ইকবাল পাটওয়ারী স্বপন :
করোনা আতঙ্কে চাঁদপুরের পোল্ট্রি শিল্পে ধ্বস নেমেছে। বিশেষ করে আর্থিক সংকটের কারণে খামারে মুরগি তুলতে পারছে না চাষিরা। যদিও আগেই লস গুনতে গুনতে নিঃস্ব হয়েছে অনেক চাষী। দফায় দফায় পুঁজি হারিয়ে অনেক খামার এখন বন্ধ। তাই করোনাকালীন সময়ে বাজারে বেড়েছে মুরগির দাম। বর্তমান সময়ে মুরগির চাহিদার তুলানায় যোগান কম হচ্ছে। তাই কেজি প্রতি দাম বেড়েছে ৩০-৪০ টাকা। এসব খামারিদের দাদন বা পূঁজি দিয়ে সহযোগিতা করে থাকে ফিড ব্যবসায়ীরা। টাকা আটকে যাওয়ায় তারাও এখন আর্থিক যোগান দিতে হিমশিম খাচ্ছে। তাই পোল্ট্রি শিল্পে তৈরি হয়েছে সংকট।
চাঁদপুরের বেশ কিছু খামার ঘুরে দেখা যায়, কিছু খামারে অল্প পরিমানে মুরগি রয়েছে। আবার কোথাও কোথাও অনেক সেড বন্ধ। সর্বশেষ ঝূঁকি নিয়ে অনেকেই সপ্তাহ খানেক হলো ধার দেনা করে সেডে মুরগি তুলেছেন। অথচ এখনো ডিলারদের কাছে লাখ টাকা ঋণ পড়ে আছে। ঋণ থেকে মুক্ত হতে পারছে না খামারিরা। বাজারে মুরগির দাম বেশি দেখা গেলেও এ লাভ পাচ্ছে অল্প কিছু খামার মালিক। যাদের কিছু মুরগি ছিলো সেগুলোই এখন বিক্রি করা হচ্ছে। কিন্তু করোনায় মুরগির বাচ্চা না তুললেও এখন আবার অনেক খামারি ঋণ কর্জ্য করে বাচ্চা তুলছে। তাই হয়তো মাসখানেক পরেই আবার মুরগির উৎপাদন বেড়ে যাবে। তখন এসময়ের মতো দাম নাও পাওয়া যেতে পারে বলে বলে আশঙ্কা করছে খামারিরা।
খামারী মোঃ হারুন খান জানান, আমি প্রায় দশ বছর পোল্ট্রি শিল্পের সাথে জড়িত। বর্তমানে ২হাজার করে ৫টি খামারে মোট ১০হাজার মুরগী রয়েছে। ২০১৯-২০২০ সালে বছরে ৮টি হ্যাচ করছি। মাত্র ২টি হ্যাছ লাভ হয়েছে কিনা সন্দেহ। দুই হ্যাচে লাভ হলেও অন্য হ্যাছে লাখ লাখ টাকা গচ্ছা দিতে হয়। এবছর বার্ড ফ্লুতে অনেক মুরগি মারা গেছে। তিনি আরো যোগ করে বলেন, বর্তমানে তার ৫হাজার সোনালি (কক) মুরগি আছে। যার বয়স ৬০দিন, গড় ওজন ৮শ গ্রাম। ব্রয়লার ৩হাজার আছে যার বয়স ৩০দিন, গড় ওজন ১৬শ গ্রাম। বর্তমান বাজারে সোনালি খুচরা মূল্য ২৮০টাকা কিন্তু আমি দাম পাই ২২০-২৩০টাকা বাকি ৫০থেকে ৬০টাকা কোথায় যায়? সরকার যদি এর দামের নীতিমালা করতো তাহলে আমরা আরো কিছু দাম পেতাম।
অপরএক খামারি আলমগীর বেপারী জানান, আমি দুই দফায় প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা লস গুনেছি। এখন আবার ধার দেনা করে মুরগির বাচ্চা তুলেছি। জানি না ভাগ্যে কি আছে?
চাঁদপুরে ব্রয়লার, লেয়ার ও সোনালীসহ প্রায় ১২শ খামার রয়েছে। এসব খামারে কাজ করছে অন্তত দুইহাজার শ্রমিক। খামার বন্ধ হওয়ায় শ্রমিকরাও আছে আতঙ্কে। বেশ কয়েকজন শ্রমিক জানায়, প্রতিবছরই খামার মালিকরা লস গুণে। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের চাকুরি থাকা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।
চাঁদপুরের খুচরা বাজার ও খামার ঘুরে দামের খুব তরতাম্য দেখা যায়। খামারে ব্রয়লার মুরগি ১০৫টাকা কেজি বিক্রি হলেও খুচরা বাজারে ৪০-৪৫টাকা বেশি বেশি বিক্রি হচ্ছে। সোনালী মুরগির ক্ষেত্রেও ২৩০ টাকা কেজি খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৭০-২৮০টাকা। খুচরা বিক্রিতরা বলছে, তারা কেজি প্রতি ১৫-২০টাকা লাভ করে। তাহলে মাঝে যে ১৫-২০টাকার ব্যবধান। সে টাকা যাচ্ছে কোথায়? এসব নিয়ে কথা বলতে যোগাযোগ করা হয় চাঁদপুর জেলা পোল্ট্রি ফিড ডিলার এশোসিশেনের এর নেতাদের সাথে। তারাও বলছে, চাঁদপুরের পোল্ট্রি শিল্পে সংকটকাল চলছে। অনেক খামারি নিঃস্ব হয়েছে। এতে ডিলাররাও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
চাঁদপুর সদর উপজেলা পোল্ট্রি ফিড ডিলার এশোসিয়েশনের আহ্বায়ক কবির হোসেন খান জানান, খামারিরা ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় আমাদের টাকাও দিতে পারে না। তাই আমরাও আর ওইভাবে খাদ্য বাচ্চা দিতে পারি না। খামারে খাদ্য-বাচ্চা কম ঢুকার কারণেই এখন মুরগির দাম কিছুটা বাড়তির দিকে।
চাঁদপুর জেলা পল্ট্রি ফিড ডিলার এশোসিয়েশনের সভাপতি টিটু সরকার জানান, আমরা বিভিন্ন সময়ে খামারিদের অর্থনৈতিক ভাবে সহযোগিতা করি। খামারিদের কাছ থেকে আমাদের পূঁজি ফিরে না আসার কারণে অর্থনৈতিক ভাবে অনেক ক্ষতিগ্রস্থ। এখন নতুন করে খামারিদের যে আবার পূঁজি দেব সে সামর্থও আমাদের নাই। এখন খামারীদের সরকারি প্রণোদনা দেয়ার উপযুক্ত সময় বলে জানান তিনি। না হয় অচিরেই পোল্ট্রি শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে।
মূলত করোনা আতঙ্কে অনেক খামারি মুরগির বাচ্চা তুলেনি। যেকারণে বাজারে মুরগির দাম কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানালেন মৎস্য ও প্রাণী সম্পাদক কর্মকর্তা ডাঃ মোঃ বখতিয়ার উদ্দীন। তিনি বলেন, চাঁদপুরে ১১শ ২৫টি মুরগি খামার রয়েছে। এর মধ্যে ৫শ১০টি নিবন্ধিত এবং অনিবন্ধিত আছে ৪শ ৮৯টি। ১৫২টি লেয়ার বাকীগুলো ব্রয়লার খামার। বর্তমানে বন্ধ আছে শতাধিক খামার।
সচতন মহলের ভাষ্য মতে, এককেজি ওজনের একটি মুরগির উৎপাদন খরচ হচ্ছে ১২০ টাকা কিন্তু কখনো কখনো খামারী পায় ৯৫ থেকে ১০৫ টাকা সর্ব্বোচ্চ। কিন্তু ভোক্তা পর্যায়ে তার দাম ১৪০-১৬০ টাকা। এ পরিসংখ্যান খুব সহজেই বোঝা যাচ্ছে পোল্ট্রি শিল্পের বর্তমান অবস্থা। আজ যে পল্ট্রি শিল্পের সঙ্গে জড়িত খামারি লাভজনক মূল্য না পেয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, সে দিকে কারো নজর নেই।
একটি জরিপে জানা যায়, ২০২১ সালের মধ্যে বছরে ১২শ কোটি ডিম ও ১শ কোটি কেজি ব্রয়লার উৎপাদন সম্ভব। ১২হাজার কোটি টাকা রপ্তানির সম্ভাবনা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে এ শিল্প। সামগ্রীক ভাবে গবেষণা করে দেখা যায়, ত্রিমুখী সমস্যার চরম দুর্দিনে পড়েছে পল্ট্রি শিল্প। যার খেসারত দিচ্ছে তৃণমূল খামারীরা। সময় এসেছে যুগোপযোগী পদক্ষেপ নেয়ার।