পাহাড় আসলেই প্রকৃতি প্রেমীদের নেশায় ডুবিয়ে দেয়। পাহাড়ে নিজের শক্তির যাচাই করে চূড়ায় আরোহনের আনন্দ পাওয়ার সেই মুহুর্ত আপনাকে উদ্বেলিত করবেই। অন্যদের সেই গল্প শোনাতে বাধ্য করবে। পাহাড় ঘুরে আসা একটা মানুষ দেখান যারা পাহাড়ের গল্প শোনায় না। আমিও আজ আপনাদের গল্প শোনাবো। পাহাড়ের গল্প।
পাহাড়প্রেমীরা বলে থাকেন, বান্দরবানের প্রতিটি জায়গারই দুটি রূপ আছে। একটি সূর্যের আলোতে অন্যটি রাতে। রাত নেমে এলে লাল বর্ণের উঠোন মেঘ এসে ভিজিয়ে দিয়ে যায়। আর যদি চাঁদ উঁকি মারে তো মনে হবে, চাঁদের আলো গলে গলে পড়ছে পাহাড় বেয়ে। কবির একটা পাহাড় কেনার শখ ছিল। আজ সে শখ আমারও। হয়তো এ শখ সকল পাহাড় প্রেমিদের। বান্দরবান নামটির উৎপত্তি হয়েছে শহরের কাছাকাছি ‘মৌকছে সেতুর’ নিচে অবস্থিত ‘মৌকছে’ নামক ঝিরির নামানুসারে। ‘মৌকছে’ হচ্ছে মারমা শব্দ, যার অর্থ ‘বানরের শেকল’। ‘মৌক’ মানে বানর। আর ‘ছে’ মানে শেকল। যার অর্থ দাড়ায় বান্দরবান্ধা বা বান্দরবান। এককালে এখানে অনেক বানর ছিলো। বানররা খাল পারাপারের জন্য পরস্পরকে ধরে শেকলের মতো লাইন তৈরি করতো। স্থানীয় মারমা আদিবাসীরা একে মৌকছে বলে ডাকতো। যার ফলশ্রুতিতে পরে এর নাম হয় বান্দরবান। মারমা রাজার বাড়ীও এই বান্দরবানে। এখানে আরও আছে দেশের একমাত্র রাইফেলস ট্রেনিং সেন্টার।
কোভিডের দীর্ঘ একঘেয়েমী কাটিয়ে তুলতে অনেকদিন ধরেই একটা ট্যুরের জন্য হাঁসফাঁস করছিলাম। প্রায় দুমাস আগে একটা এডভেঞ্চার ট্যুরের পরিকল্পনা হলো। গন্তব্য বান্দরবানের অফ ট্র্যাকিং রোড।
যাত্রা শুরু চাঁদপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে। বোগদাদ বাসের শেষ ট্রিপে রওনা দিলাম কুমিল্লা। ভাড়া নিয়েছে জনপ্রতি ১১৫ টাকা। কুমিল্লা বিশ্বরোড নেমে একটু পায়ে হেঁটে নুরজাহান হোটেলে পৌঁছে রাতের খাবার সেরে নিলাম। ততক্ষণে ঢাকা থেকে আসা বান্দরবানগামী হানিফ পরিবহনের বাস উপস্থিত। আগে থেকেই বুক করা আসনে গিয়ে বসলাম। ঢাকা থেকে বান্দরবানের ভাড়া নিয়েছে ৬২০ টাকা। নন এসি হলেও বাসের পরিবেশ ও সিটগুলো ছিলো আরামদায়ক। নুরজাহান হোটেলের সামনের বরই গাছের সেই হাজার হাজার পাখির উপস্থিতি দেখিয়ে টিমমেটদের চমকে দিয়েছি এরই মধ্যে। বাস চলতে শুরু করলো। বাসের মধ্যে আরও দুটি টুরিষ্ট গ্রুফের সাথে কথা হলো। সবাই মিলে গানে গানে কিছুক্ষণ জমিয়ে রাখলেও একসময় সবাই ঘুমের রাজ্যে। আঁকাবাকা পাহাড়ী রাস্তায় গাড়ির ঝাঁকুনি আর চেকপোস্টে গাড়ি গতি ধীরে ধীরে থেমে যাওয়ায় ঘুম ভাঙলো আমাদের। বুঝলাম আমরা বান্দরবান শহরের কাছাকাছি। চেকপোস্টে সকলের এনআইডি চেক করা হলো। চলে আসলাম বান্দরবান শহরে। বাসস্ট্যান্ড থেকে একটু এগিয়ে ট্রাফিক সিগন্যালে আমাদের নামিয়ে দেয়া হলো। তখন ভোর সাড়ে চারটা। নামতেই চাঁদের গাড়ির ড্রাইভাররা এসে খোঁজ নেয়া শুরু করলো কোন গ্রুপ কোথায় যাবে। শুরু হলো দরদাম। গ্রুপের মধ্যে দামাদামিতে দক্ষ সদস্য সাইফুল ইসলাম নিরবকে দায়িত্ব দিয়ে আমরা চারপাশটা হেঁটে দেখলাম। ততক্ষণে ফজরের আজান হয়েছে। সাঙ্গু নদীর পাড়ে অবস্থিত অসাধারণ কারুকাজ আর আধুনিক নকশার বিশাল মসজিদটি নজর কাড়বে যে কারো। আমি আর সাথে থাকা মনজুর আহমেদ জুয়েল ভাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলাম মসজিদটি। অজু করে নামাজ পড়ে এসে দেখি গাড়ি রেডি। কথা হয়েছে পথের সকল উল্লেখযোগ্য স্থান উপভোগ করিয়ে আমাদের থানছি নামিয়ে দিবে গাড়ি। ভাড়া পড়েছে ৩০০০ টাকা।
শুরু হলো আঁকাবাকা পাহাড়ী রাস্তায় আমাদের এগিয়ে চলা। আবছা মেঘের ভেলা ছেদ করে তখনো আকাশে জ্বলজ্বলে চাঁদ। কারণ পুর্ণিমা দেখেই আমাদের ট্যুর প্লান করা হয়েছিলো। মেঘগুলো যেন ছুঁয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের কোল। চাঁদের গাড়ি আঁকাবাঁকা খাড়া পথ বেয়ে উঠা শুরু করলো যেন দিগন্তকে ছোঁয়ার নেশায়। গাড়ির ক্ষিপ্র গতিতে প্রথমে ভয়ই লাগছিলো। স্থির হয়ে বসতেই পারছিলাম না আমরা। কিন্তু খাড়া পাহাড় বেয়ে উপরে উঠতে গাড়ির এই গতির বিকল্প নেই। চাঁদের গাড়ি যেন চলতে থাকলো চাঁদের হাট দিয়ে। দু’পাশের মনোরম দৃশ্য আর মোহনীয় পরিবেশ আমাদের নিয়ে যাচ্ছিলো কোন এক আদিম অন্তরালে।
