দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে তিনি নিষ্ঠার পরিচয় দিয়ে চলছেন নিয়মিত। যোগ্যতাগুণে হয়েছেন বিসিএস ক্যাডার (প্রশাসন)। অবশ্য এর আগে চারটি চাকুরী পেয়েছেন। কৃষি ব্যাংকে অল্প কিছুদিন কাজ করলেও সাব-রেজিস্ট্রার হিসেব দায়িত্ব পালন করেছে ১৪মাস। সহকারী শিক্ষক হিসেবে চাকুরী হলেও যোগ দেন নি। আদতে তিনি একজন প্রতিবন্ধী। শারীরিক অক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তিনি দায়িত্ব পালনে পিছ পা হন না এবং কর্মজীবনে তা ব্যর্থতার পরিচয় হিসেবে বহন করেননি। জেলা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে তিনি সদা তৎপর। বলছিলাম সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ওলিদুজ্জামান-এর কথা। তিনি ৩৬তম বিসিএস ক্যাডারের মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন। বর্তমানে তিনি চাঁদপুর জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী কর্মকর্তা (এলজি শাখা) হিসেবে কর্মরত। নবম শ্রেণী থেকে পাঁচ ঘন্টা ঘুমানোর নিয়ম করেন তিনি। লেখা পড়া করেছেন ভোর রাতে। ওলিদুজ্জামান ২০১৮ সালে ৯ সেপ্টেম্বর তিনি চাঁদপুরে যোগদান করেন। ১৯৯০ সালে ময়মনসিংহ জেলার তারাকান্দা উপজেলার চরপাড়া গ্রামে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। ২০১৭ সালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ইউনির্ভসিটি থেকে ইংরেজীতে মার্স্টাস সম্পন্ন করেন। বাবা মৃত ফয়েজ উদ্দীন সরকার কৃষক ছিলেন। মা মমতাজ বেগম একজন গৃহিনী। আট ভাই, পাঁচ বোনের মধ্যে নিচের দিক থেকে দ্বিতীয় ওলিদুজ্জামান। এক ভাই বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করছেন। ছোট ভাই মাষ্টার্স পরীক্ষা শেষ করেছে। আর বাকী সব ভাই-বোনই প্রতিষ্ঠিত।
১৯ অক্টোবর শনিবার সন্ধ্যায় এ কর্মকর্তার মুখোমুখি হয় সাপ্তাহিক শপথ। যা আজ হুবহু প্রকাশিত হলো।
সাপ্তাহিক শপথ: চারটি চাকুরীর মধ্যে কোনটাকে এনজয় করছেন বেশি?
ওলিদুজ্জামান : ব্যাংক, সাব-রেজিস্ট্রার এর চেয়ে বর্তমান পদ অনেক বেশি এনজয় করেছি। ব্যাংকের চাকুরী খুব বেশি দিন করিনি। একবছরের মতো কাজ করেছি সাব-রেজিস্ট্রার হিসেবে। সাব-রেজিস্ট্রি অফিসেও কাজ করার সুযোগ বেশি। ওখানেও ছোট থেকে বড় লেভেলে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। আমি আমার অফিস ওপেন করে দিয়েছিলাম। মানুষের সাথে কথা বলতে ভাল লাগতো। চাকুরী ক্ষেত্রে আর্থিক বিষয় বিবেচনা করিনি। টাকার চিন্তা করলে ওই চাকুরী ছেড়ে দিতাম না। কারণ ওখানে শুধু টাকা উড়ে। ওই চাকুরীটাই আলাদা। যদিও ওই প্রতিষ্ঠানের কাঠামোগত সমস্যা আছে। আমি চেষ্টা করেছি। সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে দলিল লিখকদের কাছে প্রায় সবাই জিম্মি থাকে। তারা সাব-রেজিস্ট্রারের নাম যেভাবে ভাঙে, মূলত সে পরিমাণ বদনামের ভাগিদার না।
সাপ্তাহিক শপথ : সাব-রেজিস্ট্রারের চাকুরী কেন ছাড়লেন বা এখানে কেন চলে আসা ?
ওলিদুজ্জামান : পরিবার চেয়েছে প্রথমত। বাবা মা ভাই বোন সবাই চেয়েছে। তাই চলে এসেছি। এ চাকুরীটা একটা ওয়েটফুল। মানুষ সম্মান করে। তাই চলে আসা। প্রমোশনের জায়গাটাও ভালো। সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে কাজ করলেও প্রমোশন পাবার সুযোগ কম থাকে।
সাপ্তাহিক শপথ: শারীরিক অক্ষমতা কখনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে?
ওলিদুজ্জামান : ক্লাস নাইন থেকে শিক্ষা জীবনের শেষ পর্যন্ত ক্লাসের ফাস্ট বয় ছিলাম। এটা আমার জন্যে অনেক কঠিন কাজ। নরমালি ফাস্ট বয় সাইন্স পড়ে কিন্তু পরিবার ভরসা রাখতে পারেনি। পরিবারের ইচ্ছে অনুযায়ী মানবিক বিভাগ থেকে পড়ালেখা করেছি। আমার পরিবার যদি সাপোর্ট দিতো তাহলে আমি ভিন্ন কিছু হতে পারতাম। আমাকে উন্মুক্ত করে দেয়নি। তাদের ইচ্ছাই ছিলো আমার ইচ্ছা। আমি যখন স্কুলের সেরা রেজাল্ট করলাম। আমার পেছনের শিক্ষার্থীরা ভালো ভালো কলেজে পড়ালেখা করেছে। আমি একটা নরমাল কলেজে থেকে পড়ালেখা করি। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরিক্ষায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে-৩৯তম, ঢাবিতে-১২৪তম হয়েছি। পরিবারের আপত্তির কারণে ভর্তি হতে পারিনি। অথচ আমি কোন প্রকার কোচিং ছাড়াই চান্স পেয়েছিলাম। আমার শিক্ষা জীবনে মাত্র একমাস প্রাইভেট পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। তারপর আর প্রাইভেট পড়িনি। অবশ্য পড়ার সুযোগ হয়নি। আমার পড়ালেখার স্টাইল ছিল অন্যরকম। আমার বন্ধুরা যখন প্রাইভেট পড়তে যেতো, ঠিক তখন আমি পড়তে বসতাম। ওরা যখন ফিরে যতো আমি আরো আধঘন্টা পড়ে টেবিল থেকে উঠতাম। ওরা প্রাইভেটে যে সময় পড়তো আমি আরো বেশি মনোযোগ দিয়ে বাসায় পড়তাম। আমি ফলো করতাম তারা কখন যায় এবং আসে। রাস্তার পাশে ছিলো আমাদের ঘর।
আমি কখনো সিলেবাস ফলো করতাম না। আমি পুরো বই পড়ে ফেলতাম। তাই সবসময় শতভাগ প্রশ্ন কমন পড়তো। শিক্ষা জীবনের সময়টাকে খুব ভালো লাগে। যাহোক, পরিবার চায়নি বলে ঢাবি বা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারিনি। বাধ্য হয়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজীতে ভর্তি হই। এখানেও ভর্তি পরিক্ষায় ২৪তম হই। কিন্তু ইংরেজীতে যেন না পড়ি তাই পরিবার ভ্যাটু ছিলো। সবার ভ্যাটু অগ্রাহ্য করে মায়ের সাপোর্টে ভর্তি হয়েছি। একারণে পরিবারের অন্য সদস্যরা অর্থনৈতিক সাপোর্ট দেয়া বন্ধ করে দেয়। তাই অনার্স জীবনে প্রথমে কষ্ট বেশি হয়েছে। অবশ্য দুই মাস পর তা কেটে গেছে। কারণ আমি প্রচুর টিউশনি করতাম। চাকুরীতে জয়েন করার আগের দিন পর্যন্তও সাতটি টিউশনি ছিলো। অনেক সময় আমি টিউশনি করবো না বলে এসেছি। কিন্তু শিক্ষার্থীদের গার্ডিয়ানরা আমাকে ছাড়তে চায়নি।
সাপ্তাহিক শপথ: প্রতিবন্ধী বলে মনে কোনো কষ্ট হয়?
