চোখটা কচকচ করছে আদিবের। পিনপড়া শব্দেও তার ঘুম আসে না ; রাতজাগা প্রাণী সে। আজ ঘনঘন চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। সামনের দিকে নজর দিতে পারে না। ডানে বামে ধুঁকে পড়ছে বারবার । অনেক দুঃশ্চিন্তা মনে ওজন ধরেছে কারণ গত কয়েক মাসে বায়বীয় খুন বেড়েই চলছে। সারাদেশে পায়ে পায়ে লাশের চিহ্ন দেখা যায়। তার নিজেরও ভয় পাক ধরেছে তবুও ধড়ের জোরে সময়কে কিস্তি করে করে আগলে আছে সে।
ধুঁকে ধুঁকে ঘুম ধাক্কা দিতে লাগল। খাটের পাশ থেকে ঠেক সরিয়ে মাথা রাখলো বালিশের উপর। রাখতে না রাখতেই নাকের হুইসেল শুরু হয়ে গেল। আসে পাশে কারো উপস্থিতি নেই; নইলে সিগন্যাল বসিয়ে ভ্রাম্যমান মামলা করে জরিমানা হিসেবে সারারাত বসিয়ে রাখার বিহিত করা হতো। সে মামলা জড়ায়নি বলে ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেল সে। এর আগে মামলার হুমকী অনেকবার খেয়েছে। কিন্তু রাজসাক্ষীর অভাবে আদালত কিছুই করতে পারেনি। সে মনে করে মনই একটা আদালত, মনের আদালতে দুটি প্রাণী ধড়পড় করে এগিয়ে যায়। সে আদালতে মিহি মনের উঁসখুঁস আছে। এ নাকি হলো জীবনসংসার। কেউ কেউ বলে আদালতি জীবন।
সংসারজীবনে বাদী স্বামী ও বিবাদী স্ত্রীদের অভিমানলিপি কে না জানে? যে একবার যুগল মামলা খেয়েছে তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গেলে অন্যজন বলে-সে কথা বলবেন না ভাই! তবুও সমাঝোতা কাঁধে তুলে মান অভিমানের পথ ধরে হেঁটে হেঁটে জীবনরাস্তা পাড়ি দিতে থাকে। বিবাদী খিটখিটে হলেও মায়ার কারণে মেজাজে ঝং ধরে তাই বারবার বাদীপক্ষের কাছে বরফের মত গলতে গলতে সব ভুলে যায় এবং বাদীর পাশেই নেতিয়ে পড়ে। এতে নাকি সুখের হাততালি রয়েছে। তবে একটু খুনসুটি হলে বরাবার বলে ওঠে মহামান্য আদালত – তার মত এমন পৃথিবীতে দ্বিতীয় পিচ নেই। বাদী এসবে মন খারাপ করে না ; কারণ দ্বিতীয় হবে কেন? সৃষ্টির নিঁখুত তা হয় নাকি? সে হলো সম্পূর্ণ আলাদা, ওয়ান পিচ অফ লাইফল্যান্ড? তাই হয়তো তাকে মাইন্ডল্যান্ড থেকে সরাতে পারছে না।
আদিব নতুন যুগলদের সাথে মেশে বেশি কারণ এরা আমোদপ্রিয় হয়ে থাকে । তাই এমন কত গল্প সে অনেকের কাছে শুনেছে কিন্তু চ্যাঙরা পোলা মাথায় প্রেমই উজবুক খেলে ওসব টীকামূলক কথা তাকে রোখাতে পারেনি। তাই মামলা যা হোক বিবাদী ছাড়া মনের আদালতে বিচার জমে কী? মনে গেঁথে আছে কোন এক বিবাদীর শরীর। সে শরীরের নাম সে জানে না। তবে দেখে মাঝে মাঝে মধ্য রাতেও তার মনকে চ্যাঙদোলা করে রাখে। সে বায়বীয় আলাপ করে। তাতেই দম দৌড়ে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিতে থাকে।