যাত্রা পথে দেখতে পেলাম শৈল প্রপাত। বান্দরবান শহর হতে থানচি যেতে পথের আরেকটি স্পট হলো এই শৈলপ্রপাত। ফারুকপাড়ার পাশের এই জলপ্রপাতটিতে শুকনো মৌসুমে এতটা পানি না থাকলেও বর্ষা মৌসুমে প্রকাশ পায় এর ভয়ানক রুপ। এর পাশের মানুষরা হলো বম সম্প্রদায়ের। ওরাই এই ঝর্ণার পানি ব্যবহার করে। তাই আমাদের উচিত এই ঝর্ণা যেন কোনক্রমেই ময়লা না হয় সেদিকে নজর রাখা।
একটু এগিয়ে ভিউ পয়েন্টে নেমে উপভোগ করলাম একটা পাহাড়ী সকালের আগমন। আর নিজে নিজে আবিষ্কার করলাম এর থেকে মোহনীয় সকাল আর হয় না। পথিমধ্যে চিম্বুক চেকপোস্টে আমাদের যাবতীয় তথ্য লিপিবদ্ধ করে অনুমতি নিয়েছি। ‘বাংলার দার্জিলিং’ খ্যাত চিম্বুক পাহাড়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৩০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত। তবে অনেকে একে বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু পাহাড় বলে মনে করেন। এখানে আছে টিএনটি বোর্ডের একটি বেস স্টেশন এবং বাংলাদেশ সড়ক বিভাগের একটি সুদৃশ্য রেস্টহাউস। এর আশেপাশে বসবাসকারী আদিবাসীরা সব হলো-মুরং।
চলছে আমাদের গাড়ি। আমরা যেন প্রকৃতির কাছে সঁপে দিয়েছি নিজেদের। হঠাৎই গাড়ি মোড় ঘুরতেই বাঁম দিকে নজর দিয়ে আমরা হতবাক। মনের অজান্তেই সম্মিলিত চিৎকার। এ চিৎকার আনন্দের, এ চিৎকার নতুন কিছু আবিস্কারের, উপলব্ধির। এ এক নয়নাভিরাম নৈস্বর্গিক যাত্রা। আমরা যেন সাদা মেঘের ভেলায় ভাসছি। নিচে যতদুর চোখ যায় শুধু সাদা মেঘেদের রাজত্ব। ডাবলহ্যান্ড থেকে এই দৃশ্য সবচেয়ে ভালোভাবে দৃষ্টিগোচর হয়। তাই সেখানে নেমে প্রাণভরে উপভোগ করলাম আর সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করলাম অবনত মস্তকে।
কিছু পরে নীলগিরি পৌঁছে গেলাম। ততক্ষণে পেটের রাক্ষসেরা জেগে উঠেছে। পাশের হোটেলে নাস্তার অর্ডার করলাম। এখানকার বেশিরভাগ হোটেলেই ভাত, খিচুড়ি, তেহেরি এই ধরনের খাবার পাওয়া যায়। অর্ডার করলেই তারা প্রস্তুত করে। তাই আমরা ভাত, ডিমভাজি, আলুভর্তা আর ডাল অর্ডার করে জনপ্রতি ১০০ টাকা টিকেটে নিলগিরিতে প্রবেশ করলাম। এদিকে আমাদের নাস্তা তৈরি হয়ে যাবে। তখন সকাল আটটা। এটাই নীলগিরির মেঘেদের ছোয়ায় নিজেদের উদ্ভাসিত করার উপযুক্ত সময়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এই স্থানে রয়েছে পরিবারসহ থাকার ভালো ব্যবস্থা। নীলগিরি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩৫০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত। এখানে পাহাড়ের নীস্তবদ্ধতায় বয়ে চলে শন শন বাতাস, বাধাহীন দৃষ্টির সীমায় আকাশ ঠেকেছে পাহাড়ে। চাইলে এখানে রাতে থেকে সকালে আপনি হারিয়ে যেতে পারেন মেঘেদের রাজ্যে। এখানে মেঘেরা ভেসে বেড়ায় আপন মহিমায়। একটি ভিউ পয়েন্ট আছে যেখান থেকে আপনি দেখতে পাবেন বয়ে চলা সাঙ্গু নদী। যায়গাটি একদম পরিপাটি ছবির মতো করে সাজানো। প্রায় ঘন্টাখানেকের ঘুরাঘুরি ও ছবি তোলা শেষে আমরা নিলগিরি থেকে বের হয়ে এলাম।
নাস্তা শেষে আমরা ছুটলাম থানচির উদ্দেশ্যে, যেতে যেতে পথে পড়লো নীলদিগন্ত। বান্দরবন জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গড়ে উঠা সাম্প্রতিক কয়েকটি স্থাপনার এটি একটি। এখানে রয়েছে বেশ ভালো একটি ভিউ পয়েন্ট। এখান থেকে দেখা মিলবে আঁকাবাঁকা সর্পিল আকারের নয়ানাভিরাম রাস্তার দৃশ্যসহ বিস্তৃত পাহাড়ের সবুজ শ্যামলিমা। এ যাত্রা যেন পাহাড়ের কোল ঘেষে আমাদের নিয়ে গেল মিলিয়ে যাওয়া মেঘেদের চূড়ায়। বলিপাড়া বিজিবি ক্যাম্পে প্রয়োজনীয় তথ্য দিলাম আমরা। থানছি পৌঁছলাম সকাল ১১টায়। বাংলাদেশের একটি উপজেলা হল থানচি। থানচি শব্দের অর্থ হলো ‘বিশ্রামাগার’। ধারণা করা হয় ১৯৫০ সাল বা তারও পূর্বে মানুষজনের এসব দুর্গম পথে যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম ছিলো নৌকা। যাত্রাপথে সবাই এই জায়গায় এসে বিশ্রাম নিতো বলে এর নাম হয় বিশ্রামাগার বা থানচি। থানচিতে দেখার উল্লেখযোগ্য স্থান হলো ‘চেনকন ঝিরি’। এই ঝিরির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো ঝিরির সবগুলো পাথর দেখতে গোল অর্থাৎ গোলপাথর। বান্দরবানের গহিনে কেউ ট্রেকিং করতে চাইলে তার ছোটখাট অনুশীলন এখানেই করে নিতে পারে। এখানে আরও আছে ‘টিএনটি পাড়া’ যা এই এলাকায় বাঙ্গালিদের শেষ আবাসস্থল। এখানে এসে আমাদের গাইড জর্জ ত্রিপুরার সাথে মিলিত হলাম। গাইড আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। আগামী তিনদিন সে আমাদের টার্গেট স্পটগুলো ঘুরিয়ে দেখাবে। বিনিময়ে তাকে দিতে হবে ৫০০০ টাকা। বলে রাখা ভালো, এখানে স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃক নিবন্ধনকৃত গাইড সাথে নেয়া বাধ্যতামূলক। এরই মধ্যে আমরা পথে বিজিবি ক্যাম্পে আমাদের সকলের জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য, নিজের এবং পরিবারের যোগাযোগের নম্বারসহ নির্দিষ্ট ফরমে চাহিদামত যে তথ্য দিয়ে এসেছি, তারই একটি অনুলিপিসহ আমাদের গাইড নিয়ে গেল থানচি থানায়। সেখানে আবারো সকল তথ্য নিয়ে আমাদের ছবি তুলে রাখা হলো।
সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে প্রত্যেকের জন্য লাইফ জ্যাকেট ভাড়া নিলাম প্রতিদিন ৫০ টাকা করে। এখানে পর্যটন কর্পোরেশনের রেস্টুরেন্ট থেকে দুপুরের খাবার ভাত, মুরগির মাংস, আলুভর্তা আর ডাল পার্সেল করে নিলাম নৌকায় বসে খাবো বলে। আমাদের জন্য নৌকা আগে থেকেই ভাড়া করা ছিলো গাইড জর্জের কল্যানে। লম্বাকৃতির এসব নৌকায় সর্বোচ্চ পাঁচজন বসতে পারে। আমরা ছিলাম আটজন। তাই দুটি নৌকা আমাদের জন্য প্রস্তুত ছিলো। নাফাখুম পর্যন্ত যতটুকু নৌকা চলে তার আসা যাওয়া বাবদ ভাড়া পড়েছে ১৩০০০ টাকা। বর্ষা মৌসুমে পানি বেশি থাকায় আমাদের হাঁটতে হয়েছে তুলনামূলক কম, নৌকা ভ্রমণ ছিলো বেশি। তাই ভাড়ার পরিমানও বেশি ছিলো। স্বাভাবিক সময়ে প্রতি নৌকার ভাড়া পড়ে ৫০০০ টাকা।
আমরা এখন সাঙ্গু নদীর পাড়ে। বান্দরবান শহরে বহমান গুরুত্বপূর্ণ নদী হলো এই সাঙ্গু। ব্যতিক্রমী একটি নদী। সাঙ্গুর আরেক নাম ‘শঙ্খ’ নদী। এটি দেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তের নাইক্ষিয়াংছড়ির দিকে আরকানের পাহাড়ে জন্ম নিয়ে উত্তর দিকে গিয়ে থানচি, রুমা, বান্দরবন শহর, দোহাজারি হয়ে ১৬০ কিমি: পাড়ি দিয়ে আরও ছোট-খাট ৭টি নদী সহ বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। সাধারণত আমাদের দেশের সব নদী উত্তর-দক্ষিণে গিয়ে সাগরে পতিত হয়েছে। কিন্তু একমাত্র সাঙ্গু নদীই উত্তর-দক্ষিণে না গিয়ে পূর্ব-পশ্চিমে গিয়ে সাগরে পতিত হয়েছে। আর পাহাড়ি নদী বিধায় এ নদী কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ বটে। কারণ যেকোনো মুহুর্তে হরকাবান হতে পারে। আর চলতি পথের পাথর সাঙ্গু নদীকে এনে দিয়েছে নতুন মাত্রা। এ নদীতে চলতে গেলে আপনার চোখে পড়বে পাহাড়-নদী আর নীল আকাশের এক অদ্ভুদ মিতালী। আমরা ৮ জন ভাগ হয়ে বিশেষ ধরণের দুটি নৌকায় উঠলাম। এই যাত্রার বিশেষত্ব হলো প্রচণ্ড স্রোতের প্রতিকূলে নিচ থেকে উপরে উঠতে হবে। পাহাড় থেকে নেমে আসা পানি এই নদীকে বিপদজনক করে রাখে। প্রত্যেকে আমরা নিজ নিজ লাইফ জ্যাকেট পরে পাহাড়ী এই নদী অতিক্রম করতে লাগলাম। প্রচন্ড স্রোতে নৌকার তলায় আছড়ে পড়া ঢেউয়ের ছিটায় বারবার ভিজতে লাগলাম। প্রথমদিকে খুব ভয় লাগলেও মাঝিদের দক্ষতায় নিমেষেই ভয় কেটে গেলো। এভাবেই কিছু সময় পর বিজিবির নৌ ফাঁড়িতে আবারও অনুমতির জন্য থামলাম আমরা। এরই মধ্যে পাশ কাটিয়ে এসেছি কুমারি ঝর্ণা ও নিলুক ঝর্ণা, যা আমরা ফিরতি পথে দেখবো ইনশাআল্লাহ। আমাদের উদ্দেশ্য ছিলো আজকে দিনের মধ্যে জিনাপাড়া পৌঁছানো।
আবার শুরু হলো যাত্রা। রেমাক্রি যাবার পথে একটা বাজার পাওয়া যায়। নাম তিন্দু বাজার। তিন্দুপাড়ার নামানুসারেই এ বাজারের নাম। এটি একটি মারমাপাড়া। যাত্রা পথে অনেকেই এখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়। তিন্দুবাজার অনেকটা চারকোনা টাইপের। এখানে আছে তিন্দু ঝিরি। হাতে সময় থাকলে এখানে যাওয়া যায়।
কিছুদুর যেতেই চোখের সামনে আসলো বড় বড় পাথর। বুঝতে দেরি হলো না আমরা এসেছি ‘বড় পাথর’ এলাকায়। যাত্রাপথের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক জায়গা হলো এই বড়পাথর। এখানে রয়েছে বিশালাকৃতির বেলেপাথর। এই জায়গাটা নিয়ে কিছু মিথ আছে। বহুল প্রচলিত মিথটি হলোÑতিন্দু অঞ্চলে খুমিদের এক রাজা ছিলো। একবার এই তিন্দু রাজার সাথে দতং রাজার যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে দতং রাজা জয়ী হয় এবং তিন্দুর রাজা পরাজিত হয়ে রাজ্য ত্যাগ করে। এরপর রাজা পরাজয়ের গ্লানি সহ্য করতে না পেরে তার রাণী-সভাসদসহ শঙ্খ নদীতে জীবন বিসর্জন দেয়। কিন্তু শঙ্খ নদী রাজাসহ তার পুরো পরিবারবর্গকে বাঁচিয়ে আশ্রয়দান করেছে পাথর বেশে। তাইতো তার কোনোটি রাজাপাথর, কোনটির