যখন বিদ্যমান রাজনৈতিক গোষ্ঠি কোন দেশের জনসমষ্টিকে স্বস্তি দিতে পারে না, তখন সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি তথা সর্বক্ষেত্রে স্থবিরতা, যুক্তিহীনতা, অন্যায় ও অমানবিকতা উক্ত জনগোষ্ঠির বৃহতাংশ মানুষকে হতাশ করে দেয়। যার ফলে বেঁচে থাকা এবং এগিয়ে চলার আশায়-আশ্বাসে মানুষ শুভ্র, নিষ্কলঙ্ক নতুন দিনের প্রত্যাশা করে। তাই বদলে যাওয়া নতুন দিনের জন্য অসহায় মানুষের ব্যাকুল প্রতীক্ষা। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের রাজনীতি কখনো স্থিতিশীলতা নিয়ে যৌক্তিক জায়গায় দাঁড়াতে পারেনি। এ পর্বে আওয়ামী লীগ সরকার তথা মহাজোট সরকারের শাসন ক্ষমতাকালে উন্নয়নের পথে পা দিয়ে দেশবাসী যখন নতুন ও উজ্জ্বল দিনের স্বপ্ন দেখছে, তখনই লাগাম ছাড়া দুর্নীতি-দূর্বৃত্তায়ন রাহুর ছায়া ছড়িয়ে দিচ্ছে সবদিকে।
আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র বলেই বারবার রাজনীতি ও মানব সভ্যতার ইতিহাস বিষয়ক পাঠ নিতে চাই, আনন্দ পেতে চাই, আশাবাদী হতে চাই। আবার ভুল থেকে শিক্ষা নিতে চাই। উনিশ শতকের ইংরেজ ঐতিহাসিক আর্নল্ড জোসেফ টয়েনবি তার বিখ্যাত সূত্র ‘ঞযবড়ৎু ড়ভ ঈযধষষবহমব ধহফ জবংঢ়ড়হংব’ প্রকাশ করেছিলেন। বলেছিলেন, বিরুদ্ধ প্রকৃতি-পরিবেশ সব প্রাণীর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এটিকে মোকাবেলা করতে পারলেই টিকে থাকা, নয়তো হারিয়ে যাওয়া। লাখো বছর ধরে নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে তেলেপোকা টিকে থাকলেও বরফ যুগের অতিকায় প্রাণী ম্যামথ রূপান্তরিত তথা পরিবর্তিত উষ্ণ প্রকৃতির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়েছিল। ফলে নির্বংশ হয়েছে।
আমরাও আমাদের রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক জীবন-সংগ্রামের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছি। তাই চাতক পাখির মতো সকরুণ দৃষ্টিতে চ্যালেঞ্জমুক্ত নতুন দিনের বা ভবিষ্যতের প্রত্যাশা করি। বিএনপি-জামাত পরিচালিত সরকারের সময় অন্যায়-অবিচার-দুর্নীতি সন্ত্রাসের বাড়বাড়ন্ত একটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছিল এ দেশের মানুষকে। রাজনৈতিক সংঘাত ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছিল। সব চরমই ধ্বংস বা রূপান্তরের পথ তৈরি করে। আমাদের সংঘাতের রাজনীতি পথ করে দিল রূপান্তরের। বিবাদমান রাজনীতিকরাই ডেকে এনেছিলেন বিশেষ ধরনের সরকার তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকার। অতঃপর চড়াই-উৎরাইয়ে বড় সাফল্য একটি অবাধ নির্বাচনের পথ তৈরি হওয়া। দীর্ঘ সংগ্রামী ঐতিহ্য ধারণ করা বাঙালির বড় সুবিধাহাজার সংকটের পরও বারবার ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করে। নির্বাচন সামনে রেখে আবার স্বপ্ন তৈরি করে। জোট সরকারের শাসনকালের অপকীর্তি মুক্তমনের ভোটারকে বিক্ষুব্ধ করেছিল। বিপুলসংখ্যক ভুয়া ভোটার তালিকা ও সাজানো নির্বাচন কমিশন এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বিন্যাস অকার্যকর হয়ে যাওয়ায় কার্যত বিএনপি ব্যাকস্ক্রীনে চলে গিয়েছিল। নির্বাচনের মাঠে জামায়াত কখনও খুব একটা ধর্তব্যের মধ্যে থাকে না। অতীতের নানা হতাশার কথা ভুলে গিয়ে মানুষ গণতন্ত্র ফিরে পাওয়ার আশায় স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দানকারী পুরাতন দল আওয়ামী লীগকেই মন্দের ভালো বলে বিবেচনা করেছিল। সবাই ভেবেছিল আন্তরিকতা নিয়েই আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দিন বদলাতে চান। অর্থাৎ সংকাটাপন্ন-জরাগ্রস্ত দিনের শাপমুক্তি ঘটিয়ে একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে টেনে নেওয়ার মতো নতুন দিনের যাত্রা শুরু করবে ‘স্বাধীনতার চেতনাশক্তি ১৪-দল তথা মহাজোট সরকার’। সুন্দর দিনের দেখার স্বপ্নে বিভোর এ দেশের মানুষ সরল হিসাব কষেছিল। ভেবেছিল আওয়ামী লীগ অনুকূল পরিবেশ পেলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় এবং প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে অগ্রণী হবে। অতীতের ভুলগুলো এ বেলা শুধরে নেবে। অন্যায়, দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও দলতন্ত্র বিএনপিকে কীভাবে জনবিচ্ছিন্ন করেছিল আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব সময় নিয়ে কাছ থেকে দেখেছেন। উপরি পাওনা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ পক্ষের শক্তির দলগুলোর ঐক্যের নেতৃত্ব দানকারী দলটি পেয়েছে