক্রমে সেগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক কামরুল হাসান। তিনি বলেন, বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণের জন্য সরকার খুবই আন্তরিক। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও এলজিইডি থেকে বধ্যভূমির তালিকা করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত আমরা জেলায় ১৯ টি বধ্যভূমি তালিকাভূক্ত করেছি। আমরা সবগুলোই সংরক্ষণ করবো।
এদিকে স্বাধীনতার ৫২ বছরেও বধ্যভূমিগুলো সনাক্ত ও সংরক্ষিত না হওয়ায় হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। তাই তারা শীঘ্রই এসব বধ্যভূমি সংরক্ষণে উদ্যোগ নেয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা জীবন কানাই চক্রবর্তী বলেন, মুক্তিযুদ্ধে হাজীগঞ্জের বিভিন্ন জায়গায় হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা এমদাদুল হক, জাহাঙ্গীর আলম, আবদুর রশিদ, মো. জয়নাল আবেদীন, মো. আবু তাহের, মো. জহিরুল ইসলাম ও মো. ইলিয়াস শহীদ হন। তাদের লাশ নাসিরকোর্ট গ্রামে সমাহিত করা হয়। আর ওই গ্রামেই ১৯৮১ সালে তাদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হলেও ওইসব বধ্যভূমি সংস্কারে সরকারের কোন উদ্যোগ নেই।
তাই মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি, চাঁদপুরের অসংখ্য বধ্যভূমি ও গণকবর রয়েছে। সরকার যেন সেগুলো ভালোভাবে চিহ্নিত করে। খোঁজখবর নিয়ে শহিদদের স্মৃতি রক্ষায় ব্যবস্থা নেয়। তা না হলে পরবর্তী প্রজন্ম বুঝতে পারবে না বীর মুক্তিযোদ্ধারা কীভাবে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাদের জন্য বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন। জানতে পারবে না কত ত্যাগের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে।
অপরদিকে বোমা বানাতে গিয়ে চাঁদপুরের প্রথম চার শহিদের স্মরণে শহরের ট্রাকরোড এলাকায় ১৯৯৭ সালে নির্মিত ‘কালাম-খালেক-সুশীল-শংকর’ স্মৃতিসৌধ এখন অযতেœ অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে। তবে শহরের মুক্তিযোদ্ধা সড়কের লেকের উপর নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ ‘অঙ্গীকার’ ও শহরের কালিবাড়িতে ‘শপথ ফোয়ারা’ নির্মাণ করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে। কিন্তু বড়স্টেশনের রক্তধারা ছাড়া বাকি বধ্যভূমিগুলো সরকারি ভাবে সংরক্ষণে নেয়া হয়নি কোন পদক্ষেপ।
জেলা সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি ডা. পীযূষ কান্তি বড়–য়া বলেন, জেলার বিভিন্ন স্থানে বধ্যভূমি চিহ্নিত করার পাশাপাশি যারা শহীদ হয়েছেন তাদের পরিচয় সনাক্ত করে বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে। এতে তারা দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হবে। তা না হলে দেশের কোনো সংকটে যুব সমাজ এগিয়ে আসবে না।
জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা এম এ ওয়াদুদ বলেন, তরুণ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সঠিকভাবে তুলে ধরতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ আর দেশপ্রেমের কথা তাদের জানাতে হবে। তবে বর্তমান সরকার সেইসব স্মৃতিবিজরিত বধ্যভূমিগুলো সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। আমরা আশা করছি সহসাই সংরক্ষিত হবে।
তবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে অমানুষিক নির্যাতনের পাশাপাশি নির্বিচারে প্রাণ হারিয়েছে চাঁদপুরের হাজার হাজার মানুষ। সেসব নির্যাতনের স্থান ও বধ্যভূমিগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ না করায় নতুন প্রজন্ম ভুলতে বসেছে সেসব দিনের ইতিহাস। তাই চোখের সামনে যুদ্ধদিনের স্মৃতি হারিয়ে যেতে দেখে বীর মুক্তিযোদ্ধা ব্যাংকার মজিবুর রহমান হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, স্বাধীনতার এত বছর পরও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণ না করায় রক্তক্ষরণ হয় হৃদয়ে। চাঁদপুরের যেখানে যেখানে অনেক বধ্যভূমি ও গণকবর রয়েছে। সরকার যেন তা ভালোভাবে তদন্ত করে শহীদদের স্মৃতির স্মরণে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয়। আর তা না হলে পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের আত্মত্যাগ আর গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সম্পর্কে কিছুই জানবে না। তাই চাঁদপুরের বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষনের দাবি জানান তিনি।