নাম রানীপাথর, কলসী পাথর, থালা মুকুট ইত্যাদি। এই জায়গাটি স্থানীয়দের কাছে ধর্মীয়ভাবে পবিত্র। বড় পাথর এলাকায় সবচেয়ে বড় যেই পাথরটি আছে, সেটিই রাজাপাথর। ধারণা করা হয় এটিই সেই তিন্দু রাজা। বর্ষায় বড় পাথর এলাকায় সব পাথর ডুবে গেলেও এই রাজা পাথরই সগৌরবে দাড়িয়ে থাকে। স্থানীয়রা এখানে যাত্রাপথে বড়পাথরে টাকা পয়সা দিয়ে থাকে। অনেকে প্রার্থনাও করে থাকে। এই জায়গাটা একটু বিপদজনকও বটে। সাঙ্গুতে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার বেশিরভাগই ঘটে এই বড় পাথর এলাকায়। স্রোতের বিপরীতে চলা নৌকা এখানকার ডুবো পাথরে ধাক্কা খেয়ে উল্টে যায় কখনো কখনো।
দেখতে দেখতে চলে এলাম রেমাক্রি জলপ্রপাত। এতো বিশাল যায়গাজুড়ে এই জলপ্রপাত সত্যিই অসাধারণ। রেমাক্রি জায়গাটার বিশেষত্ব হলো এখানে রেমাক্রি নদী ও সাঙ্গু নদী একসাথে মিশেছে। রেমাক্রি নদী সাঙ্গুর সাথে মেশার কিছু পূর্বে ৪-৫ টি ধাপে সিড়ির মতো করে নেমেছে এবং পরে সাঙ্গুর সাথে মিশেছে। এই ধাপগুলোই এনে দিয়েছে এক বৈচিত্র্য, যার নাম ‘রেমাক্রি জলপ্রপাত’। কথিত আছে রেমাক্রি জলপ্রপাতকেই একসময় বাংলাদেশের নায়াগ্রা বলা হতো। এখান থেকে যদি সাঙ্গু ধরে যাই তবে দেখা মিলবে বড়মোদক, ছোটমোদক, আন্দারমানিক ইত্যাদি জায়গা। আর রেমাক্রি নদী ধরে গেলে পাবো নাফাখুম, আমিয়াখুম। রেমাক্রির মানুষেরা অধিকাংশই মারমা। এখানে অবস্থিত রেমাক্রি বাজারটা তিন্দুবাজারের মতোই অনেকটা চারকোণা। দেখছিলাম আর কেবলই ভাবছিলাম নিজ দেশের এই প্রাকৃতিক নৈস্বর্গিক দৃশ্য দেখতে আরো আগেই কেন আসা হয়নি।
রেমাক্রি নদী ধরে এগুতে থাকলে একসময় পাওয়া যাবে নাফাখুমকে। পুর্বের নৌকাটি ছেড়ে দিয়ে জলপ্রপাত এর উপরের অংশে গিয়ে আবার নৌকায় উঠলাম। এবারের যাত্রা নাফাখুম। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর বিশালাকৃতির পাথরের বেষ্টনি নৌকার গতিপথ আঁটকে দিলো। কিন্তু আমাদের মনোবল আটকানো এতো সহজ নয়। আমরা নেমে নদীর পাড় ধরে হাঁটা শুরু করলাম। এই হাঁটা সাধারণ হাঁটা নয়। উঁচুনিচু পথ, বিভিন্ন আকৃতির পাথর আর ছোট ছোট পাহাড়ি ঝিরি ডিঙ্গিয়ে প্রায় দুই ঘন্টার হাঁটা শেষে বিকাল তিনটা নাগাদ আমরা পৌঁছলাম নাফাখুম জলপ্রপাত। ঝুলন্ত সেতুর উপর থেকে জলপ্রপাতকে অপলক দেখছিলাম সবাই। মুহুর্তেই সকল ক্লান্তি উধাও। এই জলপ্রপাতের গর্জন যেন এতক্ষণের ক্লান্তি মুছে দিল। এটি মূলত রেমাক্রি নদীরই অংশ। রেমাক্রি নদীর বহমান পথের একটি জায়গায় হুট করে ১৫-২০ফুট উচু থেকে চলমান জলধারা লাফিয়ে লাফিয়ে পড়ছে আর ওটাই নাফাখুম জলপ্রপাত। এটি প্রায় ৪০ফুট প্রশস্ত। এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ২৬০ ফুট উপরে। নাফাখুম মারমা শব্দ এর নাফা-অর্থ গরু-মহিষের নাকের দড়ি। আর খুম মানে হল জলপ্রপাত। নাফাখুমে গেলে চোখে পড়বে বিশাল বিশাল গর্ত। একসময় এখানে প্রচুর মাছ পাওয়া যেতো। সেই মাছের নাকে দড়ি বেঁধে এই গর্তে রাখা হতো। এভাবেই ভাষার বিবর্তনে এর নাম নাফাখুম। পাশের দোকান থেকে পাহাড়ি পাকা কলাসহ হালকা নাস্তা সেরে এবারে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম আসল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার। কারণ আমাদের গাইড এরই মধ্যে ধারণা দিয়েছে আমাদের জন্য আসল চ্যালেঞ্জ জিনাপাড়া পৌঁছানো, আর দেবতা পাহাড় ট্রেকিং। আমরা শুরুতে নাফাখুম পাড়ায় না থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম জিনাপাড়ায় রাত কাটানোর।
যে যার মত করে ছবি তুলে কিছুক্ষণ পর আমরা রওনা করলাম অজানা, অচেনা এক পথে। লক্ষ দেবতা পাহাড় পেরিয়ে আমিয়াখুম, ভেলাখুম, সাতভাইখুম, নাইক্ষ্যংমুখ। রাতে আমরা থাকতে চাই জিনাপাড়ায়। ট্র্যাকিং শুরু হল আঁকাবাঁকা পাহাড়ী রাস্তা ধরে। হাটতে থাকলাম, অজানা অচেনা পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে, নদীর তীর ধরে কোথাও হাটু পানি। কোথাও গলা পানি, কোথাও আবার বিশাল পাহাড়, কোথাও কাদামাটি, কোথাও পাহাড়ি খাদ। কোথাও কোন যায়গা নাই পা ফেলবার, তারপরেও হাঁটতে থাকলাম। এ যেন অনন্তকালের অচেনা এক পথ। যে পথের শেষ বলে কিছু নেই। হঠাৎই বিপদ হলো সাথে থাকা পানি শেষ। কারো কাছেই আর এক ফোঁটাও পানি অবশিষ্ট নেই। গাইড আমাদের অভয় দিলো। একটু সামনে এগিয়ে ঝিরি থেকে নেমে আসা পানিতে বোতল ভরিয়ে নির্ভয়ে তা পান করতে বললো। পরবর্তী পুরো সময় জুড়েই আমরা এই ঝিরিগুলোর পানি খেয়েছি। দিন শেষে সন্ধ্যা নামলো। সুর্য মামা আমাদের বিদায় দিয়ে হারিয়ে গেলো নাম না জানা কোন পাহাড়ের আড়ালে। পাহাড়ে একটু আগেভাগেই সন্ধ্যা নামলো মনে হয়। তাও আবার শহরের মতো ধীরে ধীরে নয়। হঠাৎই অন্ধকার হয়ে উঠলো চারপাশ। ঘন কালো অন্ধকার।
