রিফাত কান্তি সেন:
বটবৃক্ষ কিংবা ছাদ, যেভাবে সম্মোধন করা হোক না কেন বাবার তুলনা বাবা নিজেই। বাবা ছাড়া যে জীবন মূল্যহীন তা যেন করোনার কালে এসে আরেকবার বুঝলাম। আমার বাবা পেশায় একজন পল্লী চিকিৎসক। রোদ, বৃষ্টি উপেক্ষা করেও দিনের পর দিন সংসারের ঘানি টেনে গিয়েছেন তিনি। ছেড়া জুতা আর দাগ কাটা কত শার্ট যে তিনি পড়েছেন সেটা তিনিই ভাল জানেন। জিজ্ঞেস করলেই বলেন যে এগুলো নাকি তার স্বাচ্ছন্দবোধের জায়গা।
এখনো বাড়ি যেতে দেড়ি হলে ফোনের ওপ্রান্ত থেকে বলে উঠেন ‘কিরে রাত ক’টা বাজে, বাড়ি আইলি না?’ আমি আসতাছি বলেই আবার কয়েক ঘন্টা পার। ঠিকই বাড়ি পৌঁছে দেখি বাবা জেগে আছে। আসলে সন্তানের প্রতি বাবার এ অকৃত্রিম ভালবাসার কারণেই এখনো পৃথিবীটা সুন্দর। করোনার কালে যখন বেকার জীবন কাটাচ্ছিলাম তখন বাবা যেভাবে মনোবল জুগিয়েছেন সেটা সত্যি বলে প্রকাশ করার মত নয়। আমার বাবার নাম বিমল কান্তি সেন- তিনি যেখানে পল্লী চিকিৎসকের কাজ করেন সেখানকার মানুষ ভালবেসে নাম দিয়েছেন, ‘বাবু ডাক্তার’ ছোট বড় সকলেই এক নামে চিনেন বাবু ডাক্তার। যথেষ্ট পরিচিতি তার। জামতলার মানুষ ওনাকে এতটা শ্রদ্ধা করেন যে, বলে বুঝানো যাবে না। আমি সত্যি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি যখন বাবাকে তার রোগীরা প্রাণ ভরে ডাকেন। বাবা এখনো সংসারের ঘানি টানেন। আমি অপায়া বাবাকে তেমন সাহায্য করতে পারি না। আমার মনে আছে করোনাকালে যখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে আমার বেতন বন্ধ হয়ে যায় ঠিক তখন বাবা বলেছিলো, আমি তো আছি। এত চিন্তা কিসের! একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি জানি না সব ঠিক হবে কি না। তবে বাবারা এভাবেই বলেন। সন্তানকে ভাল মানুষ করতে কে না চায় বলুন। আমার বাবারও স্বপ্ন আমি যেন ভাল মানুষ হই। আর সেজন্য আমার কোন চাপ নেই। আমাকে অমুক হতে হবে, তমুক হতে হবে এমন কোন চিন্তাও ওনার মাঝে নেই। তবে তিনি আমার কর্মের কারণে খুবই গর্ববোধ করেন। সেদিন দেখলাম একজনের সাথে আমাকে নিয়ে খুব গর্ব করে কথা বলছেন। আমি পিছন থেকে শুনে মুচকি হাসলাম আর ভাবলাম, বাবা বেশী ভালবাসে বলেই হয়তো ছেলেকে বড় করে উপস্থাপন করতে চায়। আমার মনে আছে একবার আমি লিখতে বসেছি রাত বারোটায়। তিনি আমার সাথে শেষ পর্যন্ত রাত তিনটা পর্যন্ত হারিকেন জ্বালিয়ে বসেছিলেন। ছেলে লিখছে, বাবা দেখছে। এর চেয়ে পরম আনন্দ আর কি হতে পারে।
আমার বাবার অতো অর্থকড়ি নেই। সামান্য উপার্জনের পুরো টাকাটাই ঢালতে হয় সংসারে। আমিও কখনো বাজে চাপ দেইনি বাবাকে। এমনিতেই আমাকে লেখাপড়া করাতে গিয়ে প্রচুর খরচ করে ফেলেছেন যার ফিডব্যাক এখনো বাবাকে দিতে পারিনি। তবে বাবার ভালবাসা সব সময়ই আমার পাশে আছে।
আজ লিখছিলাম বাবা দিবস নিয়ে বাবার গল্প। আসলে বাবার গল্প লিখে শেষ করা যাবে না। একজন বাবা যে কতটা ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকার করে সন্তানকে মানুষ করার চেষ্টা করে যান সেটা তিনিই জানেন। বাবাকে ভালবাসার জন্য নির্দিষ্ট কোন দিনক্ষণ নেই। ভালো থাকুক পৃথিবীর সকল বাবা।
লেখক ও গণমাধ্যমকর্মী।