কাদের পলাশ
বাবাকে নিয়ে আমার স্মৃতির ভান্ডার সমৃদ্ধ নয়। পৃথিবীতে আমার অস্তিত্বের উপস্থিতির পরপরই দীর্ঘ ২০ বছর বাবা প্রবাসে ছিলেন। মাঝেমাঝে ছুটিতে দেশে এসেছেন। সব মিলিয়ে বাবাকে কাছ থেকে দেখেছি বড় জোর একশ কী দেড়শ দিন হবে। মাসের হিসেবে চার কি পাঁচ মাস। এরমধ্যে উল্লেখ করার মতো একটা ঘটনাও নাই। তবে বাবার কর্মতৎপরতা আর পরিশ্রম আমার পথ চলার পাথেয়। এমন একজন বাবা পেয়েছি তাই জীবন স্বার্থক বলে বিশ্বাস করি।
একদিন অপরাধ না করেও বাবার হাতে বেদম প্রহার খেয়েছি। মূলত আমাকে মারার কারণ ছিলো অপরাধীদের শিক্ষা দেয়া। যারা অপরাধ করেছে আমি তাদের সাথে খেলি-স্কুলে যাই আনন্দ করি। এই জীবনে একবার বাবার কোলে উঠার কথা মনে পড়ে। এক বর্ষায় বাবা প্রবাস থেকে ছুটিতে এসেছেন। আমার বড় জেঠাদের একটি খাসি ছাগল জবাই হলো। আমাদের ঘর থেকে একশ হাত দূরে জেঠাদের ঘর। জেঠা এখন আর বেঁচে নেই। সন্ধ্যার পর বৃষ্টি হচ্ছে। বাবার সাথে আমিও জেঠাদের ঘরে যেতে বায়না ধরি। বাবা আবদার রক্ষা করলেন। উঠোন জুড়ে কাদা। তাই আমাকে কোলে করে জেঠাদের ঘরে নিলেন। বাবার কোলে চড়া এটিই শেষ ও প্রথম। কারণ এর আগের কথা মনে নেই। ছেলে বেলায় বাবার কাছে আমার কোনো চাওয়া ছিলো না। না চাইতে কিছু পেয়েছি তাও কিন্তু নয়। একবার একটা খেলনা কিনে দিতে বলেছি। বাবা কিনে দিতে চাইলেন কিন্তু বাবার সাথে থাকা অন্যরা কিনে দিতে বারন করলেন। তারপরেও আমার বায়না শিথিল হয় না। বাধ্য হয়ে বাবা সেই খেলনা কিনে দিলেন। ভাগ্য এতোটাই খারাপ যে ঘন্টা খানেক পরেই হাত থেকে পড়ে খেলনাটি ভেঙে গেলো। মনে খুব আঘাত পাই। তারপর আর কখনো বাবার কাছে কখনো কোনো খেলনা বা কিছু বায়না করিনি।
বাবা আমার স্বশিক্ষিত মানুষ। কিন্তু মনের দিক থেকে অনেক বড় শিক্ষিত। আক্কেলবান মানুষ। আমার শ্রদ্ধার মানুষ। বিশ্বাস করি এলাকার মানুষও বাবাকে খুব শ্রদ্ধা সম্মান করে। এখন তো শ্রদ্ধা করার মানুষও জুটে না। দিনকে দিন শ্রদ্ধার মানুষগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। যাদেরকে শ্রদ্ধা করি তাদের মুখ আর মুখোশের তফাত বুঝতে পারলে শ্রদ্ধার বদলে মনে তৈরি হয় ভিন্ন কিছু।
