এম এ লতিফ:
খাদ্যশষ্যের উৎপাদন বাড়াতে ১৯৮৮ সালে মতলব উত্তরে বাস্তবায়ন করা হয় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মেঘনা ধনাগোদা সেচ প্রকল্প। সেচ প্রকল্পটি অধিক খাদ্য-শস্য উৎপাদনের উদ্দেশ্যে নির্মিত হলেও দীর্ঘ বছরের পুরনো যন্ত্রাংশে সেচ কার্যক্রমে ক্রমশঃ ভাটা পড়েছে। এছাড়াও সেচ প্রকল্পের অভ্যন্তরে যত্রতত্র বাড়িঘর নির্মাণ করায় প্রতিবছরই কমছে ফসলি জমি। যদিও ১৩ হাজার ৬শ ২ হেক্টর জমিতে সেচের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রায় গড়ে উঠে প্রকল্পটি। কিন্তু বর্তমানে সেই কৃষিজমি প্রায় ৩০ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ হাজার হেক্টর।
এছাড়াও সেচ প্রকল্পের অভ্যন্তরে ছোট বড় খালগুলো গেলো ৩৪ বছরেও খনন করা হয়নি। ফলে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ছেন কৃষকেরা। এমনকি সেচ প্রকল্পের অভ্যন্তরে প্রতিবছরই বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতায় প্রায় ১০ হাজার হেক্টর ফসলি জমি পানির নিচে থাকায় ফসল উৎপাদন কমেছে প্রায় ২০ হাজার মেট্রিক টন। এবারও বছরের শুরুতেই ১ জানুয়ারি সেচের পানি পাওয়ার কথা থাকলেও কৃষকরা পায় ২৫ জানুয়ারি। ফলে এবারও চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন হবে না বলে আশঙ্কা করছেন কৃষক।
যদিও মতলব উত্তর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. সালাউদ্দিন জানান, এবছর পুরো উপজেলায় সাড়ে ১২ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। এরমধ্যে সেচ প্রকল্পের ভেতরেই প্রায় ৮শ হেক্টর জমিতে এ আবাদ করা হয়। তাই এই ফসলকে বাঁচাতে গিয়েই আমরা মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ২০/২৫ দিন পরে পানি ছাড়তে বাধ্য হয়েছি। তবে আমরা আশা করছি এতে আমাদের বোরো আবাদ তেমন কোন ক্ষতির মুখে পড়বে না।
মতলব উত্তর উপজেলার এই কৃষি কর্মকর্তা আরো জানান, প্রকল্পের পূর্বাবস্থায় ধানসহ অন্যান্য শষ্যের বার্ষিক গড় উৎপাদন ছিল ২৭ হাজার ১৩৬ মেট্রিক টন। পরবর্তীতে ২০১০ সাল পর্যন্ত গড় উৎপাদন ছিল ১ লাখ ৮ হাজার ২১৯ মেট্রিক টন। কিন্তু প্রকল্পের ভেতরে ক্রমাগত নগরায়ণের ফলে ২০১৮ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৮১ হাজার ৮শ ২৩ মেট্রিক টন। বর্তমানে বোরো মৌসুমে সাড়ে ৫ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ প্রদান করা হয়। বিপরীতে সাড়ে ২৭ হাজার মেট্রিক টন ধান উৎপন্ন হয়। এছাড়াও ৩ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন আউস ও আমন মৌসুমেও সাড়ে ৩ হাজার মেট্রিক টন ধান উৎপন্ন হচ্ছে।
প্রকল্প এলাকার ওটারচর এলাকার কৃষক আতাউর রহমান ও নাউরী এলাকার শাহাজান প্রধান জানান, বোরো মৌসুমে সঠিক সময়ে আমরা পানি পাই না। ১ জানুয়ারি পানি পাওয়ার কথা থাকলেও সঠিক সময়ে না পেয়ে আমরা ক্ষতির মুখে পড়ছি। এছাড়াও এই প্রকল্পের ভেতরের সাড়ে ১৩ হাজার হেক্টর জমির মধ্যে মাত্র ৫/৬ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা পাই। অন্য জমিগুলো উচু ও ক্যানেলগুলো বন্ধ হওয়ায় স্যালো মেশিন কিংবা লো লিপট পাম্প দিয়ে পানি আনতে হয়। আর এতে আমাদের খরচ গুনতে হয় অনেক বেশি।
