নজরুল ইসলাম আতিক:
চাঁদপুরে একসময় প্রধান অর্থকারী ফসল পাট। সোনালী আঁশ খ্যাত পাট আবাদে উল্লেখযোগ্য ছিলো চাঁদপুর। তবে বর্তমানে পাট আবাদে বিমুখ হচ্ছে এই জেলার কৃষক। উৎপাদন খরচ বেশি এবং কাঙ্খিত দাম না পাওয়ায় দিনদিন আগ্রহ হারাচ্ছেন তারা। গেল বছরের তুলনায় এবছর পাটের দাম কমেছে অর্ধেক। এতে কৃষকদের গুনতে হচ্ছে লোকসান। কৃষি বিভাগ বলছে, প্রস্তুতকৃত আঁশ কিছুদিন সংরক্ষণ করে রাখতে পারলে দাম আরো কিছুটা বাড়বে।
আবাদ খরচের হিসেবে ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় দিন দিন এই ফসল চাষাবাদে আগ্রহ হারাচ্ছে কৃষক। কৃষকদের দাবি, গেল বছর যেখানে প্রতি মন পাটের দাম ছিল ২৮শ থেকে ৩ হাজার টাকা এ বছর তা বিক্রি হচ্ছে ১৫শ থেকে ১৮শ টাকা দরে। অপরদিকে চারা রোপণ থেকে শুরু করে আঁশ প্রস্তুতকরণ পর্যন্ত প্রতি মন পাটে ২ হাজার থেকে ২২শ টাকা টাকা খরচ হচ্ছে তাদের। এতে এবছর পাট চাষে ব্যাপক লোকসানের শঙ্কা করছে কৃষক।
চাঁদপুর কৃষি অফিসের দেয়া তথ্য মতে জেলায় দেশি, তোষা, কেনাফ ও মেস্তা জাতের পাট আবাদ হয়ে থাকে। যা বেশি আবাদ হয় সদর ও মতলব দক্ষিণ উপজেলায়। যদিও গত বছর পাটের দাম ভালো থাকায় চলতি বছর পাট আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ৪০১০ হেক্টর জমিতে থাকলেও আবাদ হয়েছে ৪২১০ হেক্টর জমিতে। যা লক্ষ্যমাত্রার ২শ হেক্টর বেশি। তবে দাম না বাড়লে ভবিষ্যতে এই ফসলের আবাদ নিয়ে চিন্তিত কৃষক।
কৃষি সম্প্রসারণ কেন্দ্র চাঁদপুর কার্যালয় সূত্রে আরো জানা যায়, এ বছর দেশি জাতের পাটের আবাদ হয়েছে ১৭৮৫ হেক্টর জমিতে, তোষা আবাদ হয়েছে ১৭২০, মেস্তা ১৭৫ হেক্টর জমিতে এবং কেনাফ জাতের পাটের আবাদ হয়েছে ৫৩০ হেক্টর জমিতে। যার মধ্যে ইতোমধ্যে কর্তণ করা হয়েছে দেশি ৯৮৫ হেক্টর, তোষা ৯৭৫, মেস্তা ১৭০ হেক্টর কেনাফ ৩৩০ হেক্টর জমির পাট।
সরেজমিনে চাঁদপুর সদর ও মতলব দক্ষিণ উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, কৃষকরা এখন পাটের আঁশ সংগ্রহে ব্যস্ত। নারী, পুরুষ, শিশু ও বৃদ্ধ সহ সবাই একত্রে কাজ করছে। কেউ বাড়ির আঙ্গিনায়, কেউ আবার রাস্তায়।
আলাপকালে সদর উপজেলার বাগাদী ইউনিয়নের সাহেব বাজার এলাকার কৃষক রফিক তালুকদার, মোঃ নুরুল ইসলাম বেপারী, মোঃ বাচ্ছু বেপারী ও মোঃ দেলোয়ার খান সহ বেশ কয়েকজন জানান, প্রতি মন পাট উৎপাদনে চারা রোপন থেকে শুরু করে আঁশ নেয়া পর্যন্ত লেবার খরচ পড়ে ২ হাজার থেকে ২২শ টাকা। কিন্তু এবছর দাম পাচ্ছি আমরা মাত্র ১৫শ থেকে ১৮শ টাকা। এতে আমাদের প্রতি মনে অনেক টাকা লস দিতে হবে। আমরা গরীব কৃষক এত টাকা লসে কিভাবে কৃষি কাজ করবো।
তারা দাবি করেন, গত বছর পাট মৌসুমের প্রথম দিকে প্রতি মন পাটের দাম ছিলো ২৪শ থেকে ২৬শ টাকা, শেষ সময় এসে আমরা ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত পাটের আঁশ বিক্রি করেছি। এতে অনেকেই লাভবান হওয়ায় এবছর অনেকেই চাষ করেছে। কিন্তু এবছর দাম এমন হবে আমরা বুঝতে পারিনি। এভাবে চলছে আগামী বছর অনেক কৃষকই আর পাট আবাদ করবে না।
মতলব দক্ষিণ উপজেলার কৃষক মিজানুর রহমান তালুকদার, লায়লা বেগম ও রোকেয়া খাতুন জানান, পাট চাষ করে আমরা এবছর ক্ষতিগ্রস্থ হবো। পাটের দাম বৃদ্ধিতে সরকার যদি একটু গুরুত্ব দিতো তাহলে আমাদের মতো কৃষকরা এই ফসল আবাদে আরো উদ্বোদ্ধ হতো। তারা দাবি করেন, পাট আবাদে আঁশ সংগ্রহের পাশাপাশি পাটখড়ি জ্বালানীর কাজেও ব্যবহার হয়ে থাকে। এতে কৃষক দুই দিক থেকে লাভবান হতে পারে। তাই অনেকেই পাট আবাদ করেন। তবে পাটখড়ির জন্য নয় আঁশের জন্য কৃষক এই ফসল চাষাবাদ করে। আঁশের দাম না বাড়ালে পাটখড়ির জন্য কেই এই ফসল চাষ করবে না।
চাঁদপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-সহকারী পরিচালক কৃষিবিদ মো. জালাল উদ্দিন বলেন, আরো কয়েকদিন যদি পাটের আঁশ সংরক্ষণ করে রাখা যায় তাহলে কিছুদিন পরে পাটের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে কৃষকদের জন্য একটি সুখবর হলো পাটের নতুন একটি জাত উদ্ভাবন হয়েছে। আগামী বছর থেকে উদ্ভাবিত নতুন এই জাতের পাট আবাদের মাধ্যমে কৃষকরা দ্বিগুণ ফলন পাবে ও অধিক লাভবান হবে।
উল্লেখ্য, অতীতে পাট আবাদে চাঁদপুরের যথেষ্ট সুনাম থাকায় এই শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে দুটি বেসরকারি জুট মিল। এছাড়াও সরকারিভাবে তৈরি করা হয় পাট গুদামজাত করার জন্য বিশাল আকারের গোডাউন। কিন্তু সময়ের পালাক্রমে দুটি জুট মিলের মধ্যে বন্ধ রয়েছে একটি। অন্যটি চালু আছে নামমাত্র। এছাড়াও সরকারি গোডাউনটি পড়ে আছে জরাজীর্ণ অবস্থায়।