নজরুল ইসলাম আতিক:
খাদ্যের দাম বৃদ্ধি এবং ডাকাতিয়ার পানি দূষণের কারণে বিলুপ্তির পথে এগোচ্ছে চাঁদপুরের ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষ প্রকল্প। ইতিমধ্যে পুঁজি হারিয়ে অনেক চাষি বন্ধ করে দিয়েছে এই চাষাবাদ। চাষীদের দাবি, পানি দূষণের ফলে মারা যাচ্ছে চাষকৃত মাছ। এতে আর্থিকভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ তারা।
সংকট মোকাবেলায় অতি দ্রæত কার্যকর কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হলে অচিরেই বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে সম্ভাবনাময় এই শিল্পের। তাই দ্রæত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার দাবি তাদের। অপরদিকে মৎস্য অধিদপ্তর বলছে, সমস্যা সমাধানে কাজ চলছে। পানির নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে।
২০০২ সালে দেশে সর্বপ্রথম চাঁদপুরের ডাকাতিয়া নদীতে শুরু হয় ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষ পদ্ধতি। চাঁদপুরে নদীতে শুরু হওয়া এই পদ্ধতিকে বলা হয় বাংলাদেশের মডেল। অন্য সকল পদ্ধতির চেয়ে বেশী সাশ্রয়ী, সুবিধাজনক এবং লাভজনক হওয়ায় অনেক উদ্যোক্তাই শুরু করেন এই পদ্ধতিতে মাছ চাষ।
জানা যায়, ২০১০ সালের ২৫ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চাঁদপুর এলে তিনি হেলিকপ্টার থেকে ডাকাতিয়া নদীর উপর খাঁচায় মাছ চাষ প্রকল্প দেখেন। এভাবে মাছ চাষের সম্ভাবনা ও লাভজনক দিকগুলো সম্পর্কে তাৎক্ষণিক অবহিত হন তিনি। এর পরপরই দেশের সব নদী অঞ্চলে খাচায় মাছ চাষের বিস্তার ঘটানোর জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন।
জেলা মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০০২ সালে ডাকাতিয়া নদীতে ১২টি খাঁচায় পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হয় এই চাষাবাদ পদ্ধতি। এতে ব্যাপক সাফল্য পেয়ে ২০০৫ সাল থেকে বিস্তার ঘটে মাছ চাষের এই পদ্ধতির। এর পরেই চাঁদপুরকে মডেল ধরে নরসিংদী, সিরাজগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় শুরু হয় খঁাঁচায় মাছ চাষ কার্যক্রম। তবে চাঁদপুরের সেই মডেল চাষাবাদ এখন হুমকির মুখে।
সদর উপজেলার রঘনাথপুর এলাকার বাসিন্দা আলমগীর গাজী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে চাকুরী জীবন শেষে ২০০৫ সালে ৭টি খাঁচা দিয়ে নিজ এলাকায় ডাকাতিয়া নদীতে শুরু করেন ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষ। শুরুতে ভালো লাভ পান তিনি। লাভজনক হওয়ায় বাড়ান খাঁচার সংখ্যা। ২০১০ সালের মধ্যে তার মাছের খাঁচার সংখ্যা বেড়ে হয় দুই শতাধিক। কিন্তু গত কয়েক বছর যাবত মাছের খাদ্যের দাম কয়েক ধাপে বৃদ্ধি ও ডাকাতিয়ার পানি দূষণে ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছেন তারা।
আলমগীর গাজী বলেন, প্রথম দিকে ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষ করে ভালো লাভবান হয়েছিলাম। আমার দেখাদেখি এই এলাকার অনেকেই এই পদ্ধতিতে মাছ চাষ শুরু করেন। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে নদীর পানি দূষণের ফলে চাষকৃত মাছ মারা যাচ্ছে। একটি খাঁচায় যে পরিমান মাছের পোনা দেয়া হয় তার অর্ধেক মাছও এখন বাঁচে না। তাছাড়া মাছের খাদ্যের দামও বেড়েছে কয়েকগুণ বেশি। এতে লাভের বদলে আমাদের লোকসান গুনতে হচ্ছে অনেক। টানা লোকসান দিয়ে অনেক চাষীই বন্ধ করে দিয়েছে মাছ চাষ করা। আমি নিজেও কমিয়েছি খাঁচা। আমার ২শ খাঁচার মধ্যে বর্তমানে খাঁচা আছে মাত্র ৬৫টি। বাকিগুলোতে নদী থেকে তুলে পেলেছি। এভাবে লোকসান হলে সামনে হয়তো সেগুলোও তুলে ফেলে বন্ধ করে দিতে হবে চাষাবাদ।
মৎস্য চাষীরা জানায়, ড্রামের ওপর লোহার পাইপ ও জাল দিয়ে তৈরি বিশেষ খাঁচায় চাষ হচ্ছে মনোসেক্স তেলাপিয়া। দিনদিন তেলাপিয়ার চাহিদা বাড়ায়, এ পদ্ধতির মাছ চাষে ঝুঁকেন অনেক বেকার যুবক। স্বল্প খরচে অধিক লাভ হওয়ায় দ্রæত প্রসার ঘটে এই শিল্পের। এক পর্যায়ে ডাকাতিয়া নদীর দীর্ঘ ১০ কিলোমিটার এবং মেঘনা-ধনাগোধা নদীর ৩ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে দুই পাড়ে চার শতাধিক চাষী প্রায় ৭ থেকে ৮ হাজার ভাসমান খাঁচায় ভাসমান মাছ চাষ করতেন। কিন্তু মাছ চাষে এখন আর লাভ না হওয়ায় বর্তমানে খাঁচার সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় দুই হাজারে।
