জমিরউদ্দিন শহরের প্রভাবশালী কোনো ব্যক্তিবিশেষ নয়। তারপরও সবাই তাকে চেনে। অনেক ক্ষমতাধর ব্যক্তির বাসায় তার যাওয়া-আসা। এতে তার মনের জোর বাড়ে। হোক না সে পত্রিকা বিলিকারক। ভোর হলে খবরের কাগজ নিয়ে মানুষের দরোজায় গিয়ে দাঁড়ানো তার পেশা। সেই বদৌলতে বিপদে-আপদে, সুখে-দুঃখে পরিচিতজনদের নামগুলো কাজে লাগানো যায়। তাই সমাজের প্রতাপশালী মানুষগুলোর সঙ্গে অনেকটা আগ-বাড়িয়েই কথা বলার সুযোগ খোঁজে সে। সম্পর্ক পাকাপোক্ত করার জন্যে চালায় প্রাণপণ চেষ্টা।
জমিরউদ্দিনের আচার-চারণ ও কথাবার্তা ভালো। গায়ে-গতরে খাটতে পারে ঢের। পত্রিকা ডেলিভারির ব্যাপারে ভীষণ তৎপর সে। উঁচুতলার ভবনে যথাসময়ে পত্রিকা পৌঁছে দেয়ায় তার জুড়িমেলা ভার। এর ফলে নিউজ এজেন্সির কর্তৃপক্ষসহ গ্রাহকদের কাছে তার মোটামুটি একটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে।
কাগজ বিলি করার সময় গ্রাহকের সঙ্গে দেখা হলে বিনয়ের সঙ্গে সালাম দেয়। মিষ্টি হেসে শরীরের খোঁজ-খরব নেয়। স্যারÑবলে সম্বোধন করে।
অনেকেই আন্তরিকতার সঙ্গে সাড়া দেয়, চা-পানের অপার করে। এতেই সে দুনিয়ার খুশি! কাগজসুদ্ধ সাইকেলটি বাইরে থাকায়, বড় লোকের চা তার গলায় ঢোকে না কখনও।
কেউ কেউ দেয় দায়সারা জবাব। ভ্রু-কুঁচকে বিরক্তি ভাব দেখায়। পেপার হাতে নিয়ে দরোজা আটকে দেয়। জমিরউদ্দিনের খুব মন খারাপ হয় তখন। এ সময় মানুষে মানুষে আকাশ পাতাল পার্থক্য খুঁজে পায় সে।
মাঝেমধ্যে ব্যতিক্রম ঘটনাও ঘটে। কলিংবেল চাপলে সুন্দরী মহিলা অথবা যুবতী মেয়েরা এসে দরোজা খুলে দেয়। কিঞ্চিৎ বিব্রত হয় সে। লজ্জায় আনত হয়ে পত্রিকা বাড়িয়ে দেয়। সে-সব নারীর সঙ্গে দুএক বাক্যের বেশি কথা হয় না। তারাও খুব মুডে থাকে। ফলে গ্রাহকদের মধ্যে কার বউ সুন্দরী, কার কন্যা ওভার-স্মার্ট এসব ফিরিস্তি জমিরউদ্দিনের মুখস্থ এবং কার ব্যবহার ভালো, কার আচরণ বাজে সে ব্যাপারেও ভীষণ অভিজ্ঞ সে। এসব বিষয়াশয় মাথায় রেখেই প্রতিদিন কাজে নামে, সাইকেলের প্যাডেলে পা চালায়।
দেলোয়ার ভূঁইয়া নামের এক অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তার দারুণ ভক্ত সে। প্রায়শ এখানে সেখানে তার সুনাম বলে বেড়ায়। ১০-১২ বছর ধরে খবরের কাগজ দিচ্ছে তাকে। প্রতিদিন ৩-৪ টা পত্রিকা বাসায় রাখেন ভদ্রলোক। কথায় আর কাজেও মিল আছে। নয়-ছয় বোঝেন না। আচার-ব্যবহার অনেক সুন্দর। বিভিন্ন সময় বকশিশও দেন তাকে। দেখা হলে নিজ থেকেই জমিরউদ্দিনের পরিবারের লোকজনের খোঁজ-খবর নেন। খুব ধর্মকালাম করেন। কোনো অসুবিধায় পড়লে যেন তার সঙ্গে যোগাযোগ করে, এসব কথা বহুবার তিনি জমিরউদ্দিনকে বলে দিয়েছেন।
গ্রাহকদের রূপবতী স্ত্রী-কন্যার দেহসৌষ্ঠব জমিরউদ্দিনের মনের মধ্যে যে ঢেউ জাগায় না এমন কিন্তু নয়। জাগায়। তাদের সঙ্গে কথা বলতে প্রায়শ জিহ্বা নিশপিশ করে। দেশি-বিদেশি প্রসাধনী মাখা নারী-দেহের ঘ্রাণ নাক আসলে শিউরে ওঠে শরীর। পাছে খারাপ ভাবে, তাই চুপসে যায়। পত্রিকা-ব্যবসার দুর্দিনে একজন গ্রাহক ছুটে গেলে রাতে তার ঘুম হয় না। কলকারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অফিস আদালতগুলোতে নিয়মিত পত্রিকা রাখার কারণে কিছুটা হলেও কুল পাচ্ছে এখন। তারপরও হকাররা ভাল নেই আজকাল।
স্ত্রী ও দুই কন্যা নিয়ে ভাড়া থাকে জমিরউদ্দিন। সঙ্গে থাকেন মা, বারমাস রোগবিমারে ভোগেন তিনি। পত্রিকার ব্যবসা এক সময় রমরমা ছিল। বেচা-বিক্রি করে দিশ পাওয়া যেত না। তখন আয় রোজগার ভাল ছিল। সংসারে মানুষজনও কম ছিল, খরচের পরিমাণও ছিল সীমিত। পরিবারের জন্যে দুই হাতে খরচ করেছে সে। বুঝতেই পারেনি জীবনে এতটা কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে একদিন। কেন জানত, ইলেক্ট্রোনিক মিডিয়া, অনলাইন প্রোর্টাল ও ফেসবুক ইউটিউবের মতো শক্তিশালী মাধ্যম এসে একদিন এ প্রজাতির ব্যবসা-বাণিজ্যে লালবাতি জ¦ালিয়ে দেবে। আগে থেকে বুঝতে পারলে সে হয়ত আরও সতর্ক হয়ে চলত, অন্য অবলম্বন খুঁজত।
পত্রিকার বাজারের এখন যে দুরাবস্থা! কাগজ বাড়ছে, কমছে গ্রাহক। দুর্মূল্যের বাজারে পাঁচ সদস্যের সংসারের লরি টানা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। জোড়াতালি দিয়ে, টেনেহিঁচড়ে কোনোমতে চালিয়ে নিচ্ছে সে।
টানাপড়েনের সংসার এগিয়ে নিতে কীভাবে আয়ের পথ বাড়ানো যায়, এসব নিয়ে আজকাল বেজায় চিন্তিত জমিরউদ্দিন। কিন্তু তার দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দিতেই যেন পৃথিবীতে হানা দিল ভয়াল এক অন্ধকার। হঠাৎ সবকিছু এলোমেলো করে দিল প্রাণঘাতী ভাইরাসÑ করোনা।
মাস্ক, লকডাউন, শার্টডাউন, আইসোলেশন, পিপিই, ভ্যারিয়েন্টÑইত্যাদি শব্দের সঙ্গে পরিচিত হল মানুষ। সম্পর্ক ছিন্ন হল অর্থনীতির সঙ্গে। ছত্রখান হয়ে গেল স্বপ্ন। বাধ্য হয়ে কলকারখানা, অফিস আদালত, এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হল। জমিরউদ্দিনের আয়ের পথ কয়েক-গুণ কমে এল। ঝাপসা হয়ে এল পৃথিবী।
না খেয়ে মরার মতো পরিস্থিতি তৈরি হল। কমতে থাকল পত্রিকার সার্কুলেশন। বন্ধ হয়ে গেল অনেক কাগজ। দিশেহারা হয়ে পড়ল সে। পেশাগত কারণে সামাজিক সংগঠনগুলির ছেলেমেয়ের সঙ্গে পরিচয় থাকায় দুচার প্যাকেট ত্রাণসামগ্রী কপালে জুটেছে। এতে আর কতটুকু চলে। বাসাভাড়া, চিকিৎসা ব্যয়, বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস বিল, এ সব খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
কত প্রভাবশালী ব্যক্তির বাসায় সে পত্রিকা দেয়, এত পয়সাওয়ালা মানুষের সঙ্গে তার পরিচয়। কেউ তাকে একটা কানাকড়ি দিয়েও সাহযোগিতা করল না। উল্টো অনেকে করোনার ছুঁতো দেখিয়ে পত্রিকা রাখা বন্ধ করে দিল। পুরানো বিলও পরিশোধ করল না । পরে এক সময় এসে নিয়ে যেও, বেঁচে থাকলে তোমার টাকা মিস যাবে নাÑইত্যাদি বলে দরোজা এঁটে দিল! অর্থবিত্ত মানুষকে কতটা বিবেকহীন করে তুলতে পারে জমিরউদ্দিন হাড়ে-হাড়ে টের পেল করোনা আসার পর।
ঘরে অসুস্থ মা। চিকিৎসার পয়সা নেই। হাড়ির চালডালও ফুরিয়ে যাওয়ার পথে। তরিতকারির কথা আর ভাবার সময় কই।
জমিরউদ্দিন চিন্তা করল সবকিছু দেলোয়ার ভূঁইয়াকে জানাবে। নিজের দুর্গতির কথা খুলে বললে কিছু একটা হবে। তিনি অন্তত নিরাশ করবেন না। ভদ্রলোক নিজে থেকে অনেকবার বলেছেন, কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলবে।
সেই ভাবনা থেকে খবরের কাগজ হাতে দেলোয়ার ভূঁইয়ার দরোজার বেল টিপল। সিঁড়ি বেয়ে পাঁচ তলায় উঠতে উঠতে আজ কিছুটা হাঁফিয়ে পড়েছে সে। জমিরউদ্দিনের বুক ধরপর করছে, কীভাবে কথাটা তুলবে সেÑএ নিয়ে নিজের মধ্যে বড় ধরনের অস্থিরতা শুরু হল।
ভাবনাটার সমাধানে পৌঁছানোর আগেই দেলোয়ার ভূঁইয়া এসে দরোজা খুললেন। সামাজিক দূরত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে পত্রিকা হাতে নিলেন। তারপর মিষ্টি হেসে বললেনÑজমির, কাল তো মাসের শেষ তারিখ, বিলটা করে নিয়ে এসো। তোমার টাকাটা নিয়ে যেও মনে করে। কালকের পর আপাতত পত্রিকা বন্ধ রাখো। যতদিন করোনা থাকবে ততদিন কাগজ দিও না। রাতে লন্ডন থেকে বড় মেয়ের জামাই ফোনে জানিয়েছে, পত্রিকার মাধ্যমেও কারোনা ভাইরাস ছড়াতে পারে। ডাক্তার জামাই বারবার অনুরোধ করে বলছে, আপাতত প্রিন্ট পত্রিকা না পড়ার জন্যে। যা পড়ার নেট থেকে পড়ে নিতে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তোমাকে জানাব।
জমিরউদ্দিনের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল, একগুচ্ছ আশা নিয়ে যার দুয়ারে এসে দাঁড়িয়েছে, সে শোনাল নিরাশার বাণী! চোখমুখ লাল হয়ে গেল। গলা দিয়ে কথা বেরুতে চাইছে না। আহারে পৃথিবী! মানুষের বাঁচার কত আকুতি! কাগজের পত্রিকাকেও জমদূত ভাবে এখন! হায়রে নিষ্ঠুর করোনা। তুই বুঝি গরিবের পেটে লাত্থি মারার জন্যেই এই ধরাধামে নেমে এসেছিস!
দেলোয়ার ভূঁইয়া কথাটা আবারও পুনরাবৃত্তি করলেন, আপাতত পত্রিকা বন্ধ রাখো ভাই। যখন লাগবে তোমাকে জানাব। আর তুমিও সাবধানে থেকো জমির। বেশি একটা বের হইও না। সংক্রমণ যেভাবে বাড়ছে, বড় দুশ্চিন্তায় ফেলে দিচ্ছে। কী যে হবে মানুষের!
জমিরউদ্দিনের বুক ফেটে কান্না আসছে। তার যে এখন কিছুই করার নাই। চাপাকষ্ট আড়াল করে অত্যন্ত কাতরস্বরে জবাব দিলÑ জি¦ স্যার, ঠিক আছে। আসি স্যার…
দেলোয়ার ভূঁইয়া পত্রিকায় চোখ বুলাতে বুলাতে দরোজা আটকে দিলেন। আর চোখের পানি মুছতে মুছতে সিঁড়ি ভেঙে নিচের দিকে নামতে থাকল জমিরউদ্দিন।
নিয়তি সব সময় জমিরউদ্দিনদের নিচের দিকেই নামিয়ে দেয়!
আজ,
বুধবার , ৪ অক্টোবর, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ , ১৯ আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম:
প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।