পাহাড়ের এই আবছা গুমোট অন্ধকারে সাথে থাকা টর্চের আলোয় এগোতে থাকলাম গাইড জর্জের দেখানো পথ ধরে। জর্জ আমাদের আশার বাণী শুনিয়ে পেরোতে থাকলো একটার পর একটা পাহাড়। চারপাশে ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকার। কোথাও কোন শব্দ নেই। পাহাড়ি বনের ঘন আচ্ছাদন ছেদ করে পুর্ণিমার চাঁদটা যেন আমাদের খুঁজেই পাচ্ছেনা একটু আলো দিবে বলে। হঠাৎই দুরে একটু আলোর দেখা পেয়ে হাটার গতি বাড়িয়ে দিলাম আমরা। একটা ঝুমঘরে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে সাথে থাকা শুকনো খাবার খেয়ে আবার হাঁটতে থাকলাম। একসময় পাশে থাকা নদীর পাড়ে এসে দাড়িয়ে পড়লো আমাদের গাইড। প্রচন্ড স্রোতস্বিনী এই নদী পার হতে হবে এবার। সাহস সঞ্চয় করে রিতিমত বাধ্য হয়েই এক বুক পানি ডিঙ্গিয়ে সাথে থাকা ব্যাগ মাথায় নিয়ে সাবধানতার সাথে নদী পার হলাম আমরা। কিছুদূর এগিয়েই ঝিরি থেকে গোসল করে পৌঁছে গেলাম জিনাপাড়া।
রাত তখন আটটা। এ যেন একফালি সস্তির নিঃশ্বাষ। মাচাং ঘরে বাঁশের চাটাইকেই সোনার পালঙ্ক মনে হচ্ছিলো। রাতটা অন্তত এখানেই থাকতে পারছি। পাহাড়ি ঘরগুলো মাচা টাইপের হয়। দোতলা ঘরে মাচার উপর থাকার ব্যাবস্থা হলো। উঠে বসলাম। সবাই ভেজা কাপড় পরিবর্তন করে নিলাম। লম্বা এই প্রতিকুল রাস্তায় একটানা হেঁটে অনভ্যস্থ এই আমরা তখন ব্যাথায় প্রায় নিস্তেজ। আমরা রাতে ভাত, ডাল, আলু ভর্তা আর ডিম খেতে চাইলাম। তারপর কিছ্ক্ষুণ পাহাড়ের চুড়ায় থেকে চারিদিকের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করলাম। সভ্যতার বাইরে নেটওয়ার্কহীন, বিদ্যুৎহীন এক আদিম যায়গায় নিজেদের অস্তিত্ব আবিষ্কার করলাম। এই অভিজ্ঞতা খুবই ভয়ানক! নাকি রোমান্সকর! নাকি অন্যকিছু! মোবাইল নেটওয়ার্ক এর অনুপস্থিতি সবচেয়ে বেশি পিড়া দিচ্ছিলো সবাইকে। সাথে থাকা মেহেদী এই গভীর রাতেই বাড়ি ফিরতে তোলপাড় শুরু করে দিলো। মনে মনে হয়তো কি না কি ভাবছিলো। অজানা আতঙ্কে কুঁকড়ে যাওয়া মেহেদীকে শান্ত করতে নানা বাহানায় অবশেষে বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন সাথে থাকা কলেজ শিক্ষক প্রভাষক মনজুর আহমেদ জুয়েল ভাই। মনে রাখতে হবে আমরা পাহাড়ে মেহমান হিসেবে যাই। আর ওরা ওখানে সব সময় থাকে। তাই আমাদের এমন কিছু করা উচিত না যাতে ওরা বিরক্ত হয়। তাদের প্রাইভেসির যথাযথ সম্মান দেয়া উচিত।
এরই মধ্যে রাতের খাবার চলে এসেছে। জুমে চাষ করা লাল চালের ভাত, ডিম, ডাল আর আলুভর্তা। সবাই রিতিমত হামলে পড়লো খাবারের উপর। সারাদিনের ক্লান্তি আর পরের দিনের দেবতা পাহাড় ট্র্যাকিং এর কথা ভেবে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘর থেকে একটু দূরে থাকা টয়লেট ব্যাবহার করতে রাতে বের হয়ে আমিতো অভিভুত। উঠোন জুড়ে মেঘেদের হাতছানি। পূর্ণিমার চাঁদের আলো যেন গলে গলে পড়ছে লালমাটির উঠোনে। এ যেন স্বর্গীয় কোন আবেশ। ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করছিল না একদম।
খুব ভোরে ঘুম ভাঙ্গলো। ভ্রমণে গেলে আমি কখনোই সুন্দর সকালটা ঘুমিয়ে কাটাইনা। বরং তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে সকাল সকাল উঠে চারপাশের সৌন্দর্য অবলোকনের চেষ্টা করি। তাই সকালে খুব তাড়াতাড়ি উঠে বেরিয়ে পড়লাম জিনাপাড়া দেখার জন্য। দেখলাম নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত মানুষগুলোর জীবন সংগ্রাম। মিয়ানমার সীমান্তের কাছে এক পাহাড় চূড়ায় এই জিনাপাড়া। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ৪৬০ ফুট উপরে। জিনা ছিলো এক কারবারি। তার নামানুসারে পাড়াটির নাম। জিনার সাথে আরেক কারবারি ছিলো নাম রায়বাহাদুর। জিনা বাংলাদেশ ছেড়ে ইন্ডিয়া চলে যায় এবং ওখানেই মারা যায়। এরপর এখানকার হেডম্যান হয় রায়বাহাদুর। এখানে কয়েকটি পরিবারের বসতি। পাড়াটা দুর্গম হলেও পাইপ লাইনের মাধ্যমে পানীয়জলের ব্যবস্থা আছে। আগের দিন দুর্গম পথে ট্রেকিং করে রাতে অঘোরে ঘুমিয়েছি সবাই। সূর্যোদয়ের পর বাইরে বেরিয়ে দেখি পাড়ার লোকজন কাজে যাচ্ছে। জুমের মৌসুম চলছে বলে ব্যস্ততা বেশি। আহার জোগাড়ে কত যে সংগ্রাম করতে হয় এদের, চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। পাহাড়িরা জুম চাষের জন্য রওনা দিচ্ছে। হাতে পিওর তামাক, কাধে জুমের ঝুড়ি। দূরে জুম ঘর।
