ফারদিন ফেরদৌস:
আমার কাছে বাবার স্মৃতি বলতে একটা গোলাকার আয়না। এর বেশি কিছু নেই। চল্লিশ বছর ধরে আগলে রাখা ওই আয়নায় আমি অথবা আমার সন্তানেরা মুখ রাখলে পূর্বপুরুষের সান্নিধ্যের সাধ মিটে কিছুটা। আজ বাবা দিবস। কিন্তু একটি বিশেষ দিনের জন্য আমার কোনো বাবা নেই। তাই আমার পিতৃদেব বা জনয়িতা নিয়ে খুব বেশি আবেগ আদিখ্যেতাও দেখানোরও সুযোগ সীমিত।
নিয়তির ইচ্ছায় সন্তান আবাল্যেই অনাথ বা নিরাশ্রয় হয়ে পড়লে বাবার আবদার, খুনসুটি বা ভালোবাসা নিয়ে বলবারও তেমন কিছু থাকেও না। আমার বাবা না দূরের মানুষ; না কাছের। তাই পরম মমতা, মাথার ওপর এক আকাশ ছায়াবৃক্ষ নির্ভরতা বা অশেষ নিরাপত্তার অনুভূতি সেতো নয় আমার জন্য। আমার বাবা কি রাগ, শাসন, ভয়ে মোড়ানো গম্ভীর রাশভারী? তার আমি কী জানি? বাবা তুমি আসলে কেমন?
বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার প্রথম দশকের শেষার্ধে যখন বুঝতে শিখেছি আত্মীয়-পরিজন সবাইকে দেখতাম আমার মাথায় হাত বুলিয়ে খুব আদর করতে। আহা! এতিম ছেলে। এতিমের মাথায় হাত দিলেই গুণাহ মাফ। কী ট্রাজেডি, আমি বাবা বলে কারো কোলে গিয়ে বসতে পারি না। তাঁর ঘাড়ে ওঠে পাড়াময় বেড়াতে পারি না। বালকীয় কৃত্যে তাঁর গা ভিজিয়ে দিতে পারি না। আমার আর মায়ের সুখে দুঃখে তাঁর কোনো দেখা পাই না। সেই বেদনাবিধুর নিঃসঙ্গতার কথাটিই বারবার মনে করিয়ে দিয়ে আমার মাথার ওপর দিয়ে ছওয়াব কামাই করে যান আমাদের দুঃখে খুব হাহুতাশি স্বজনেরা! না অস্বীকার করব না কেউ কেউ ধর্মাচারের ব্রত হিসেবে ফেতরা বা যাকাতের দু’চারখানা টাকাকড়িও আমার কোমল হস্তে সমর্পণ করে যান। এতে নাকি তাদের দ্বিগুণ ছওয়াব। যাক সান্ত্বনা এই যে, আমার অদৃশ্য বাবা লোকায়িত বলে এই অনাথ নিরাশ্রয়ের অছিলায় অনেকের স্বর্গলাভের অভিলাষ পূর্ণ হতে থাকল।
মহান প্রভুর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে আমার মাথার সব চুলের ওপর দিয়ে পূণ্যার্থীর হাত অতিক্রমেরও আগে আমার বয়স মাত্র যখন ২ শত ৪০ দিন, হঠাৎ আমার কর্মচঞ্চল গ্রাম্য কবিরাজ বাবা নিঁখোজ হন। সাত দিন পর বাড়ির অনতিদূরে বিলের কচুরিপানার সবুজপত্র আর বাহারি মঞ্জুরিকা ভেদ করে বাবার হাতের হদিশ পাওয়া যায়। পাশে বসে কৃষ্ণ কাকেদের তারস্বর চিৎকার আর সেই পিতৃহস্ত ভোজন সবার মনোযোগ কাড়ে। সাতদিনের গলিত বাবাকে বিলের জল থেকে টেনে তোলা হলে মায়ের পোশাক শুভ্র হয়ে যায়। নাক থেকে খসে পড়ে নদ। কানপাশা ছুড়ে ফেলা হয় দূরে। অশ্রুবাষ্প আর বিষাদের নীল বিষে ছড়াছড়ি মায়ের ঊষর প্রান্তর। একমাত্র পুত্র তাঁর নিরাশ্রয় অনাথ।
খুব সাদামাটা গ্রামীণ পারিবারিক গল্প। সৎ মা তার শরীক বিনাশ করতে পরিবারের বড় পুত্রকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিলেন। আর বাবার পাষাণ পিতৃকাপুরুষ তার দ্বিতীয় স্ত্রীর পক্ষ নিয়ে চিহ্নিত হন্তারকদের কাছ থেকে উৎকোচ নিয়ে রাষ্ট্র কর্তৃক দায়েরকৃত মামলা ডিসমিস করে দিলেন। সেকালেও এখনকার মতোই খুনোখুনি বা বিচারহীনতার সংস্কৃতি খুব চালুই ছিল।
দস্যুদের বাড়ি থেকে স্থায়ীভাবে বাপের বাড়ি চলে আসা শোকগ্রস্ত মা কোনোদিন আমার বাবাকে নিয়ে এক লাইনও বলেননি। বাবার স্মৃতি বলতে এই আমি আর বাবার রেখে যাওয়া ওই একটা গোল আয়নাই আমার পরম সঞ্চয়। পিতার সেই আরশিতেই জাগরুক আছে আমার দুই সন্তান সুখপ্রীতা ও সম্প্রীতার প্রতিচ্ছবি। ওই আয়নাতেই মুখ রেখে দেখি, বাবা আমাকে কাঁধে তোলে সারা গ্রামময় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। পাখি দেখাচ্ছেন, ফড়িং চেনাচ্ছেন। হাঁটি হাঁটি পা পা করছেন। ৮ মাসের শিশু কীইবা তার বোঝে? বাবার একটা পোষা বানর ছিল বলে জেনেছি। গলায় লোহার শিকল পরানো ধূসর রঙের সেই উচ্ছল বানরটাও নাচতে নাচতে কি আমাদের পেছন পেছন ঘুরে চলেছে?
