নজরুল ইসলাম আতিক:
আজ (২৮ ফেব্রুয়ারি) রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে আগামী ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত চাঁদপুরের পদ্মা মেঘনায় দুই মাস সকল প্রকার মাছ ধরা নিষিদ্ধ। ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ও জাটকার অবাধ বিচরণ নিশ্চিত করতে ২০০৬ সাল থেকে এই জাটকা নিধন রক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে আসছে সরকার। চাঁদপুরের মেঘনা ও পদ্মা নদীর চাঁদপুরের ষাটনল থেকে লক্ষ্মীপুর জেলার চর আলেকজান্ডার পর্যন্ত এই একশ’ কিলোমিটার এলাকায় এই দুই মাস সব ধরনের মাছ ধরা নিষেধ। এছাড়াও দেশের ৫টি অঞ্চলে এই নিষেধাজ্ঞা চলবে।
নিষেধাজ্ঞার এই দুই মাস জেলেদের জন্য সরকারি ভিজিএফের চাল বরাদ্দ দেয়া হয়। চার ধাপে তাদেরকে মোট ১৬০ কেজি চাল প্রদান করা হবে।পাশাপাশি তাদেরকে বিভিন্ন আয়বর্ধক কর্মসূচির আওতায় প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জাম প্রদান করা হচ্ছে। তবে জেলেদের দাবি শুধু চাল দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। তাই নিষেধাজ্ঞায় সরকারি প্রণোদনা বাড়ানো দাবি জানিয়েছেন জেলেরা।
নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে জেলা টাস্কফোর্স। প্রশাসনের পক্ষ থেকে জাটকা রক্ষায় ইতোমধ্যে জনপ্রতিনিধি ও জেলে প্রতিনিধিদের সাথে আলাদাভাবে আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়া প্রতিজেলের জন্য ৪০ কেজি করে দুই ধাপের ৮০ কেজি চালের বরাদ্দ ইতোমধ্যে চলে এসেছে। এবং বরাদ্দকৃত চাল স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানান জেলা মৎস্য কর্মকর্তা। দ্রæত সময়ের মধ্যেই জেলেদের জাল দেয়া হবে।
ইলিশ গবেষকদের মতে, নিষেধাজ্ঞার (মার্চ-এপ্রিল) এই দুই মাস সর্বোচ্চ ৬০-৭০ ভাগ জাটকা ধরা পড়ে। তাই ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি ও জাটকার নিরাপদ বিচরণ নিশ্চিত করতে ইলিশের পাঁচটি প্রধান বিচরণ ক্ষেত্র পদ্মা ও মেঘনা নদী, শাহবাজপুর চ্যানেল, তেতুলিয়া নদী ও আন্দার মানিক নদীতে মাছ ধরা সম্পুর্ণ নিষিদ্ধ।
চাঁদপুর সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর হরিণা ও আনন্দ বাজার এলাকার বেশ কয়েকজন জেলের সাথে আলাপকালে তারা জানায়, সরকারি সিদ্ধান্ত মেনে তারা নদীতে নামবে না। তবে সরকারি যে সহায়তা তাদের দেয়া হচ্ছে তাতে তাদের সংসার নিয়ে বিপাকে পরতে হচ্ছে। তাছাড়া বিভিন্ন এনজিওর কিস্তির টাকা পরিশোধের চাপতো রয়েছেই। তাই নিষিদ্ধ সময়ে নদীতে মাছ ধরা নিয়ে তারা মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
জামাল মাঝি, জয়নাল গাজী, আবুল বাসারসহ করেকজন জানান, সরকারি যে খাদ্য সহায়তা চাল দেয়া হয় তা অনেক সময় ১০ তারিখ, ১২ তারিখ, কিছু কিছু সময় ১৪ তারিখে তাদের হাতে এসে পৌঁছায়। যা তাদের কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যেহেতু ১ তারিখ থেকে নদীতে মাছ ধরা নিষিদ্ধ হয় সেহেতু তার আগে থেকে প্রস্তুতি নিলে হয়তো ১ তারিখ বা ২ তারিখ তাদেরকে চাল দেয়া সম্ভব বলে দাবি করেন তারা।
পাশাপাশি তারা আরো দাবি করে বলেন, যেহেতু এই দুই মাস আমরা নদীতে নামতে পারি না সেহেতু বিভিন্ন কাজে আমাদের সরকারি বেসরকারি সংস্থা বা এনজিও থেকে যে লোন তুলতে হয়েছে সেসব লোনের কিস্তি বন্ধ রাখার জন্য সরকারের কার্যকর ভূমিকা রাখা উচিত। অনেক সময় লোনের কিস্তি পরিশোধের জন্য জেলেরা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে নদীতে নেমে পড়ে। কারণ বিভিন্ন এনজিও থেকে নেয়া লোনের কিস্তির জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বাড়িতে এসে বসে থাকেন কিন্তু জেলেরা নদীতে নামতে না পারলে তারা কিস্তি পরিশোধ করব কিভাবে? সেক্ষেত্রে তারা আরো দেনার মুখে পড়ে।
চাঁদপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা গোলাম মেহেদী হাসান জানান, সরকারি নির্দেশনা মেনে আমাদের যেসব জেলে ভাই রয়েছেন তারা মাছ ধরা থেকে বিরত থাকবে নেই আমরা প্রত্যাশা করি। নিষেধাজ্ঞার সময়ে সরকারি যে খাদ্য সহায়তা (ভিজিএফের চাল) তা বরাদ্দ হয়ে গেছে। আগামী দু’একদিনের মধ্যেই আমরা তা জেলেদের মাঝে বিতরণ করব। বর্তমান সরকার জেলেদের বিকল্প আয়বর্ধক হিসেবে ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন প্রকল্প ও বৃহত্তর কুমিল্লা মৎস্য উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় তাদেরকে ছাগল, ভ্যান গাড়ি, বাছুর, সেলাই মেশিন সহ অন্যান্য উপকরণ দেয়া হচ্ছে। আমরা আশা করব এই বিকল্প কর্মসংস্থানের মাধ্যমে তারা তাদের জীবন মান উন্নয়নের চেষ্টা করবে। পাশাপাশি আমাদের ইলিশের যে গৌরব ‘ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর’ এর ঐতিহ্য রক্ষা পাবে।
তিনি আরো বলেন, আমরা জানি জেলেরা অনেক সময় নৌকা তৈরি বা জাল ক্রয়সহ বিভিন্ন প্রয়োজনে বিভিন্ন এনজিও বা মহাজনের কাছ থেকে লোন নেয় এবং নিষেধাজ্ঞার এই দুই মাস সেই লোনের কিস্তি পরিশোধ করা তাদের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। আমরা জেলা প্রশাসক মহোদয়ের মাধ্যমে চেষ্টা করবো অন্তত যাতে নিষেধাজ্ঞার এই সময়টিতে জেলেদের কিস্তি বন্ধ রাখা হয়।
সরকারি হিসেবে চাঁদপুর সদর, হাইমচর, মতলব দক্ষিণ, মতলব উত্তর এই চার উপজেলায় ৪৪ হাজার ৩৫জন নিবন্ধিত জেলে রয়েছে। অভয়াশ্রম চলাকালে কেউ নদীতে জাল ফেললে এক থেকে দুই বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদন্ড ও ৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। পাশাপাশি প্রশাসনের পক্ষ থেকে জাটকা নিধন রক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নে কঠোর অবস্থানে থাকবে বলেও জানানো হয়েছে।