সব জায়গায় আদিবের গাড় তেড়া থাকলেও তার মিহিআলাপে বিড়াল হয়ে ওঠে সে। সে তো হাজার হাজার মাইল দূরে। দূর থেকে এত প্রেসার ওঠায়; কাছে আসলে তো মাখন করে দেবে। আস্তে আস্তে আদিবের কেশরাজ লাফাতে থাকে। পারে না মধ্য মধ্যরাতে অশ্বারোহী হয়ে তাকে মনশালায় নিয়ে আসে। কিন্তু সব শরীর কী বন্দী করা যায়? কারণ সে ষোড়শী তার কোমর নিকলি হাওড়ের মত বাঁক ফিরে ছুটে বেড়ায়। তার পেছনে কচি পোলাপান কুকুরের মত ঘেউ ঘেউ করে। তার প্যাচের শরীর; আদিবের পক্ষে মোচড় দেয়া অনেক কঠিক। তবুও চেষ্টা বেখেয়াল করেনি। তার মুখ হলো অমৃতবচন এ্যাপস তা চালু করলে পটকা মেয়েরাও একবার কানের কাছে এসে লিপস্টিকের ঘ্রাণ দিয়ে যায়। মেয়েরা নাকি বাঁকা আসবাব, তাই আর্ট করেই পাশে বসতে হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে বাঁকানোতে খাঁপ খাওয়ানো জটিলও বটে। তবুও চেষ্টা করতে দোষ কী? আদিব থেমে নেই চেষ্টা শুরু করল। কল্পনার ভেতরে প্রেমতরু খুঁত খুঁত করছে এবং বুকের কুটুরি প্যাচাতে শুরু করল। ঘুমটা জটিল ; ঘুমই তার উপস্থিতি জানান দিয়ে থাকে। না হলে মেয়েদের জীবন দর্শনচর্চা করা সম্ভব হতো না; পুরুষের ঘুমই নারীর জীবনদর্শনের শ্রেষ্ঠ সময়, আবার ঘুমন্ত নারীর পাশে পুরুষই হলো মহান দার্শনিক। কথাটা মন্দ না কেননা আজকের ঘুমই তার কাছে বড় প্রমিতি হয়ে দেখা গেল।
আদিবের আবার এক কথা। সজাগ থাকলে যা দেখে ঘুমালে তার চেয়ে বেশি দেখতে পায়। তাই ঘুমের ভেতরে সময়টা বেশ দাগ কাটে তার। ঘুম ক্লান্তি বিদায় করে নতুনভাবে জেগে উঠতে সাহায্য করে। তাই যতকিছুই হোক না কেন ঘুমটা তার নিয়মিত চাই।
চারপাশ নিস্তব্দ। হঠাৎ পায়ের পটপট শব্দ শোনা গেল। অচেনা মানুষের শব্দ কিন্তু সে তার দিকে আসছে এটা সে নিশ্চিত হয়ে গেল। হ্যাঁ সে সামনে এসে দাঁড়াল, আদিব ডান কাত থেকে বাঁদিকে ঘুরে দ্বিতীয় পশলা ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগল। মাথার কাছে মানুষ বসার শব্দ পেল এবং তার একটা হাত চুলের ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে ছুটতে লাগল। দীর্ঘদিনের বিরতি থাকায় তার চুলগুলো বেশ ঝুপড়ি হয়ে উঠেছে। তার ভেতরে টুপটুপ চলতে লাগল কারও আঙুল। মসৃণ স্পর্শে শরীরে বসন্তদিনের মত শিরশির করতে লাগল। মন ছুটতে লাগল দখিণা বাতাসের নিঁখুত হাওয়ার তালে তালে। সে বুঝতে পারছে না কেমন অনুভূতি তাকে আঁকড়ে ধরছে। সে মুখোমুখি এসে বলল, উঠো এত ঘুম কেন? তোমারে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। যাহ! আমি তোমার সাথে থাকিওনা। এই… এই… না কেন? একটু সময় দিবে তো? এই তো মাত্র ঘুমালাম! কণ্ঠস্বর থেমে গেল। আদিবের শরীরের অনুভূতিও ছুটি নিতে লাগল।
