আবু ইউসুফ:
প্রথমেই বলে নিচ্ছি, আমি ব্যক্তিগতভাবে এবং আমাদের রিচি জাঁহাগীরিয়া দরবার শরিফ, হবিগঞ্জ ফিতনা এড়াতে আবহমান কাল ধরে সারা বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের সাথে সরকারী ঘোষণা অনুযায়ী সকল ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও ইবাদাত-বন্দেগী করে আসছি। কিন্তু বাংলাদেশের হেলাল কমিটির (সৌদির দিকে তাকিয়ে থাকা কমিটি বললেও ভুল হবে না) চাঁদ দেখা নামক প্রহসন নিয়ে আমার কিছু কথা আছে। যা সকল উলামায়ে কেরামের বসে সমাধান করে এক কথার উপরে আসা উচিত বলে মনে করি।
উদাহরণস্বরূপ: ভারতের কাস্মীর ও কলকাতার মাঝে প্রায় ২২০০ কিলোমিটারের দূরত্ব। তারা কী তাহলে দুটো ভিন্ন অঞ্চল হিসেবে নিজেদের এলাকায় স্থানীয়ভাবে চাঁদ দেখে ভিন্ন ভিন্ন দুই দিনে ঈদ ও রোজা, শবে বরাত, শবে কদর, ঈদে মিলাদুন্নবী ﷺ পালন করবে? নাকি তাদের রাজধানী দিল্লীতে চাঁদ দেখা গেলে তারা উভয় অঞ্চলের মানুষই ঈদ করতে পারবে? দেখা যাবে দিল্লী চাঁদ দেখে কলকাতার মুসলমানদেরকে বলছে ঈদ করতে, অথবা কলকাতাতে চাঁদ দেখা গেলে তা দিল্লীতে গ্রহণযোগ্য হল। তাহলে কলকাতার নিকটবর্তী ঢাকার মুসলমানরা কী দোষ করল, তারা কেন দিল্লী কিংবা কাশ্মীরকে অনুসরণ করতে পারছে না? হয়ত কলকাতায় চাঁদ দেখার ভিত্তিতে দিল্লী কাশ্মীরকেও বলছে ঈদ করতে, অথবা কাশ্মীরে চাঁদ দেখে তা দিল্লীতে খবর পৌছাল, তখন কাশ্মীরের নিকটবর্তী পাকিস্তানের কী দোষ? তারা কেন ঈদ করতে পারবে না কাশ্মিরীদের সাথে? এটা কোন সিস্টেম?
আবার কলকাতা ও কাশ্মীরের মাঝে ২২০০ কি.মি. এর দুরত্ব হলে, ঢাকা থেকে পাকিস্তানের দূরত্বও ২২০০ কি.মি। কাজেই বাংলাদেশ ও পাকিস্তান ভিন্ন দুটো অঞ্চল কিভাবে হয়? কিভাবে আমরা ভিন্ন ভিন্ন দুই দিনে এসব ইবাদাত বন্দেগী পালন করব?
এভাবে রাষ্ট্রগুলো আলাদা করা, ভৌগোলিক সীমারেখা নির্ধারণ করা দিবস কেন্দ্রিক ইবাদাত বন্দেগীর ক্ষেত্রে, দিবস কেন্দ্রিক ইবাদাত ও উৎসবের ক্ষেত্রে সারা পৃথিবীর মুসলমানরা বিভক্ত হবে, কোন ইসলাম এটা শিক্ষা দিল?
إِنَّ هَٰذِهِ أُمَّتُكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَأَنَا رَبُّكُمْ فَاعْبُدُونِ
তারা সকলেই তোমাদের ধর্মের; একই ধর্মে তো বিশ্বাসী সবাই (একই উম্মত) এবং আমিই তোমাদের পালনকর্তা, অতএব আমার বন্দেগী কর। (২১ঃ৯২)
তার উপর সুন্নাহতে আসা স্বয়ং হুজুর রাসূলুল্লাহ ﷺ র আমল আমাদেরকে শিক্ষা দেয়, চাঁদের উদয়স্থলের এই ভিন্নতা কোন বিষয়ই না। দূরবর্তী এলাকা থেকে মুসলমানদের চাঁদ দেখার স্বাক্ষী পৌঁছে গেলে সেটা মানতে হবে। নবী করিম ﷺ দূরবর্তী এলাকার মানুষের চাঁদ দেখার স্বাক্ষী গ্রহণ করেছেন, সেই অনুযায়ী আমল করেছেন।
হাদিসখানা গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ার অনুরোধ করছি:
হজরত আনাস ইবনে মালিক রাঃ এর সন্তান আবু উমায়ের রাহঃ বলেন, আমাকে নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার সাহাবিদের মধ্যকার এক চাচা বলেন, একবার শাওয়াল মাসের চাঁদ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে গেল। অতঃপর আমরা রোজা থাকলাম। দিনের শেষ ভাগে একদল আরোহী আগন্তুক আসল (মদিনা শরিফে) এবং স্বাক্ষ্য দিল নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার কাছে, নিশ্চয়ই তারা গতকাল চাঁদ দেখেছে। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সকলকে রোজা ভাংগার আদেশ দিলেন এবং পরের দিন ঈদ নামাজে বের হওয়ার আদেশ দিলেন।
