রিয়াজ শাওন:
রাস্তার পাশে জরাজীর্ণ দোচালা একটি টিনের ঘর। দরজায় তালা ঝুলছে অথচ ঘরের চারপাশের টিনের বেড়াগুলো ভেঙে চুরে গেছে। উওর পাশে টিনের বেড়া কয়েক বছর আগেই একেবারে ভেঙে পড়ে গেছে। এতে রাস্তা থেকে সরাসরি দেখা যায়। ঘরের ভিতরে থাকা স্টিলের আলমারি, টেবিল তার উপর কাটুনে কাটুন বইসহ পড়ে আছে আসবাবপত্র। ভিতরে আর কি আছে দেখার জন্য এটু ভিতরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই স্থানীয় বাসিন্দারা চিৎকার করে বলে উঠলেন, ভিতরে যাবেন না, ভিতরে সাপ আছে।
এমন জরাজীর্ণ ভাঙ্গাচুরা ঝুপড়ি ঘরটি হাজীগঞ্জ উপজেলার ৫নং সদর ইউনিয়নের মাতৈন গ্রামে অবস্থিত। এটি একটি সরকারি নিবন্ধিত বেসরকারি পাঠাগার। যার নাম মাতৈন আদর্শ পাঠাগার। সমাজসেবা অধিদপ্তর ও যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের নিবন্ধনও আছে এই পাঠাগারের। যার নিবন্ধন নাম্বার-সসেঅ/চাঁদ/২৮২/৯৭/ ও যুবঅ/স্বীকৃতি নং- ০৭০১৬-৩১/১২/২০১৭।
সরজমিন গিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে যানা যায়, গত ৮-১০ বছর ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে আদর্শ পাঠাগারের কার্যক্রম। তবে গত ৩-৪ বছর ধরে পাঠাগারের সব কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে এটি একটি নামসর্বস্ব পাঠাগার। যদিও এই পাঠাগারটির একসময় সোনালী দিন ছিলো। তখন প্রতিদিনই এ পাঠাগারে অনেক পাঠক আসতো। নিয়মিতই ক্রীড়া, সংস্কৃতি ও সাহিত্য চার্চ হতো। কিন্তু বর্তমানে পাঠাগারের কোন কার্যক্রম নেই। নেই কোন কার্যালয়। যেটি আছে সেটিও বন্ধ কয়েক বছর। দরজায় তালা ঝুলানো। কার্যালয়ের ভিতরেই নষ্ট হচ্ছে পাঠাগার আসবাবপত্র ও সরকারের অনুদান দেওয়া ৫শতাধিকেরও বেশি বই।
কিন্তু সরকারি নিবন্ধিত একটি পাঠাগারের এই হাল কেন? কেন সংস্কার করার কোনো উদ্যোগ নেয়নি পাঠাগার কমিটি? স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে যানতে চাওয়া হলে তারা জানান, যেদিন থেকে জহিরুল ইসলাম পাঠাগারের দায়িত্ব নিয়েছে। সেই দিন থেকে পাঠাগারের এই অবস্থা। তিনি নিজেই সব কিছুর দায়িত্ব পালন। স্থানীয় কাউকেই তিনি কোন বিষয়ে সম্পৃক্ত করেননি। কারা পাঠাগার পরিচালনা কমিটিতে আছেন। সেটিও জানেন না স্থানীয় কেউই। অনেকের অভিযোগ জহিরুল ইসলাম এই পাঠাগারকে নিজের একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। পাঠাগারের নামে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন অনুদান সংগ্রহ করে নিজেই সেগুলো আত্মসাৎ করেন। জানা যায়, গ্রন্থাগার অধিদপ্তরের ২০২০-২১ অর্থ বছরের বেসরকারি গ্রন্থগার অনুদান খাত থেকে ৪০ হাজার টাকা অনুদান পেয়েছে আদর্শ পাঠাগার। যার ৫০% অর্থাৎ ২০ হাজার টাকার বই ও ৫০% অর্থাৎ ২০ হাজার টাকা ই-ব্যাংকিং এর মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে । এছাড়াও ভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অধিদপ্তর থেকে অনুদান পেয়েছে আদর্শ পাঠাগার। এবং বই বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্য একটি ভ্রাম্যমাণ ভ্যানও পেয়েছে পাঠাগারটি। তবে বর্তমানে ভ্রাম্যমাণ ভ্যানটি পড়ে আছে পরিত্যক্ত অবস্থায়। ভ্যানটি কখনোই ব্যবহার করা হয়নি জানায় স্থানীয় বাসিন্দারা। কে এই জহিরুল ইসলাম? জানা যায়, মাতৈন আদর্শ পাঠাগারের পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক তিনি। এছাড়াও একই গ্রামে অবস্থিত সরকারি নিবন্ধিত শামসুল হক স্মৃতি পাঠাগারেরও সভাপতি তিনি। একজন মাত্র মানুষ দু’টি নিবন্ধিত পাঠাগারের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছে। দুটি পাঠাগারেই প্রতিবছর সরকারের বিভিন্ন দপ্তর থেকে অনুদান পাচ্ছেন।
অথচ সরকারি নিবন্ধিত আর্দশ পাঠাগারের বেহাল দশা, নেই কোন কার্যক্রম। নামসর্বস্ব এসব পাঠাগারের নামে অনুদান নিয়ে কি করছেন জানতে চাওয়া হলে আদর্শ পাঠাগারের সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম বলেন, আমাদের বিভিন্ন খরচ আছে না। সেসব খরচ করি। গত কয়েক বছর ধরে তো পাঠাগারের কোন কার্যক্রম নেই তাহলে কিসে ব্যয় অর্থ? জানতে চাইলে তিনি বলেন,
আমরা মানুষকে সাহায্য সহযোগিতা করি। ঈদে সেমাই চিনি দেই। রমজানে ইফতার দে। গরিব মানুষকে সহযোগিতা করি। এই সব জাগায় ব্যায় হয় না? সরকারের দেওয়া আসবাপত্র ও মূল্যবান বই নষ্ট হচ্ছে এইগুলো সংরক্ষণ করা হয় না কেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, সংগঠন করেও ঠেকছি৷
অনুসন্ধানে জানা যায়, জহিরুল ইসলাম অর্ধডজন নামসর্বস্ব সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। এই নামসর্বস্ব সংগঠনের নামে সরকারি বিভিন্ন দপ্তর থেকে অনুদান ও সাহায্য সহযোগিতা সংগ্রহ করেন। সেই সব অর্থের বেশির ভাগই নিজে আত্মসাৎ করেন। তারই একটি নামসর্বস্ব সংগঠন আর্দশ পাঠাগার।
চাঁদপুর জেলা সরকারি গণ-গ্রন্থাগারের সহকারী লাইব্রেরিয়ান উম্মে রায়হান ফেরদৌস বলেন, অনুদানের বিষয়টা গণ গ্রন্থাগার অধিদপ্তর দেখে। তবে আমরা জেলা প্রশাসনের সাথে ভেরিফাই করে একটা রিপোর্ট দেই। আমরা জানি না আসলে কীভাবে তারা অনুদান পায়। আর এভাবে বইগুলো নষ্ট করা এটা তো ঠিক না। তবে আমরা বিষয়টা দেখবো। এই বিষয়ে হাজীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার রাশেদুল ইসলাম বলেন, বিষয়টা নিয়ে আমি খোঁজ নিচ্ছি। এ বিষয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) বশির আহমেদ বলেন, এই বিষয়ে আমার কোন কানেক্টিভিটি নাই।