আদিব নড়ে উঠল এবং দুহাত উচিয়ে হাই তুলতেই কচি হাত গিয়ে পড়ল আরেকটি শরীরের উপর। এ কী? কার শরীর, সে কী আছে? তার শরীর অনেক গরম। রাতের বৃষ্টির পর হালকা ওম পাওয়া গেল। এসময় স্পর্শ করলে যেমন ভালো লাগে ঠিক তেমনি তার ভালো লাগতে শুরু করল । কিন্তু হাত কোথায় লাগল ঠিক সে মনে করতে পারলো না। ঘুম ভেঙে গেল এবং খাটের চারপাশে হাতড়াতে লাগল কিন্তু কী অদ্ভুত কারো ছায়া দেখতে পেল না। আবছা হলদে রঙের ওড়না দেখলেও তার নাগাল পেল না। তবে শরীরের গন্ধ নাকে আসতে লাগল যত সামনে এলো মনে হলো এমাত্র সে চলে গেছে। সবগুলো লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে সব রুম তল্লাশি দিয়ে আবার বিছানায় শুয়ে পড়ল। আহ ঘুমটাই তো ভালো ছিল।
আবার ঘুম চলে আসল। ঘুমের ভেতরে সে পথের পর পথ হাঁটতে লাগল। সামনে মেয়েদের হল। চোখ উপরে তুললেও চোখ নামিয়ে সামনের মোড় পার হয়ে গেল। মোড়ে এলোমেলো রিক্সা, দুচারটে ভুং ভাং ছেলেরাও ফুং ফাং করছে। আদিব শান্ত স্বভাবের ছেলে হিসেব করে পা রাখে পথের উপর কারণ তার পথে অনেক জট আছে, তাকে জট খুলে খুলে গন্তব্য ধরতে হবে। পৃথিবীতে সবাই জটমুক্ত হয়ে জন্ম নেয় না; কারো শরীরেই থাকে জট। তাই তাকে মাড়িয়ে মাড়িয়ে তৈরি করতে হয় জীবনের রাস্তা।
রাস্তা অনেকদূর। হাঁটতে মন্দ লাগছে না। একটা বযসে পকেটে হাত রেখে হাঁটতে ভালো লাগে। নিজেকে অভার স্মাট মনে হয়। মেয়ে দেখলে শরীরে বাইভ্রেশন শুরু হয়। আর মেয়েরা ছেলে দেখলে তাদের কোমরে নদীর মত জোয়ার আসে আঁকাবাঁকা হয়ে ছুটে বেড়ায়। সময়ের সাথে সাথে দু পক্ষেরই হিসেবটা অন্যরকম থাকে।
আদিব তো সে বয়সেরই ছেলে। সামনের দিকে হাঁটছে, মাথায় খুঁত খুঁত করছে কারও ছায়া। সে স্বল্প পরিচিতা তাকে মনে হয় যেন ছাত্রী হলের তিনতলায় দেখেছিল। যতটুকু মনে হয় চশমাটা বেশ পরিচিত। যা হোক এসব এখন ভেবে লাভ নেই, পথের কয়েকটা মোড় এখনও বাকি পেছনে ফিরে গেলে বাড়ি ফেরা হবে না; সে হলের সিট ছেড়ে দিছে গত মাসে। শহরে থাকার জায়গা নেই অতএব বাড়ি না গেলে নতুন কর্মস্থলে আজ রাতেই ফিরতে হবে তাকে। তাই ফিরতি টিকেটটা আরেকবার চেক করে নিয়ে হাত রাখলো বাঁ পকেটে। কল বেজে উঠল, অচেন কণ্ঠস্বর-কোথায় যাচ্ছেন? প্রশ্ন শুনে মনে হল। আশেপাশে থেকেই কেউ জানতে চাচ্ছে। চারদিকে চোখ পাকিয়ে চট করে উত্তর করল, কে আপনি? তা জানা দরকার নেই। মানে বুঝলাম না। আচ্ছা-আজিব তো!