তথ্যসূত্র: আবু দাউদ, হাদিস নং- ১১৫৭, ইবনে মাজাহ হাদিস নং- ১৬৫৩, নাসাই, হাদিস নং ১৭৫৬, মুসনাদ আহমদ, হাদিস নং-২০৬০৩
হ্যাঁ, আমি মানছি সহিহ মুসলিমের হাদিসে কুরাইব বিপরীত কথা বলছে এ বিষয়ে। তবে তা সাহাবি হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এঁর আমল ও কওল। কিন্তু উপরোক্ত হাদিস স্বয়ং হুজুর রাসূলুল্লাহ ﷺ র আমল ও কওল। কাজেই উপরোক্ত ৩ হাদিসের কিতাবের হাদিসখানা অগ্রাধিকার পায়।
তারপর বুখারির হাদিসে কুরাইব এর ব্যাপারে আমরা বলতে পারি যে, সিরিয়াতে কোনদিন রোজা ও ঈদ হয়েছে সে খবর মক্কা শরিফে পৌঁছে নাই তখনকার যুগের যোগাযোগের সমস্যার কারণে। এখন বর্তমান সময়ে কী সেই সমস্যা আছে? নেই। তাহলে এখন কেন এক দেশে চাঁদ দেখার স্বাক্ষ্য অপর দেশে নির্ভরযোগ্য সূত্রে পৌঁছালে আমরা তা মানতে পারব না?
যখন টেলিগ্রাম, টেলিফোন, টিভি রেডিও, ইন্টারনেট কিছুই ছিল না, সেসময় সরকারি তত্ত্বাবধানে রোজা অথবা ঈদের চাঁদ দেখা যাওয়ার পর সংবাদ বাহকদেরকে ঘোড়াযোগে বিভিন্ন দিকে পাঠিয়ে দেয়া হত। তারা যতদূর পারে সেই খবর গিয়ে গ্রামে গ্রামে শহরে শহরে মুসলমানদের নিকট গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসত। এটা বর্তমানে নতুন আবিষ্কৃত জাতি রাষ্ট্র কিংবা ভৌগোলিক এলাকার সাথে সম্পর্কিত ছিল না। মুসলমানদের এক দেশ ছিল। এক মুসলিম শাসকের আন্ডারে। এখন আধুনিক কত কত যোগাযোগ মাধ্যম আবিষ্কার হয়েছে যা ১০০% বিশ্বস্ত। সে সবের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে ১ মিনিটের মাঝেই খবর পৌঁছে দেয়া সম্ভব।
আর সব বিষয়ে আমরা মাজহাব মানি, অপরকে মানতে বলি এবং মাজহাব মানে না বলে আহলে হাদিস সালাফিদের সমালোচনা করি আমরা। কিন্তু চাঁদ দেখার বিষয়ে কেন আমরা নিজেরাই মুজতাহিদ হয়ে যাই? কেন হানাফি মাজহাবের অনুসরণ করি না আমরা? আমাদের হানাফি মাজহাব এবং ইমাম আবু হানিফা রাহ. এঁর মতামতের সবচাইতে নির্ভরযোগ্য উৎস জাহেরুর রেওয়ায়ার মতও এটাই।
দেখুন:
১. ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া বা ফতোয়ায়ে আলমগীরি, খন্ড-১, পৃষ্ঠা- ১৯৮
২. দুররুল মুখতার, খন্ড- ২, পৃষ্ঠা নং -৯২
৩. রদ্দুল মুহতার ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা ৩৯২
৪. বাহরুর রায়েক্ব ২য় খন্ড, ২৭০ পৃষ্ঠা :
৫.কানযুদ দাক্বায়িক ২য় খন্ড,২৭০ পৃষ্ঠা :
৬. ফতোয়ায়ে ক্বাজীখান ১ম খন্ড,১৯৮ পৃষ্ঠা
আমাদের হানাফি মাজহাবের বিখ্যাত এই ফিকহের কিতাবগুলোর কথার সার সংক্ষেপ হচ্ছে, পৃথিবীর পূর্ব প্রান্তে যদি চাঁদ দেখা যায় আর সেই খবর যদি পশ্চিম প্রান্তে পৌঁছে নির্ভরযোগ্য সূত্রে তবে তা গ্রহণযোগ্য। (কমেন্ট বক্সে হানাফী মাজহাবের ১২টি সবচাইতে নির্ভরযোগ্য ফতোয়ার কিতাবের এ সংক্রান্ত ফতোয়ার আরবী ইবারত দিলাম উলামায়ে কেরামের জন্য)। তারপর আমাদের আর বলার কী থাকতে পারে?
যারা সকল বিষয়ে আলা হজরত এর ফতোয়া চান তারা এই বিষয়ে আলা হজরতকে কেন অনুসরণ করেন না? ইমাম আলা হজরত আহমদ রেজা খান বেরেলভি রাহ।