ওলিদুজ্জামান: এটাকে আমি কষ্ট মনে করি না। কারণ এটা আমার হাতে নাই। মানুষজন আমাকে ভিন্ন চোখে দেখে তখন কিছুটা খারাপ লাগে। তবে সেটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। অবশ্য এক পর্যায়ে আমি যখন রাস্তা দিয়ে হাঁটি তখন আমি কারো দিকে তাকাই না। মানুষের কথা শুনি না। কারণ সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এখানো আমাদের মতো মানুষের প্রতিকূলে। মানসিক স্বস্থির জন্যে তাদের দিকে মনোনিবেশ করি না। কে কি বললো না বললো তাতে আমার কিছু যায় আসে না। কারণ আমি আমিই।
সাপ্তাহিক শপথ: কোনো দুঃখবোধ আছে?
ওলিদুজ্জামান: এক্ষেত্রে একটা উদাহরণ দিতে পারি। কোনো শরীরে যদি নিয়মিত এন্টিবায়টিক দেয়া হয়, একসময় ওই শরীরে আর এন্টিবায়টিক কাজ করে না। তেমনি আমার দুঃখবোধের জায়গাগুলো অকার্যকর হয়ে গেছে। প্রাকৃতিক দুঃখ ছাড়া আমার কোনো দুঃখবোধ নাই। কারণ দুঃখবোধ থাকলে জীবনে চলতে পারবো না। তাই দুঃখ করি না। দুখের জগৎ থেকে অনেক আগেই বেরিয়ে এসেছি। অবশ্য মাঝে মাঝে নিজের কাছে প্রশ্ন জাগতো আমি এমন কেন? এর কোন উত্তর পাইনি। তাই এখন আর নিজেকে প্রশ্ন করি না। প্রশ্নের উত্তর দেই না বা খুঁজি না।
সাপ্তাহিক শপথ: ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?
ওলিদুজ্জামান: আমি খুব বেশি উচ্চাবিলাসী মানুষ নাই। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকে প্রশ্ন করতো স্বপ্ন কি? তখনো আমি কোনো লক্ষ্য স্থির করিনি। অবশ্য ভেবে রেখেছি ভাগ্যে যখন যেখানে নিয়ে যাবে সেখানেই মানুষের কাজে লাগতে চাই। মানুষের উপকারে আসতে পারাটাই আমার লক্ষ্য। কেরানী পদে বসে যদি অনেক মানুষকে সহযোগিতা করার সুযোগ থাকে সেখানে নিজেকে মানিয়ে নেয়া উচিৎ। সবচে বড় কথা এখন, স্বপ্ন হচ্ছে ভালো মানুষ হয়ে উঠা। সময় যেভাবে যেতে চায় আমার চাওয়াও ঠিক তেমন। তবে মানুষের কাজে উপকারে আসতে পারলে তৃপ্ত হই।
সাপ্তাহিক শপথ : বাজে অভিজ্ঞতা আছে?
ওলিদুজ্জামান : অনেকেই কাজ করতে চান না। কাজ ফাঁকি দেন। এটা আমার ভালো লাগে না। একেকজনের মন মানসিকতার উপর নির্ভর করে সে কি করবে? তবে কাজের মানুষকে দিয়ে মানুষ শুধু কাজ করায়। আর যারা কাজ করে না তাদের প্রতি কাজ করানো আগ্রহ থাকে না।
সাপ্তাহিক শপথ : আপনি বই পড়তে ভালোবাসেন। বিশেষ কি ভালো লাগে?
ওলিদুজ্জামান : মহাভারত, রামায়ন, শরৎ, রবীন্দ্র পড়তে ভালো লাগে। সেক্সপিয়র, অরুন্ধুতি রায় এর লেখা ভালো লাগে। সময় পেলেই পড়তে বসি। পড়তে পছন্দ করি। প্রচুর মুভি দেখা হয়। ছাত্রজীবনেও প্রতিদিন দুইঘন্টা মুভি দেখতাম। রাত তিনটার পর পড়ালেখা করতাম। এখনও গভীর রাতে ঘুম ভেঙে যায়। চার বা পাঁচটার মধ্যে ঘুম ভেঙে যায়।
সাপ্তাহিক শপথ; প্রতিবন্ধি কোটার সুবিধা নিয়েছেন?
ওলিদুজ্জামান: কোটা সার্টিফিকেট ছিলো না। নরমালি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিতেও কোটা নেইনি। আমাদের সমাজে আজো শারীরিক প্রতিবন্ধীরা খুবই অবহেলিত। প্রচলিত আছে প্রতিবন্ধিদের জন্যে একপার্সেন্ট। অথচ কার্যত তা কতোটুকু বাস্তাবায়ন হয় তা প্রশ্ন রয়েই যায়। কারণ শারিরীক প্রতিবন্ধিদের বেলায় অন্য সকল কোটা সর্ম্পূণ করার পর শারীরিক প্রতিবন্ধী কোটায় আসে। ৩৬তম বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে ৩০০ জনের মধ্যে মেধাতালিকায় ৪২তম হয়েছি। সুতরাং বুঝতেই পারছেন কোটা সুবিধা কতোটুকু নিতে হয়েছে। আমি কোটা সুবিধা নেইনি। কিন্তু বৈষম্য দেখেছি।
সাপ্তাহিক শপথ: কোন খেলা পছন্দ করেন?
ওলিদুজ্জামান: ক্রিকেট। স্কুল জীবনে প্রচুর ক্রিকেট খেলতাম। এখন খেলার সুযোগ হয়ে উঠে না।
সাপ্তাহিক শপথ : ভালোবাসেন কাকে ?
ওলিদুজ্জামান : নিজেকে ছাড়া সবাইকে ভালোবাসি। এটা এক ধরনের প্রতিশোধ। আমার আত্ম প্রেম নাই। অন্যের চাহিদাকে গুরুত্ব দেয়ার চেষ্টা করি। নিজের কষ্ট হলেও অন্যের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে প্রাধান্য দেই।
সাপ্তাহিক শপথ : সফল মনে হয়?
ওলিদুজ্জামান : সাফল্যের সংজ্ঞা আমার কাছে ভিন্ন। চাকুরী-বাকুরী সফলতার মাপকাঠি হতে পারে না। আমি এ পর্যায়ে সফল বলতে পারেন। কিন্তু আমার দায়িত্ব পালন করতে পারছি কিনা? যদি দায়িত্ব পালনে সক্ষম হই তবে আমি সফল। সেটাই হচ্ছে সফলতা। আর দায়িত্ব পালন যথাযত ভাবে পালন করতে না পারাই হলো ব্যর্থতা।
সাপ্তাহিক শপথ : ভালো থাকার কৌশল বলুন ?
ওলিদুজ্জামান : নিজের মনের কাছে নিজেকে পরিস্কার রাখতে হবে। পরিশ্রম করলে অবশ্যই আপনি ভালো থাকবেন। এটা আমি বিশ্বাস করি।
সাপ্তাহিক শপথ: প্রতিবন্ধিদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।
ওলিদুজ্জামান: নিজেকে প্রমাণ করো। কে কি বললো না বললো সেটা না ভেবে কিছু করে দেখিতে দাও, যে আমরা পারি সমাজের জন্য কিছু করতে।
সাপ্তাহিক শপথ: সাপ্তাহিক শপথকে সময় দেয়ার জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ।
ওলিদুজ্জামান: সাপ্তাহিক শপথ পত্রিকাটি আমার হাতের উপর দিয়ে ডিক্লারেশন পেয়েছে। সমাজের আসল চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছে। সাপ্তাহিক শপথের মঙ্গল কামনা করছি। সামাজিক কাজ করার জন্যে আরো সচল ও সফল হোক সাপ্তাহিক শপথ এ প্রত্যাশা করি।
আজ,
সোমবার , ২৭ মার্চ, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ , ১৩ চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম:
প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।