আমার এমন পিতৃপ্রেমে ছিটেফোঁটাও আনন্দ নেই কেবলই বেদনা। তবে তাই হোক, আমার জীবনে নাহয় কবিগুরুই সত্য থাকুক, প্রেমের আনন্দ থাকে স্বল্পক্ষণ কিন্তু বেদনা থাকে সারাটি জীবন।
বাবাহীন আমাদের সব ঈদের গল্পগুলোও হয় বরাবর বড় বিষাত্মক সাদামাটা। ঈদটার আনন্দ কখনো চোখে দেখিনি। চেখে দেখিনি।
আমি তখন বাবার কাঁধে ওঠে এপাড়া ওপাড়া করতে শিখেছি কেবল। পিতৃপুরুষের এক হাতে থাকতো পোষা বানরের গলায় বাঁধা লোহার শিকল। অন্যহাতে এক ব্যান্ডের এক হলুদ রঙা রেডিও সাথে পুত্রধনের নরম পা। আমার খুশি কে দেখে। খুশি মানে ঈদ।
হঠাৎ এক ঝড় এসে আমার সুখের আসন ঈদ বেচারাকে কেড়ে নিয়ে গেল। শিশুটার বয়স সবে মাত্র আট মাস। বিলের ধারে কচুরিপানার নিচে আবাল্যে মা হারা ওই দুঃখী ঈদটা আমার কাকের খাবার।
হাহাকারের কাকের গল্প বুকে বইয়ে পেরিয়ে গেল চার দশক। এইবেলা আমার কাঁধে যাদের আসন সেই সন্তানদের ঈদটাও করোনাকালে মুখ লুকালো বেদ বিধি আর শাস্ত্র কানার হাট বাজারে। মহামতি হাসন রাজা যেন ব্যথাতুর হৃদয়ে সুর দিয়ে যান…
আগুন লাগাইয়া গেল কনে
আমাদের ঈদের সুন্দরবনে।।
আমার এমন ট্রাজিক বাবা’র উদ্দেশ্যে নিবেদিত হোক প্রাণের এই পঙ্ক্তিমালা…
হাত ধরে শেখালে হাঁটি হাঁটি পা
চোখ মেলে দেখালে এই বসুধা
মুখ ফুটে বলালে কথা অ আ
গলা খুলে বুঝালে সুর সাধনা
তোমার চওড়া কাঁধে ছিল রাখা
আমার স্বাধীনতা
বাবা তুমি আজ
আকাশের মিটিমিটি তারা
কীভাবে প্রহর কাটে তোমায় ছাড়া
বাবা তুমি আজ
আঁধার রাত্তিরে দীপশিখা
তুমি ছাড়া সময় বড় প্রহেলিকা
তোমার আলোয় দেখেছি পৃথিবীর মেঠোপথ
তোমার প্রেরণায় গড়েছি জীবনের জয়রথ
তুমি আমার চিরায়ত ঠিকানা
হাত ধরে শেখালে হাঁটি হাঁটি পা
চোখ মেলে দেখালে এই বসুধা
বাবা…
চাতক জমায় মেঘের আবেগ তৃষা অনিবার
হৃদয় গহনে রেখে দিয়েছি বেদনা হাহাকার
তুমি আমার অঝোর বৃষ্টিধারা
চোখ মেলে দেখালে এই বসুধা
মুখ ফুটে বলালে কথা অ আ
বাবা…
ছুঁয়ে ছিলে সোহাগে অঘ্রাত সুবাসিনী ফুল
আমাকেই গড়ে দিলে সেই ভুলের মাশুল
রক্তের এ বাঁধন ছেঁড়া যায় না
মুখ ফুটে বলালে কথা অআ
গলা খুলে বুঝালে সুরের সাধনা
বাবা…
তোমার চওড়া কাঁধে ছিল রাখা
আমার স্বাধীনতা
বাবা…
ফারদিন ফেরদৌস: লেখক ও সাংবাদিক
মাছরাঙা টেলিভিশন