এরই মধ্যে আমাদের সবাই উঠে পড়েছে। যাত্রা শুরু দেবতা পাহাড়ের দিকে। এখানে আমাদের গাইডের পরিবর্তন হলো। নতুন গাইডের নাম বলি ত্রিপুরা। খাওয়ার জন্য গাইড বলি চেঁচামেচি করছে। সবাই ভাত, ডিম আর ডাল দিয়ে নাশতা সারলাম। আমাদের গন্তব্য অমিয়াখুম। জিনাপাড়া থেকে সামনে যেতেই একটা রুক্ষ খাড়া পাহাড়ি পথ। সাপের মতো প্যাঁচানো রাস্তাটা চূড়ায় এসে মিলিয়ে গেছে। ততক্ষণে সুর্যি মামাও উত্তাপ ছড়ানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে। কয়েক কদম হাঁটতেই ঘামে ভিজে একাকার। আগের দিন চোট পাওয়া পেশির ব্যথা বেড়েছে। বলির সাথে আমরা রওনা হলাম লাল পাহাড়ের গা বেয়ে। সকাল সকাল হাটু যেন বিদ্রোহী হয়ে উঠতে চাইলো। সাথে থাকা সকলের একই অবস্থা। ওসব ভাববার সময় নেই। যেতে হবে বহুদূর। অজানা রাস্তায় শত ক্লান্তি আর ভয় মাথায় নিয়ে পার হচ্ছিলাম একটার পর একটা পাহাড়। কাজুবাগান, ধানের ক্ষেত মাড়িয়ে বিশাল বিশাল খাদগুলো যেন দেখেই শরীর শিউরে উঠছিলো। চলে আসলাম দেবতা পাহাড়ের চুড়ায়। এই সেই দেবতা পাহাড় যে পাহাড় সবাইকে ভয় লাগিয়ে দেয়। এই পাহাড় খুবই খাড়া। আমাদের দেবতা পাহাড় আসতে সময় লাগলো প্রায় দেড় ঘণ্টার মতো। টং দোকানে রং চা খেয়ে এবার নামার পালা।
একটা কথা বলা হয়ে থাকে-যে দেবতা পাহাড় বাইতে পারে সে বান্দরবান এর সকল পাহাড়ই বাইতে পারবে। আমিয়াখুম, সাতভাইখুম, ভেলাখুম, নাইক্ষিয়্যাং যেতে হলে এই পাহাড় অতিক্রম করতে হবেই। দেবতা পাহাড়-নাম শুনেই এর ধরণ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা করা যায়। এর উচ্চতা প্রায় ১১৫০ ফুট। এই পাহাড়ে আসতে হলে অতিক্রম করতে হবে আরো তিনটা পাহাড়। আর আমিয়াখুম দেখতে হলে নিচে নামতে হবে ৩৫০ ফুট এর মতো। আসলে ৩৫০ ফুট খুব বেশি না হলেও এটি নামতে লাগে প্রায় ২ ঘণ্টার মতো। কারণ নামতে হয় হেলে পড়া পাথরের দেয়াল বেয়ে। এটি এতটাই খাড়া যে এখানে প্রতিটি পদক্ষেপ দিতে হয় সাবধানতার সাথে। নতুবা চলে যেতে হবে একেবারে ১০০-১৫০ ফুট নিচে। আর ভাগ্য খারাপ হলে তো কথাই নেই। দেবতা পাহাড়ের পাদদেশেই আছে সেই অপার্থিব ‘আমিয়াখুম’। আর সবচেয়ে উঁচুতে উঠলে দেখা যাবে, দতং পাহাড়। এর পাশের তাজিংডং পাহাড়, সাকা হাফং, যুগি যৎলং, বড়মোদক ইত্যাদি। আর এর নিচের অংশে পাহাড়ের গায়ে রয়েছে ট্রপিক্যাল ফরেস্ট। খুব ভালো করে খেয়াল করলে এখানে পাম ট্রিও দেখা যাবে। এখানে বড় বড় মৌচাকও দেখা যায়। বলা হয় দেবতার পাহাড়ে নামা কঠিন, উঠা তুলনামূলক সোজা। সামান্য একটু ভুল পদক্ষেপে একবারে ভবলিলা সাঙ্গ হতে পারে। পথের পাশে প্রায় দেড়শ ফুট গভীর খাদ। পড়লে আর বেঁচে ফেরার আশা নেই। যাই হোক সৌন্দর্য দেখতে হলে কষ্টতো একটু করতেই হবে। সাবধানে নামা শুরু করলাম আমরা। যেহেতু খুব সাবধানে নামলাম আমাদের নামতে লাগলো প্রায় দেড় ঘণ্টার মতো। এখানে শারীরিক সক্ষমতায় সাথে থাকা টিনেজার আল আমিন আর শাফায়াত ছিলো এগিয়ে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই ওরা পেরিয়ে যাচ্ছিলো একটার পর একটা বাধা।
যখন আমরা সবাই নিচে নামলাম তখন আবার এই পথে ফেরার কথা চিন্তা করে কেমন যেন গা শিউরে উঠল। যাই হোক ওই চিন্তা বাদ দিয়ে এবার ডানের পথ দিয়ে চলা শুরু করলাম। কিছুক্ষণ পাথর বেয়ে চলার পর চোখের সামনে ‘ভেলাখুম’। দুর্ভাগ্য আমাদের, বর্ষার পানির তোড়ে ভেলা ভেসে গেছে। ভেলাখুমেও বড় বড় পাথুরে খাজের মাঝে বহমান জলধারা। এখানে ভাগ্য ভালো থাকলে দেখা যাবে, বানর। তবে সাবধান থাকতে হবে, কারণ বানর উপর থেকে এটা ওটা ছুড়ে মারে। আরও ভাগ্য ভালো থাকলে দেখা যেতে পারে, বন ছাগল, যেগুলা কিনা খাড়া পাথুরে পাহাড় বাইতে পারে। ভেলাখুম ধরে একটু সামনে এগোলেই ‘নাইক্ষিয়্যাংমুখ’। নাক্ষিয়্যাংমুখের পরের অংশ হলো ‘নাইক্ষিয়্যাং’। আমাদের আর নাইক্ষিয়্যাং যাওয়া হয়নি। তবে আপনারা যারা এখানে আসবেন অবশ্যই নাইক্ষিয়্যাং দেখে যাবেন। কারণ আবার কবে না কবে আসেন। এই জীবনে আর যাওয়া হয় কিনা কে জানে!
