সৌম্য সালেক

বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মনোহর আলী আমার চাচা, তাঁর সাথে আমার সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। সাহিত্যের বিভিন্ন ধরণ- প্রকরণ বিশেষত আধুনিক কবিতা ও শিল্পচৈতন্য সম্পর্কে তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল অসাধারণ। রবীন্দ্র সাহিত্যের রস ও রবীন্দ্রনাথের ভাষাশৈলি সম্পর্কে তাঁর অভিনব উন্মোচন, নতুনভাবে আমাকে রবীন্দ্রপাঠে উৎসাহ যোগিয়েছে। তিনি রবীন্দ্রনাথের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’- গল্পটিকে পৃথিবীর শেষ্ঠ গল্প মনে করতেন; তাঁর এই বক্তব্য শুনে আবারও ক্ষুধিত পাষাণ পড়েছি, এরপর আবারও পড়েছি এবং মনে হয়েছে, আসলেই এটি অতুলনীয়। মনোহর অালীর প্রিয় শিক্ষক ছিলেন ভাষাবিজ্ঞানি মুহাম্মদ আবদুল হাই। আবদুল হাইয়ের মৃত্যু সম্পর্কে চাচার কাছে নতুন কিছু তথ্য জেনেছি, সে অন্য কোনও লেখায় প্রকাশ করবো। আমার সৌভাগ্য যে তাঁর মতো বরেণ্য শিক্ষক ও সাহিত্যবোদ্ধার সাথে দীর্ঘসময় কাটিয়েছি, অনেক আড্ডা দিয়েছি তাঁর মোমিনপাড়ার বাসায়, যা কখনও ভোলার নয়। সাহিত্যের কোনও বিষয়ে আটকে গেলে তাঁর কাছ থেকে দ্রুত সময়ে সমাধান পেয়েছি, সাহিত্য চর্চায় তিনি আমার শিক্ষকতুল্য। বিশ্বসাহিত্য বিশেষত শেক্সপিয়র ও মোফাসা সম্পর্কে তাঁর পাঠন পাঠন যেমন বিস্তৃত তেমনি এ দুই লেখক সম্পর্কে তাঁর ছিল উচ্চতর ধারণা। আমার প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘আত্মখুনের স্কেচ’ নিয়ে তিনি দীর্ঘ আলোচনা লিখেছিলেন, বইটির যেসব সূক্ষ্ম বিচ্ছুতি নিয়ে তিনি প্রশ্ন রেখেছিলেন তা আর কারো আলোচনায় আসেনি। তাঁর গভীর পাঠ ও বিশ্লেষণ সম্পর্কে সেই থেকে আমি ব্যাপক আগ্রহী। যেমন ঈর্ষনীয় ছিল তাঁর সহজ-সাধারণরূপে অসাধারন ব্যক্তিত্ব তেমনি সমৃদ্ধ ছিল তাঁর গ্রন্থ-সংগ্রহ ও পাঠাভ্যাস । তাঁর সাথে চর্চিত বিষয়-আশয়, কথোপকথন ও আলোচনা নিয়ে দীর্ঘ রচনা বিবৃতির সুযোগ রয়েছে, সময় পেলে একদিন সেসব লিখে নেবো।
তাঁকে হারিয়ে গভীর শূণ্যতা বোধ করছি; কার কাছে আর জানাবো আকাশ-কুসুম স্বপ্ন ও যুগযন্ত্রণার জটিল আত্মবিবৃতি। আল্লাহ তাঁর আত্মাকে চিরশান্তি দান করুন। আমিন।
বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মনোহর আলী সোমবার (১৮মে) বিকাল পাঁচটায় রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তিন গেল বছরের আগস্ট থেকে ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন। ১৯৪৭ সালের ১৩ নভেম্বর চাঁদপুর জেলার কচুয়া উপজেলার তেতৈয়া গ্রামে তাঁর জন্ম।
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে ১৯৬৯ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
অধ্যাপক মনোহর আলী চাকুরি জীবনে সিলেট এমসি কলেজ, দিনাজপুর সরকারি কলেজ ও চাঁদপুর সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করেন এবং সাতক্ষীরা সরকারি মহিলা কলেজ ও চাঁদপুর সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ পদে দায়িত্ব পালন শেষে অবসর গ্রহণ করেন। সাহিত্য চর্চাসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে তিনি যুক্ত ছিলেন। সনাক চাঁদপুর জেলা শাখার প্রথম সভাপতি এবং জেলা শিল্পকলা একাডেমির আহ্বয়াক কমিটির সদস্য হিসেবে তিনি নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘদিন তিনি চাঁদপুর সাহিত্য একাডেমির সাথেও যুক্ত ছিলেন। একজন সভ্য ও সংস্কৃতিবান মানুষ হিসেবে চাঁদপুরের সুধীসমাজের কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন।