রিয়াজ শাওন:
‘মোরা এক ঘাটেতে রান্ধি বাড়ি, আরেক ঘাটে খাই, মোদের ঘরবাড়ি নাই’ কালজয়ী বিখ্যাত এই গানের মতই বেদে সম্প্রদায়ের যাযাবর জীবন। জীবিকার তাগিদে নদীতে সারি সারি নৌকায় পাল তুলে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ভেসে বেড়ানো বেদেদের জীবনে লেগেনি পরিবর্তনের ছোঁয়া। তাই তো এখনো বেদেদের সাপ ধরা, সাপ নাচানো, বীণের সুরে সাপের খেলা দেখানো, সিঙ্গা লাগানো, তাবিজ বিক্রি এবং দাঁতের পোকা ফেলা এই চেনা দৃশ্যগুলো চোখে পড়ে হরহামেশাই। বেদেদের সেই চিরোচেনা জীবনাচার এখনো বদলাইনি। অবহেলিত এ গোষ্ঠী শত প্রচেষ্টার পরও জয় করতে পারেনি দারিদ্রতা ।
ধংশ পরম্পরায় দারিদ্র্যতাকে সঙ্গী করে বেঁচে আছে চাঁদপুর সদর উপজেলার, ৪ নং শাহ মাহমুদপুর ইউনিয়নের, ৪নং ওয়ার্ড শাহতলী গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ডাকাতিয়া নদীর তীরে সারি সারি নৌকায় বসবাস করা বেদেরা ।
স্থানীয়দের সূত্রে জানা যায় , এখানে ৫০টির অধিক বেদে পরিবারের দেড় শতাধিক বেদে। গত ৭০ বছরের অধিক সময় ধরে বসবাস করে আসছে। এখানে বসবাস করা বেদেদের মাঝে কেউ ৬নং মৈশাদী ইউনিয়নের ভোটার আবার কেউ ৪নং শাহ্ মাহমুদপুর ইউনিয়নের ভোটার।
এই বেদে পল্লী বেদেরা রাষ্ট্রের নাগরিক হলেও পায়নি তেমন কোন রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা। বরাবরই সুযোগ সুবিধা, সাহায্য সহযোগিতা থেকে উপেক্ষিত এবং অবহেলিত এই বেদেগোষ্ঠী। অত্যান্ত দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করা। এই সব বেদের জীবন সংগ্রাম দিনদিন বেড়েই চলেছে।
বেদেদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এখানে বসবাস করা বেদে স¤প্রদায়ের সবাই জেলে। ডাকাতিয়া নদীর মাছের উপর নির্ভর করে জীবন চলে। সারাদিন নদীতে মাছ ধরেও পর্যাপ্ত মাছ না পাওয়ায়। দৈনন্দিন সংসারের ব্যায় নির্বাহ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বেদেদের। ফলে অভাব অনাটনেই দিন কাটছে।
সরকারের কোন ধরনের সাহায্য সহযোগিতা পায়নি বলে দাবি করেছেন এখানকার বেদেরা। এমনকি জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ের পক্ষ থেকে, গত কয়েক মাসে একাধিক বার বেদের সাহায্য করলেও এই বেদে পল্লীর কোন বেদে সেই সাহায্য পায়নি। এবং করোনা কালীন সময়ে চরম অর্থিক সংকটে থাকা বেদেরা বরাবরই সাহায্য সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত।
যদিও সরকার অনগ্রসর বেদে জাতিগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তার কিছু কিছু উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। কিন্তু এই সব উদ্যোগের সুফল তো দূরের কথা, এই সব উদ্যোগের তথ্য এখনো পৌঁছায়নি শাহতলীর বেদে পল্লীতে।
সরকার সমাজ সেবা অধিদপ্তরের আওতায় কর্মক্ষখ বেদেদেরকে দক্ষ নাগরিক ও আত্মা-নিরর্ভশীল হয়ে উঠার জন্য ৫০ দিনের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। কিন্তু শাহতলীর এই বেদে পল্লী বেদেরা এই প্রশিক্ষণ সম্পর্কে কিছুই জানে না। যদিও চাঁদপুরে বসবাস করা বেদেরা এই প্রশিক্ষণ নিয়েছে। তবে শাহতলী বেদে পল্লী বেদেরা এখনো এই প্রশিক্ষণ নিতে পারিনি।
শাহতলীর বেদে পল্লীতে বসবাসরত বেদে স¤প্রদায়ের নেতা মোঃ আবদুল হামিদ সওদাগর (৪৩) দৈনিক শপথকে বলেন, ‘আমরা ভাসমান মানুষ। এখানে বসবাস করি দীর্ঘ ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আজ পযর্ন্ত সরকারি কোন সাহায্য সহযোগিতা আমাদের ভ্যাগে জুটে না। সরকার এত লক্ষ লক্ষ টাকা গরীব কাঙ্গালরে সাহায্য সহযোগিতা করতাছে। অথচ আমরা ১২০ টাকা দামের একটা কম্বলও পাই না। এই লকডাউন দিয়ে আমরা কি খাইয়া আছি, না কি না খাইয়া আছি কেউ এটু খোঁজ খবরও নেয় না। ডিসি স্যার সব পাঁচ নাম্বার ঘাটে দেয়, আমাগো রে দেয় না।
আরেকজন বেদে সম্প্রদায়ের নেতা আবদুল হক সওদাগর (৪৯) জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন প্রকাশ করে দৈনিক শপথকে বলেন,’ আমরা নদীতে থাকি, অনেক সময় দেখা যায়। কুয়াশার কারণে কিংবা এক লঞ্চ আরেক লঞ্চকে ওভারটেক করতে গিয়া আমাগো নৌকার উপর দিয়ে উঠাইয়া দেয়। এতে আমাগো অনেক ক্ষতি হয়। দেখা যায়, নৌকায় বাচ্চারা থাকে। তারা সাঁতার জানে না। তাদের ক্ষতি হয়। আবার মানুষও মারা যায়। আমাদের জীবনের কোন নিরাপত্তা নাই। সরকার তো গৃহহীনদের ঘর দেয় জমি দেয় । আমরা তো ভূমিহীন গৃহহীন। আমাগো দিকে সরকার যদি এটু নজর দিতো, তাহলে এটু শান্তিতে ঘুমাইতে পারতাম।
শাহতলী গ্রামের নব নির্বাচিত মেম্বার বিল্লাল হোসেন খান দৈনিক শপথ কে বলেন,’ এই বেদেরা প্রায় ৩০-৩৫ বছর ধরে বসবাস করে শাহতলীতে। এই বেদেরা একেবারে অবহেলিত। এরা সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। আমি সরকারে সুদৃষ্টি কামনা করছি।
সরকারি সহযোগিতা থেকে বারবার কেন বঞ্চিত থাকে শাহতলী দেড়শতাধিক বেদে? জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সানজিদা শাহনাজ দৈনিক শপথকে বলেন,’ হয় তো তাদের সম্পর্কে জানা নেই বা কোন তথ্য নেই। তাই পায় না। তবে তারা যদি উপজেলা নির্বাহী অফিসারের বরাবর সাহায্য আবেদন করে। আমি বিষয়টি দেখবো। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, তথ্য সংগ্রহ করার দায়িত্ব কার? তিনি জানান, সেটা তো সমাজ সেবা অধিদপ্তরের কাজ।
এইসব বেদেদের নিয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তরে কোনো উদ্যোগ আছে কিনা জানতে চাওয়ার জন্য বেশ কয়েকবার জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক জনাব রজত শুভ্র সরকার এর সাক্ষাৎকার নেওয়া জন্য অফিসে গিয়েও বক্তব্য নেওয়া যায়নি। বেদে হওয়ায় সমাজে সঠিক ভাবে মূল্যায়ন পায়নি বেদেরা। সমাজে এদের উপেক্ষিত জনগোষ্ঠী হিসেবে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত চলে জীবন সংগ্রাম। বর্তমানে নদীতে বসবাস করা বেদেরা কুয়াশা আর ঠান্ডা আবহাওয়ায় শীতে কাঁপছে। তবুও নেই কোন মানবিক সাহায্য সহযোগিতা।