এবার উল্টোদিকে প্রায় দশ মিনিট হেঁটে চলে আসলাম ‘আমিয়াখুম’ এটিও মূলত রেমাক্রি নদীর আরেক আশ্চর্য! রেমাক্রি নদী এখানে এসে গোল করে ২০ ফুট উচু থেকে লাফিয়ে পড়ে। একে বাংলার ভূস্বর্গ বলে অভিহিত করা হয়। কারও মতে এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর জলপ্রপাত। আমিয়াখুমে বেশকিছু সময় পার করলাম। বড় বড় পাথরে দাড়িয়ে পাহাড়ি বুনো সৌন্দর্য দেখলাম। দেখলাম পাশের খাড়া দেবতা পাহাড় যা আমরা বেয়ে নামলাম একটু আগেই। এক নিমেষের জন্য যেন সকল কষ্ট ভুলে গেলাম। প্রকৃতির আপন মহিমায় নিজেকে স্বপে দিলাম। আর কল্পনা করলাম, মহান রাব্বুল আলামিনের সৃষ্টি কতই না সুন্দর। এখানে সকল টিমমেট রা হই হুল্লুড় করলাম। যে যার মত করে ছবি তুললাম। টুরের সার্থকতা যেন এখাানে এসেই খুুঁজে পেলাম। এখান থেকে একটু সামনে এগোলেই ‘সাত ভাই খুম’। দুই পাহাড়ের মাঝে এই সাত ভাই খুম প্রায় ৪০-৫০ ফুট গভীর। এখানে রয়েছে বড় বড় সাতটি পাথর। এই সাতটি পাথর হলো সেই তিন্দু রাজার সাতটি ছেলে। এখানে নাকি সাত ভাই সবসময় খেলা করতো। এরপর ভেলা দিয়ে কিছুদূর এগুলে চোখে পরবে সাত ভাইয়ের নাক। এই জায়গাটা হলো আসলে পাথুরে খাজের মাঝে বহমান জলধারা।
এরপর আমরা আবার চলে আসলাম দেবতা পাহাড় এর নিচে। এবার উঠার পালা। খুব দ্রুতই যেন সবাই উঠে গেলো। উঠতে আমাদের সময় লাগলো এক ঘণ্টার মতো। সবাই যখন দেবতা পাহাড়ের মাথায়, তখন মুখে বিজয়ের হাসি। কোনো এক অদৃশ্য বেড়াজাল হতে সবাই বেরিয়ে আসলো যেনো। এরপর পাশের একটি পাহাড় বেয়ে চলে গেলাম নিকোলাস পাড়ায়। এখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। লম্বা সময় পর মোবাইল নেটওয়ার্ক পেয়ে সবাই যেন হাঁফ ছাড়লো। পাশেই একজন আদিবাসীর সাহায্য নিয়ে জানতে পারলাম যে এখান থেকে নাকি তাজিংডং দেখা যায়। দেবতা পাহাড়ের পাশে আছে আরেক পাহাড় দতং, এই দতং পাহাড়ের পরের যে পাহাড়টা সেটাই হলো তাজিংডং। আর আরকটু পূর্ব দিকে তাকালে আরেক পাহাড় দেখা যায়, ওটাই সাকা হাফং, এরপাশে রয়েছে জুগি যতলং, বড়মোদক, ছোটমোদক। হাতে সময় থাকলে এগুলো দেখে গেলেই ভালো। বলা যায় না, আবার হয়তোবা পাহাড় আপনাকে টেনে আনতেই পারে! যে পথে আসলাম সেই পথেই ২টা পাহাড় পেরিয়ে থুইসাপাড়ার পাস দিয়ে পৌছালাম জিনাপাড়ায়। থুইসাপাড়া তৈরি করেন থুইসা নামক এক ব্যাক্তি। উনি এখনও বেঁচে আছেন। কাপ্তাই বাঁধের কারণে ওখানকার অনেক এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় থুইসা এখানে জমি কিনে এই পাড়া গড়ে তোলেন ১৯৭৯ সালে। আর তাই ওনার নামানুসারে পাড়ার নাম হয়-‘থুইসাপাড়া’। পরবর্তীতে ১৯৮৯ সালে থুইসা এবং থুইসাপাড়ার মানুষজন সহ নির্মাণ করে জিনাপাড়া বিজিবি ক্যাম্প, যা এই এলাকার সর্বশেষ ক্যাম্প। কটেজে ফিরে সাথে থাকা সোলায়মানের রক্তাক্ত পা দেখে আমরা রিতিমত আঁতকে উঠি। জোঁকের কামড়ে পায়ের অবারিত রক্তের ধারা কিছুতেই বন্ধ হচ্ছিলো না। সাথে থাকা প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম কাজে লাগলো অবশেষে।
তখন বেলা তিনটা। এখনই বেরিয়ে পড়তে হবে। আজ রাতে আমরা থাকবো নাফাখুম পাড়ায়। দ্রুত খাওয়া দাওয়া শেষ করে একটু বিশ্রাম নিয়েই বেরিয়ে পড়লাম। পাহাড় ট্রেকিং করার সামান্য শক্তিও আমাদের অবশিষ্ট নেই। নদীর পাড় ধরে এগোতে এগোতে একসময় থামতে হলো আমাদের। খাড়া পাহাড়ের দেয়াল সামনে। এগোনো অসম্ভব। হয়তো পাহাড় ডিঙাতে হবে অথবা নদী পার হয়ে ওপার দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। আমরা পাহাড় ট্রেকিং পাশকাটাতে প্রবল স্রোতময় নদী পার হয়ে আসার ভয়ানক সিদ্ধান্ত নেই। প্রত্যেকে একে অপরকে শক্ত করে ধরে নদী পার হতে লাগলাম। এখানে প্রতিটি পদক্ষেপ যেন মৃত্যুপুরি। প্রবল