মোঃ শহীদ হোসেন
আমাদের পারিবারিক ভাবে ঘুড়ি উড়ানোটা একটা শখের জায়গা। আর তাছাড়া পুরাণ ঢাকার শাকরান্তী (ঘুড়ি উৎসব) খুবই জনপ্রিয়। আমরা প্রায় সময়ই বাবা ছেলে এক সাথে ঘুড়ি উড়াতাম। বিশেষ করে সাকরাইনের সময় যেন আনন্দের মাত্রাটা ছিল বেশী। আমি যখন ঘুড়ি উড়াতাম তখন অনেক সময় ঘুড়ি কাটাকাটিতে বাবাও অংশ নিতো। সাকরাইনে বাবা ছেলে এক সাথেই ঘুড়ি উড়াতাম। বাবা মানেই প্রাণবন্ত এক নাম। বাবা তো বাবাই। বাবার তুলনা বাবা নিজেই। রৌদ্র, বৃষ্টিতে ভিজে জীবনের কঠিনতম সময় পার করলেও বাবা কখনো বলেনি যে আমি ভাল নেই। সর্বদা হাসি মুখ থাকতো তার। আমার বাবার নাম আফতাব উদ্দিন। তিনি একজন ব্যবসায়ি ছিলেন। পুরাণ ঢাকার ব্যবসায়ি মানেই তো ছিল আলাদা একটা ভাব। তবে বাবা ছিলেন একদম সহজ সরল একজন মানুষ। আমাদের আড়ৎ ছিল। সেটি বাবাই দেখতেন। আজ যখন বাবাকে নিয়ে লিখতে বসলাম ঠিক তখন বার বার যেন চোখের কোনে পানি জমে যাচ্ছিলো। মেনে নিতে পারছি না যে বাবা এ মুহুর্তে আমাদের মাঝে নেই। বাবার অনুভূতি লিখে বা বলে প্রকাশ করা যায় না। গ্রাজুয়েশনের পরও বাবাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতাম। আমার চাকরি হওয়ার পরও যখন ছুটি পেতাম তখন এক রাতের জন্য হলেও বাবার সাথে ঘুমাতাম। মাঝে মাঝে বাবা কষ্ট পেলেও কখনো সেটা আমাদের সামনে প্রকাশ করেনি। আসলে বাবারা এমনই হয় সন্তানের সামনে কষ্ট প্রকাশ করতে চান না। আমরা তিন ভাই দুই বোন। বাকী দুই ভাই পুরান ঢাকায় ব্যবসা করেন। ওরা এখন স্যাটেল। ভাল অবস্থানে আছেন। আলহামদুলিল্লাহ! ছোট বেলায় আমি একটু দুরন্ত ছিলাম এটা তো বলাই চলে। তবে অবাধ্য ছিলাম না। স্কুল পালানোটা ছিল আমার রীতিমত একটা নিয়ম মাফিক কাজ। কিন্তু স্কুল পালিয়ে যখন বাড়ি ফিরতাম তখন বাবার বকার বদলে উলটো বুঝিয়ে বলাটা যেন ছিল আমার পরম পাওয়া। তিনি বুঝাতেন স্কুল পালানোটা ঠিক নয়। তবে আমি স্কুল পালালেও রাস্তায় ঘুড়াঘুড়ি করতাম না। এমনকি স্কুল ফাঁকি দিলেও কখনো বাজে আড্ডা দিতাম না। বাবার বকা ঝকা খাইনি, তিনি খুব সহজ সরল ছিলেন। বকা ঝকা করার প্রশ্নই আসে না। তিনি সন্তানদের বুঝতে চাইতেন এবং বুঝাতে চাইতেন। আমার একটি ঘটনা এখনো মনে পড়ে, তখন আমি খুব ছোট, বাবাসহ কোর্টবাড়িতে গিয়েছিলাম পিকনিকে। তখনকার সেই সময়ের ছবিগুলো এখনো আমার স্মৃতির পাতায় আকড়ে আছে।
সফলতার পেছনে বাবা এবং মা দুজনের অবদান অনীস্বিকার্য। আমার বাবা মায়ের সবচেয়ে ভাল দিক হচ্ছে আমার প্রতি কোন চাপ ছিল না যে অমুক হতে তমুক হতে হবে। শুধু ছেলে ভাল মানুষ হবে এটাই তাদের চাওয়া ছিল। বাবার প্রতি যত্নে ত্রুটি ছিল না। সবচেয়ে বড় কথা হলো তিনি যখন মারা যান তখন তিনি আমার কোলে। আমার বাবার সৌভাগ্য হলো যে তিনি যখন আমাদের কাছ থেকে চিরবিদায় নিচ্ছেন তখন আমাদের পরিবারের সবাই ওনার চোখের সামনেই ছিলাম। ২০১৮ সালে ১০ মার্চ হৃদযন্ত্রের ক্রীয়া বন্ধ হয়ে মারা যান।
বর্তমানে আসলে অনেক গল্পই আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পাই যে অনেকে তাদের বাবা-মা কে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেন। এটি আসলে মোটেই ঠিক নয়। আমাদের সামাজিক যে অবক্ষয় সেটি যদি না রোখা যায়, পারিবারিক বন্ধন যদি বজায় না থাকে তাহলে আমাদের আগামীর প্রজন্মের কাছে অপরাধীই থেকে যেতে হবে।
সর্বশেষ বলতে চাই আমি এখনো একটা ঘোরের মধ্যে থাকি। বিশেষ করে বাসায় গেলে এখনো মনে হয় যেন বাবা পাশে আছে। বাবার এই অনুভূতিটা আমার সারাজীবনই থাকবে।
লেখক: মোঃ শহীদ হোসেন
অফিসার ইনচার্জ: ফরিদগঞ্জ থানা