একটা ঘটনা বলি। বছর খানেক আগে বাজার থেকে একটি গরু কিনলেন বাবা। বিক্রেতার সাথে দাম নির্ধারণ করা হলো ৭০হাজার টাকা। বাবা কিছু টাকা দিয়ে বাকী টাকা বাড়ি থেকে নেয়ার কথা বললেন। বিক্রেতা রাজি হলেন। বাড়িতে গরু পৌঁছে দিয়ে বাকী টাকা নিয়ে যাবেন। কিন্তু ঘটনা ঘটলো উল্টো। লোকটি বাড়ি এলেন কিন্তু গরু আনলেন না। বাবা অবাক। ঘটনা জানতে চাইলেন। লোকটি বললেন, পথে গরুটি ৭৫হাজার টাকায় বিক্রি করে দিয়েছি। বাবা তার মুখের দিয়ে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলেন। লোকটি পূর্বে দেয়া টাকাগুলো বুঝিয়ে দিলেন। বাবা কিছু বললেন না। সবশেষ লোকটি যাওয়ার সময় বাবাকে একহাজার টাকা দিতে চাইলেন। বাবা বললেন, কিসের টাকা? লোকটি বললেন, আমি পাঁচহাজার টাকা বেশি দরে গরুটি বিক্রি করেছি সে থেকে কিছু আপনাকে দিলাম। বাবা খুব ক্ষ্যপে গেলেন। এতোটাই ক্ষ্যপলেন যে, লোকটিকে মারতে উদ্যত হলেন। লোকটি বাবাকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, ভাই ভুল হয়ে গেছে। বাবা বললেন, এটা ভুল নয় বিশ্বাস ঘাতকতা। তারছে বড় কথা একহাজার টাকা দিতে চাওয়াটা তোমার অপরাধ অপরাধ হয়েছে। বাবা জানতে চাইলেন, তুমি কার গরু বিক্রি করেছে?
লোকটি বললেন, আপনার।
-তবে আমাকে একহাজার টাকা দিচ্ছ কেন? তুমি যদি মানুষ হতে তবে পুরো ৭৫হাজার টাকা আমার হাতে দিয়ে তোমার ভুল স্বীকার করতে। কিন্তু তুমি একহাজার টাকা দিয়ে আমাকে দালাল বানাতে চাইলে। আমার জবান যায়নি। তোমার জবান গেছে। চিটার হয়েছো তুমি। আমার বাবা নীতিতে অটল মানুষ। এ নিয়ে এলাকায় বাবার খুব কদর। এলাকায় কোনো সমস্যা তৈরি হলে সবাইকে বাবাকে শালিশ মানে। এতে গ্রামের কিছু মোড়লের খুব ক্ষতি হয়। কারণ বাবা থাকলে তারা একতরফা কিছু করতে পারে না। বিনিময়ে তাদের পকেটে কিছু ঢুকে না। তাই ওই চক্র এক হয়েছে বাবা থাকলে তারা দরবার কারবার করবে না। একজন নীতিবান মানুষ হিসেবে আমি আমার বাবাকে নিয়ে গর্ব করি। আরো উদাহারণ যদি দিই তবে বলতে পারি, আমার বাবা অনেক সম্পতি কিনেছেন। কিন্তু সাব কাবলা করেছেন কয়েক বছর পর। এমনকি বাবা যেসকল জায়গা বিক্রি করেছেন সেসব জায়গাও মানুষ কয়েক বছর পর সাব-কাবলা করে নিয়েছেন। পৃথিবীতে প্রতারক তথা কথা না রাখতে পারার ভিড়ে আমার বাবাকে নিয়ে আমি তৃপ্তি বোধ করি। আমার বাবা এখন নিঃসঙ্গ মানুষ। মা মারা গেছেন আজ আট মাস। বাবা একা ঘরে ছটপট করেন। বাবাকে বলি আমার সাথে থাকুন। কিন্তু তিনি গ্রামকে ভালোবাসেন। মায়ের কবরটা বাড়ি পাশেই। প্রতিদিন মায়ের কবরের কাছে গিয়ে নিত্যদিন ঘটে যাওয়া আক্ষেপগুলো বলেন। আমি অসহায়ের মতো বাবার জন্যে প্রার্থনা করি। বাবা ভালো থাকুক। সত্তরোর্ধ বয়সী আমার বাবা দীর্ঘজীবী হোক আজকের দিনে এই প্রত্যাশা।
লেখক: সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক শপথ।