বাচ্চু গাজী, মেহেদী হাসান ও কবির সহ ডাকাতিয়ার এমন কয়েকশ চাষী পুঁজি হারিয়েছেন অনেকেই। আর বর্তমানে যারা চাষাবাদ করছেন, তাদেরও অবস্থা খারাপ। চাষী কবির বলেন, আমার আগে ১২০টি খাঁচা ছিলো বর্তমানে আছে ৬০টি। এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে সব খাঁচা নদী থেকে তুলে ফেলবো। কারণ ইতোমধ্যে খাদ্যের দোকানে লাখ টাকা দেনা হয়েছি। আর পারছিনা।
রগুনাথপুর এলাকার চাষী বাচ্চু গাজী, মেহেদী হাসান বলেন, খাদ্যের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি পানি দূষণের ফলে এখন বিশেষ করে বর্ষায় মাছ মারা যায় বেশি। এতে অনেক টাকা লোকসান হয় আমাদের। তারা বলেন, ১০ ফিট বাই ২০ ফিট প্রতিটি খাঁচায় ৫শ পিস মনোসেক্স তেলাপিয়া মাছের পোনা ছাড়া হয়। প্রতি পিস মাছের পোনার দাম পড়ে ১০ থেকে ১৫ টাকা করে। এসব মাছ ৭ থেকে ৮ মাসের মধ্যে ৬শ থেকে ৭শ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে। এই সময়ে প্রতিটি খাঁচায় ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকার খাদ্য খাওয়ানো হয়। কিন্তু বিক্রি করার উপযুক্ত সময় পর্যন্ত এসে মাছ মরে আমরা ২শ থেকে আড়াইশ পিস মাছ পাই। আগে যেখানে ১ কেজি তেলাপিয়া উৎপাদন করতে আমাদের খরচ পড়তো প্রায় দেড়শ টাকা, এখন খরচ পড়ছে প্রায় ১৮০টাকা। আমরা বিক্রিও করছি কেজি প্রতি ১৭০ থেকে ১৮০টাকায়। এতে আমাদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। তাই অনেক চাষীই তাদের খাঁচা তুলে নিয়েছে।
তারা বলেন, আগে যেখানে ২০ কেজি ওজনের খাবারের বস্তার দাম ছিলো ১০৫০ টাকা, তা এখন ১৩০০ টাকা। আর ২৫ কেজি ওজনের খাবারের বস্তা ছিলো ১৪৪০ টাকা যা এখন কিনতে হচ্ছে ১৭০০ টাকায়। যার মধ্যে গত ৬ মাসে কয়েক ধাপে কেজি প্রতি ১৫ থেকে ১৬ টাকা বেড়েছে। এদিকে খাবারের দাম কয়েকগুন বৃদ্ধি পেলেও মাছের দাম আগের মতোই আছে। তার উপর মারা যাচ্ছে চাষকৃত মাছ। এতে আমরা এখন আর লাভের দেখা পাইনা।
চাষীরা বলেন, আগে যেখানে ৪ শতাধিক চাষী ৮ সহস্রাধিক খাঁচায় মাছ চাষ করতো। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৫০ থেকে ৬০ জনে। খাঁচাও আছে মাত্র দুই হাজারের মত। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই তাও বন্ধ হয়ে যাবে। এখনই কোন কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা না হলে বিলুপ্ত হয়ে যাবে এই চাষাবাদ পদ্ধতি। এতে দেশে আমিষ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি অনেকেই বেকার হয়ে পড়বে। খাঁচায় কাজ করা শ্রমিক বাতেন মিয়া বলেন, আমরা অর্ধশতাধিক শ্রমিক মাছের খাঁচায় কাজ করে সংসার চালাতাম। কিন্তু বর্তমানে খাঁচায় মাছ চাষে চাষীরা লভবান না হওয়ায় অনেকেই বন্ধ করে দিয়েছেন চাষাবাদ। এতে অনেক শ্রমিক কর্মসংস্থান হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন। এখন আমরাও বেকার হওয়ার শঙ্কায় রয়েছি।
এ ব্যাপারে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. গোলাম মেহেদী হাসান বলেন, বর্তমানে মাছের খাদ্যের দাম কিছুটা বেশি। এই কারণে আগের মত লাভবান হতে পারছেন না চাষীরা। তবে অন্যান্য জায়গার নদী দূষণের মত চাঁদপুরে পানি এতো দূষিত নয়। চাষাবাদকালে বিভিন্ন কারণে কিছু মাছ মারা গেলেও তা খুব বেশি নয়। তবে তাদের দাবির প্রেক্ষিতে আমরা ও চাঁদপুর নদী কেন্দ্রের বিশেষজ্ঞ দল ডাকাতিয়ার পানির নমুনা সংগ্রহ করেছি। রিপোর্ট আসলে বুঝা যাবে মূল কারণ।
তিনি বলেন, বর্তমানে লাভ কিছুটা কম হওয়ায় সাময়িকভাবে কিছু চাষী খাঁচা তুলে রাখছেন। খাঁচায় মাছ চাষ কার্যক্রম টিকিয়ে রাখতে চাষীদেরকে কম সুদে ঋণ দেয়ার জন্য আমরা ব্যাংক কর্মকর্তাদের প্রতি আহŸান জানান তিনি।
জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের দেয়া তথ্য মতে, বর্তমানে চাঁদপুরে ২ হাজার ভাসমান খাঁচায় বছরে উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় সাড়ে ৫শ মেট্রিক টন তেলাপিয়া মাছ। যা চাঁদপুরের স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে পাশ^বর্তী কুমিল্লা, ল²ীপুর, নোয়াখালী, শরীয়তপুরসহ বিভিন্ন জেলায় বিক্রি করা হয়।