স্রোতের সামনে পা টিকিয়ে রাখা যেন জীবন যুদ্ধ। আল্লাহর রহমতে আমরা প্রথমবার সফলতার সাথে নদী পার হতে সক্ষম হই। প্রথমবারের সফলতায় দ্বিতিয়বার একটু গা ছাড়া ভাব চলে আসে সকলের মধ্যে। যে যার মতো করেই পার হচ্ছিলো সবাই। আমার সামনেই হালকা গড়নের আয়মান সাঈদ। মাঝনদীতে এসে তার ভাবভঙ্গি দেখেই বুঝলাম বিপদে পড়েছে সে। পিছন থেকে তার টিশার্ট খামচে ধরলাম। এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম আমরা। প্রায় চার ঘন্টার বেশি সময়ের ট্র্যাকিং শেষে নাফাখুম পাড়ায় এসে পৌঁছাই। নাফাখুম পাড়া একটু শোরগোল পাকানো। এখানে অনেক টুরিষ্ট এসে ভিড় জমায়। তবে এই জায়গার বিশেষত্ব হলো চাঁদের আলোয় জলপ্রপাতের গর্জনে নিজেকে অজানা কোন রাজ্যে যেন হারিয়ে নিয়ে যায়। সারারাত নাফাখুমের গর্জন কানে বাজিয়ে প্রশান্তির ঘুম যেন স্বর্গীয় আবেশ এনে দেয়। এ যেন পরম যত্নে প্রকৃতির বুকে মাথা রেখে দুঃখ ভাগের যায়গা। এ যেন সুখময় আরাধ্যগুলো খুজে পাবার যায়গা। সব ভালোলাগা যেন এখানেই এসে মিলিত হয়। রাত ভোর হলো। আমাদের পথচলা পুনরায় শুরু।
আজ আমাদের ভ্রমণের শেষ দিন। এটি চিন্তা করতেই কেমন যেন লাগছিলো। খুব সকালে বের হয়ে নাফাখুম জলপ্রপাতের পাশের স্থানীয় দোকান থেকে ডিম, সেদ্ধ ভুট্টা আর চা খেয়ে শুরু হলো হাঁটা। প্রায় ঘন্টাখানেক হাঁটার পর আমাদের জন্য অপেক্ষারত নৌকা পেয়ে গেলাম। নৌকা দুবার পরিবর্তন করে পোঁছলাম রেমাক্রি। এখানকার বিজিবি ক্যাম্পে আবারও রিপোর্টিং শেষে আমরা নৌকাযোগে চলে আসলাম নিলুক ঝর্নায়। নিলুক ঝর্নার একদম কাছে যেতে হলে বেশ কিছু দুর পাহাড় ট্রেকিং করতে হয়। আমাদের কারোরই সে শক্তি অবশিষ্ট ছিল না। তাই দূর থেকেই নিলুক ঝর্ণার ছবি তুলে রাখলাম। এরপর চলে আসলাম কুমারি ঝর্নায়। এটি সাঙ্গু নদীর পাড়েই। কুমারি ঝর্ণা উপভোগ শেষে পৌঁছলাম থানছি। গাইড জর্জকে বিদায় দিয়ে এবার আমরা চাঁদের গাড়ীতে। উদ্দেশ্য বান্দরবান। বলিপাড়া বিজিবি চেকপোস্টে ফিরতি রিপোর্টিং শেষে আমরা আবারও যাত্রাপথে। পথে ঘটে গলো ছোটখাটো দুর্ঘটনা। অবশ্য বড় কিছুও হতে পারতো। বিপরীত দিক থেকে আসা অল্পবয়স্ক চালকের আনাড়িপনায় দুই চাঁদের গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষ। আমাদের চালকের সতর্কতা আর মহান সৃষ্টিকর্তার কৃপায় এ যাত্রায় আমাদের কিছুই হয়নি। চিম্বুক পাহাড়ের সেনাক্যাম্পের সামনের ক্যান্টিনে আমরা দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। বান্দরবান শহর পেরিয়ে আমরা গেলাম নীলাচল। আসলে যারা বান্দরবানের গহিনে গিয়েছে তাদের কাছে এসব সৌন্দর্যকে তুচ্ছ মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। নীলাচলে গেলাম দিনের সূর্যাস্ত দেখতে। এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২০০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত। এর আরেক নাম হল টাইগার হিল। এখান থেকে রাতের বেলার বান্দরবান শহর দেখা যায়। কিন্তু, সবচেয়ে ভালো লাগে নীলাচলের বিকালের প্রাকৃতিক নির্মল ঠাণ্ডা বাতাস। নীলাচলের নিচে রয়েছে একটি বড় গুহা। যার মধ্যে আছে আরো তিনটা গুহা। কথিত রয়েছে এখানে নাকি ছবি তুললে ছবি আসে না। এই গুহার নাম হলো-মহাদেবের গুহা। মহাদেব নামক এক লোক এই গুহা আবিষ্কার করেন বলে এর নাম হয় মহাদেবের গুহা। নীলাচল এর বিকেলের পরিবেশটা বেশ ভালোই লাগলো। এরপর আবার ফিরে আসলাম শহরের বাসস্ট্যান্ডে। রাতের বাস ধরে ফিরে আসলাম আবার সেই জনবহুল, ব্যস্ততম নগরীতে।
আজ,
বুধবার , ৪ অক্টোবর, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ , ১৯ আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম:
প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।