‘বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই, কুঁড়ে ঘরে থেকে করো শিল্পের বড়াই, আমি থাকি মহাসুখে অট্রলিকার পরে, তুমি কত কষ্ট পাও রোদ বৃষ্টি ঝড়ে’- কবি রজনীকান্ত সেনের কালজয়ী এই কবিতার কারণেই সবার কাছে আজো অতি পরিচিত চড়ুই পাখি ও তার বাসা। কিন্তু কবিতাটি প্রতিনিয়ত মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হলেও সময় চক্রের বর্ষ পরিক্রমায় মতলব উত্তরসহ আশেপাশের উপজেলা থেকেও দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের সেই সুপরিচিত চড়ুই পাখি। সচরাচর আর দেখা যায়না চড়ুই পাখি ও তার বাসা। বাড়ির আশপাশে এক গাছ থেকে অন্য গাছে, ঝোপ-ঝাড়ে, অফিস বা বাড়ির ছাদে চড়ুই পাখির ছুটেচলা এখন অনেকটাই শুধু অতীত।
যদিও আমাদের চারপাশে ছোট-বড় নানা প্রজাতির পাখি আমরা দেখতে পাই। এদের মধ্যে মানুষের সান্নিধ্যে থাকতে যে পাখি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে সেটি হচ্ছে চড়ুই। চড়ুই পাখি আকারে অনেক ছোট। এদের গায়ের রং খয়েরী। এরা অফিস বা বাড়ির দেওয়ালের ফাঁকফোকরে বাসা বেঁধে থাকতে ভালোবাসে। তাইতো আবহমান বাংলার শোভন হচ্ছে সামাজিক বন্ধনের চড়ুই পাখি। এই পাখি ও তার বাসার সঙ্গে আমাদের দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। এরা দলবেঁধে বিচরণ করতে ভালোবাসে এবং আহারের পর একসঙ্গে বসে কিচির-মিচির শব্দে চারিদিক মুখরিত করে তোলে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে বর্তমান সময়ে চড়ুই পাখিদের আগের মত ঝাঁকবেঁধে যেখানে সেখানে থাকতে বা চলতে দেখা যায়না। শোনাও যায়না সন্ধাবেলা তাদের কিচির-মিচির শব্দ।
একটি সময় গ্রাম-গঞ্জে বাড়ির উঠান, ঘরের কোণে, বারান্দায় চড়ুইয়ের উপস্থিতি ছিল খুবই স্বাভাবিক। চড়ুইয়ের ডাকে সকাল শুরু হতো। আবার সন্ধ্যায় চড়ুইয়ের ডাকে কৃষকেরা মাঠ থেকে বাড়ি ফেরার আনন্দ পেতো। কিন্তু সমাজ পরিবর্তনের সাথে সাথে আমাদের গ্রাম-বাংলা থেকে ক্রমশ: শূন্য হয়ে যাচ্ছে দেশীয় প্রজাতির এসব পাখি। তবে আমাদের অতি পরিচিত চড়ুইসহ নানা প্রজাতির দেশীয় পাখি এখনো গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে দেখা গেলেও তা একেবারেই নগণ্য।
তবে এই চড়ুই পাখি হ্রাসের অন্যতম কারণ হচ্ছে- নিয়ন্ত্রণহীন রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার। ক্ষতিকর পোঁকামাকড়ের হাত থেকে ফসল বাঁচাতে কৃষকরা কীটনাশক ব্যবহার করে। আর চড়ুই পাখির প্রধান খাদ্য ছোট-ছোট পোঁকামাকড়, সরিষা দানা, ঘাসের বিচি ও চাউলের কুঁড়ো। তাই কৃষি জমিতে কীটনাশক ব্যবহারের ফলে এসব পোঁকামাকড় খেয়ে তারা আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে।
যদিও চড়ুই পাখি আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এরা কৃষকদের ক্ষেতের মারাত্মক ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ খেয়ে ফসলকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে। গাছের পাতা ধ্বংসকারী পোঁকামাকড় খেয়ে গাছকে সতেজ রাখে এবং গাছের ডালে বসে গাছের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করে।
বিষয়টি নিয়ে কথা হলে জাতীয় মানবাধিকারকর্মী ও গবেষক কবি নুর মোহাম্মদ খান দৈনিক শপথকে বলেন, প্রতিনিয়ত ধ্বংস হচ্ছে আমাদের সবুজ বৃক্ষ। নির্বিচারে বৃক্ষ নিধনের মাধ্যমে পাখিদের আবাসস্থান ধ্বংস এবং বিভিন্ন ফসলের ক্ষেতে ক্ষতিকর কীটনাশক প্রয়োগের প্রভাবে দিনদিন হারিয়ে যাচ্ছে চিরচেনা এসব দেশীয় পাখিগুলো। তাছাড়া পাখি শিকার বিষয়ে আইন থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না হওয়ায় ক্রমশ: দেশীয় প্রজাতির পাখি হ্রাস পাচ্ছে বলে মনে করেন সচেতন মহল।
সুমন আহমেদ