এই তো সামনে যাবো? ওয়েট আমি আসছি! আদিবের গলা কাঁপতে লাগল, মানে কী? হ্যাঁ আমি আসছি। আদিব বলল, আপনি কে? নাম বলুন। সে হেসে উঠে বলল, বলতেই হবে? হ্যাঁ বলুন। ধরে নিন অনুগতা। এ আবার কী নাম…
লাইন কেটে গেল। মন ঠোকাতে লাগল। আবার কল বেজে উঠল, কী দাঁড়িয়ে আছেন কেন? কেউ আসবে? না না কেউ আসবে না। আপনি কে বলছেন বলেন তো? আমাকে চিনবেন না! হলের সামনে ফাস্টফুড দোকানে চেনেন! হ্যাঁ চিনি কেন? ওখানে আসেন! এবার আদিবের মুখটা শুকিয়ে গেল। কোনদিন কোন মেয়ে এভাবে সম্বোধন করেনি আজকের সম্বোধন দেখে সে চমকে গেল এবং বলতে লাগল বিষয়টা কি বলুন তো! লাইন কেটে গেল। আদিব ঘুরে এসে ওখানে দাঁড়াল। গত কয়েকদিন আগে সে মাথা ন্যাড়া করেছে। সূর্য পশ্চিমের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। কচকচে রৌদ্র ঠিকরে পড়ছে তার লালশার্ট ও মাথার উপর তবুও হেঁটে হেঁটে ফাস্টফুডের দিকে এগিয়ে গেল। এসময় হলের চারতলায় একটা খটখট শব্দ শোনা গেল! মেয়েদের কণ্ঠ শুনলে পাথরের চোখও কচকচ করে ওঠে। সেসময় পথিক তেমন ছিল না। একটা রিক্সা যাচ্ছিল তাতে বসা ছিল মধ্যবয়সী উকিল। মনে হয় আদালত থেকে মক্কেলের কল পেয়ে চেম্বারে ফিরছে। তাড়া আছে লোকটার তবুও তার দৃষ্টি গিয়ে ঠিকল চারতলার গারদে। আবিদের চোখ তো সেখানে ঝুলেই আছে; বর্শি স্টেনের মত বডিটা আছে রাস্তার ধারে। বেশি দেরি হলো না ! পকেট গেট থেকে বেরিয়ে এল কয়েকজন মেয়ে। যাদের হাতে খাতা এবং কাঁধে ব্যাগ ঝুলছে। আদিব তাকিয়ে আছে কিন্তু এদের কাউকেই তো মনে হলো না। তাহলে সে কী খপ্পরে পড়েছে! মহা মুশকিল। শরীর ঘুরিয়ে পেছনে ফিরে আবার তাকাল। দেখে চশমা পড়া একটা লম্বা মেয়ে তাকে ফলো করে এগিয়ে আসছে এবং মিটিমিটি হাসছে। সে তাকিয়ে আছে তার চেহারার উপর। মনে হচ্ছেÑসে তার পাহারায় রাস্তা পার হয়ে সামনে এসে দাঁড়াল এবং সম্বোধন করল, কেমন আছেন? আদিবের বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল তবুও চোখ অবিশ্বাস করে কী করে!
বেশ! তুমিই তাহলে! মেয়েটি মিটমিট হাসতে লাগল। তারপর দোকানে ঢুকেই বলল, কী খাবেন! তুমি কী খাবে? না আমি কিছু খাবো না। খাবার নিয়ে যাবো? আপনি কী খাবেন? এ কী গরম। আইস্ক্রিম খেতে পারি। আইস্ক্রিম খেতে খেতে মেয়েটির পেছনের চুলগুলো মাপঝোঁপ করছিল সে। অন্যমেয়েদের তুলনায় তার চুলের ভাঁজ অন্যরকম। চোঁখ কেমন ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। তার সওদাপাতি শেষ হলে আসি বলে সামনে পা বাড়াল। পুবালি হাওয়া এসে তার হলুদ ওড়নাকে ভাসাতে লাগলে চোখ বারবার তার স্কিনসর্ট নিতে লাগল।
ঘুম ভেঙে গেল আদিবের। চোখ খুলে দেখে জানালা খোলা; জানালা বরে গেছে সুবহে সাদেকের আলো, একটি চড়ুই পাখি জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকে আবার বেরিয়ে গেলো। আলো বেড়ে চললো সে দেখলো জলাশয়ে পাশে বাঁশের কঞ্চির উপর পা টান করে বসে আছে মাছরাঙা! হলদে রঙ চকচক করে শরীর থেকে টুপটুপ জল ঝরছে। নেতা কাক এসে তেমাথায় সঙ্গীদের জোরে জোরে ডাকছে। তাতে মানুষের ঘুম ভাঙছে। পর্দার ফাঁকে বাতাস এসে খেলা করছে রুমের ভেতর এবং ডায়রির পাতাগুলো উড়ছে টেবিলের উপর। ফ্লোরে পড়ে আছে একটা ছবি। নজর গেল তার উপর এবং ডান হাতে ছবিটি তুলে ধরল মুখের সামনে। চোখে চশমা, মাথায় হলুদ রঙের ওড়না। চিমচাম শরীরে হলদে রঙ এবং ঘ্রাণ নাককে সজাগ করছিল। রাতে এমন ঘ্রাণ পেয়েছিল সে যা শরীরের তাপ সরাতে শুরু করছিল। তাই মনকে অভয় দিয়ে আবার বালিশ মোড়া দিল সে এবং ছবিটি দেখতে দেখতে আবার ঘুমিয়ে পড়ল।