তারা বলেন, আমরা পূর্বে তিন ফসল ঘরে তুলতে পারলেও বর্তমানে পারছি না। শুস্ক মৌসুমে পানির সংকট ও বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানি আমাদেরকে চিন্তায় ফেলে দেয়। তাই দ্রæত সকল সমস্যা সমাধান করে সর্বত্র সেচ সুবিধা দেয়ার দাবি জানায় তারা।
১৯৮৭-৮৮ সালে মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের মূল বেড়িবাঁধটি নির্মিত হয়। এই বাঁধের দৈর্ঘ্য প্রায় ৬৫ কিলোমিটার। এই প্রকল্পের অধীনে ২১৮ কিলোমিটার সেচ খাল আছে। কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন এলাকায় বেড়িবাঁধ ও সেচ খালের জায়গা দখল করে সেখানে অবৈধ স্থাপনা ও দোকান নির্মাণ করেছেন স্থানীয় লোকজন।
স¤প্রতি মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের বেড়িবাঁধের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বাঁধের এনায়েতনগর, মমরুজকান্দি, সুজাতপুর, এখলাশপুর, বকুলতলা, মোহনপুর, বেলতলী, চান্দ্রাকান্দি, কালিপুর, ষাটনল, ছেংগারচর, বদরপুর, রামদাসপুরসহ আরও কয়েকটি এলাকার বেশ কিছু জায়গা অবৈধভাবে দখল করে দোকান ও ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এতে বাঁধটি হুমকিতে রয়েছে।
মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের পওর বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, অবৈধ দখলদারদের আমরা উচ্ছেদের চেষ্টা করছি। যদিও প্রকল্পের ভেতরে বাড়ি-ঘর নির্মাণ হওয়ায় কৃষি জমি কমেছে। এরপরও আমরা কৃষিজমি ভরাট না করার পরামর্শ দিচ্ছি। তবে পূর্বের ন্যায় পানি না পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বহু বছরের পুরনো মেশিন দিয়েতো আর পরিপূর্ণ সেবা আশা করা সম্ভব নয়। এরপরও আমরা চেষ্টা করছি, যত দ্রæত সম্ভব সমাধান হয়ে যাবে।
পাউবোর চাঁদপুর কার্যালয় ও স্থানীয় সূত্র জানায়, বোরো মৌসুমে ৭ হাজার হেক্টর কৃষি জমির মধ্যে ৫ হাজার ৬শ ১৯ দশমিক ৭৪ হেক্টর জমিতে গ্র্যাভেটি সিস্টেমের মাধ্যমে পানি সেচ প্রদান করা হয়। অবশিষ্ট ৮শ ৮৬ দশমিক ৮৬ হেক্টর জমিতে স্যালো টিউব এর মাধ্যমে কৃষক নিজেরা উত্তোলন করে। ৪শ ৯৩ দশমিক ৪০ হেক্টর জমিতে নিষ্কাশন খাল থেকে লো-লিফট পাম্পের মাধ্যমে সেচ প্রদান করা হচ্ছে।
মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্প পওর বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী কার্যালয়ের উপ-সহকারী প্রকৌশলী তন্ময় পাল বলেন, সেচ প্রকল্পের উদমদী, কালিপুর, এখলাসপুর, ডুবগীসহ মোট ৪টি পাম্প হাউজে মোট ৪৪২ দশমিক ১৯ কিউমেক পানি প্রতি সেকেন্ডে বাহির কিংবা প্রবেশ করানোর ক্ষমতা রাখে। কিন্তু সময়ের কারণে ওইসব পাম্পের ক্ষমতাও কমে যায়। বর্তমানে কিছু পাম্প বন্ধ থাকলেও অপরগুলো দিয়ে আমরা পানি সরবরাহ করছি। তবে বৈদ্যুতিক খুটি, লাইন ও মেশিনগুলো পুরাতন হওয়ায় শতভাগ সার্ভিস দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্প পওর বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী কার্যালয়ে সহকারী প্রকৌশলী মো. ফখরুল আমিন বলেন, প্রকল্পের সকল সমস্যা সমাধানের জন্য ৩৪৪ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। আশা করছি এটি চলে আসলে আমরা সেচ খাল সংস্কার, বেড়িবাঁধ সংস্কার, নদীতীর সংরক্ষণ, খাল খনন ও নতুন প্লোটিং পাম্প ক্রয় করতে পারবো। এতে করে সেচ সুবিধা পূর্বের অবস্থানে ফিরে যাবে।