বিপুল জনসমর্থন। এসব কারণে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই ভেবেছিল, এ দেশের নষ্ট রাজনৈতিক-সংস্কৃতি থেকে জাতি এবার আওয়ামী লীগের হাত ধরে বেরিয়ে আসবে। ইতিবাচক রাজনীতির ধারায় ফিরবে দেশ। দলীয়করণের সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে এবং মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তীতে ঔপনিবেশিক বদলের যেসব কর্তব্য সম্পাদন করা যায়নি তা সম্পন্ন করবে, মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে যেসব বিকৃতি দ্বারা কলুষিত করা হয়েছে তাকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করবে, স্বাধীনতার পরে যে জাতীয় ঐক্যকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া যায়নি তা গড়ে তোলার জন্য ঐতিহাসিক প্রয়োজনে ১৪-দলীয় ঐক্যজোট গড়ে উঠে ও পরবর্তীতে তা নির্বাচনী সমঝোতার মহাজোটে পরিণত হয় তা অক্ষুণ্ন রাখবে। সর্বপরি মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ-শক্তির দেশপ্রেমিক মানুষকে কাছে টেনে বন্ধু বৃদ্ধি করবে। তারপরও দিনবদলে দেয়া কঠিন অথচ মহৎ সংগ্রামে সবাই একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। এ দেশের রাজনীতিতে সুস্থ গণতান্ত্রিক কাঠামো তৈরি হতে না পারায় আইনব্যবস্থাও কখনো স্বাধীন হতে পারেনি। প্রকৃত অর্থে আমাদের দেশের ক্ষমতার রাজনীতি আইনের শাসনকে স্বাধীন হতে দিল না।
চলমান এই বাস্তবতা দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে বেপরোয়া করে তোলে। ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিএনপি’র দুর্নীতিকে উন্মোচন করেছিল। হয়তো ক্ষমতায় থাকার সুবিধা তাদের দুর্নীতিবাজ করে তুলেছিল। আওয়ামী লীগ নেতাদের দুর্নীতির কিছু খতিয়ানও প্রকাশ্যে আসে তখন। তবে বিএন’পির তুলনায় তা ছিল নগন্য। হয়তো ক্ষমতায় না থাকার অসুবিধা এ ক্ষেত্রে কাজ করেছে বললে অত্যুক্তি হবে না। হেভিওয়েট-দুর্নীতিবাজরা সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে আইনের হাতে তখন ধরাশায়ী হয়েছিল। এই ভূমি কম্পের পর এ দেশের স্বপ্নিক মানুষ আশা করেছিল, বিএনপি’র দুর্নীতিবাজদের পরিণতি দেখে অন্যরা শিক্ষা নেবে। কিন্তু বর্তমানে দুর্নীতিবাজরা ঐ শিক্ষা নিয়েছে বলে মনে হয় না। এ কারণে আইনের স্বাধীনতা, সুশাসন ও নিরপেক্ষতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়ে গেছে। অপ্রিয় সত্য এ দেশের প্রায় প্রতিটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে ঘুষ একটি অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের মধ্যে দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। গণমাধ্যমও এর বাইরে থাকতে পারে নাই।
বর্তমান সরকারের সুশাসন প্রতিষ্ঠার সুযোগ থাকলেও তা ব্যবহার করতে পারছে না। এটা সচেতন মহলের জিজ্ঞাসা এবং এটি খুবই হতাশার কথা। আমাদের শঙ্কার জায়গা হচ্ছে, অন্যায়-অবিচার, দুর্নীতি-দূর্বৃত্তায়ন থেকে মুক্ত করে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য এ দেশে এখন তেমন বিকল্প কোন রাজনৈতিক শক্তি নেই। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শক্তি আওয়ামী লীগ ও ১৪-দলীয় জোট এবং এই দলের সরকার ন্যায় ও আদর্শচ্যুত হয়ে দূর্বল হয়ে যাক তা দেশপ্রেমিক সচেতন মানুষ চাইতে পারে না। কিন্তু সাধারণ মানুষ যদি ভাবে তারা প্রতারিত হচ্ছে, দুর্নীতি ও দলতন্ত্র তাদের অধিকার বঞ্চিত করছে, সরকার তাদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছে তা হলে ঘুরে দাঁড়াতে তাদের সময় লাগবে না। দূর্বাত্তায়ন ও দলতন্ত্র কখনও স্বস্তিদায়ক হয় না এবং উন্নয়নের ভবিষ্যৎ আনন্দের চেয়ে যাপিত জীবনের কষ্ট মানুষকে হতাশ করে বেশি।
কাজেই চ্যালেঞ্জ আর সংঘাতের ভেতর দিয়েই বাংলাদেশের রাজনীতির বিকাশ ঘটছে এবং ঘটবে। ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ বা সংকটে যদি কোন রাজনৈতিক দল ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে তা হলে সে দল নতুন এক সুদিনের স্তরে উপনীত হবে। আর যদি সংকট নিরূপণে বা সমাধানে গ্রহণযোগ্য পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয় তা হলে আবার রাজনীতির অরণ্যে ‘চড়ষরঃরপধষ ডরষফবৎংহবংং’– এ হারিয়ে যাবে। এ দেশের হাজার বছরের ইতিহাস সেটিই বলছে।
আজ,
রবিবার , ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ , ৯ আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম:
প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।