বিল্লাল ঢালী:
বিচিত্র মানুষের জীবন। বিচিত্র তার পেশা। বেঁচে থাকার তাগিদে উপার্জনের জন্য কিছু না কিছু করতে হয়। কেউ বা সখের বশে পেশা নির্ধারণ করে। আবার কেউবা পারিপার্শ্বিক পরিবেশে বাধ্য হয়ে। সখের বশে অথবা বাধ্য হয়ে যে যেভাবেই আসুক, একসময় সে পেশায়ই খুঁজে নেয় জীবনের আনন্দ বা বেঁচে থাকার মাধ্যম। বছরের পর বছর সে পেশাকে আঁকড়ে ধরে চলে জীবন-জীবিকা। দিনবদলের সাথে সাথে পরিবর্তন হয় পেশাজীবনেও। যদিও আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিলুপ্তির পথে অনেক পেশা। তখন চলে আবার নতুন পেশার সন্ধান। কেউ কেউ চেষ্টা করেন প্রাণের সাথে জড়িয়ে যাওয়া প্রিয় সে পেশাকে টিকিয়ে রাখার। হয়তো কখনো কখনো টিকে থাকে, কখনো থাকে না। সে রকম নানা পেশার মধ্যে একটি হচ্ছে হাতে লেখা ব্যানার অর্থাৎ আর্ট শিল্প। কিছুদিন আগেও রাস্তার ধারে চোখে পড়তো ব্যানার তৈরি, সাইনবোর্ড লেখার দোকান। এখনও কিছু কিছু চোখে পড়লেওসংখ্যা অতি নগণ্য। ডিজিটালের ছোঁয়ায় ক্রমশ: হারিয়ে যাচ্ছে মায়াবী হাতের সেই কারুকাজ।
যে কোন অনুষ্ঠানের জন্য চাই একটি ব্যানার। সে ব্যানার যত বেশি সুন্দর হবে তত বেশি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য বোঝাতে, গুরুত্ব বাড়াতে ব্যানারের বিকল্প নেই। প্রচার এবং প্রসারে ব্যানার লাগবেই। যেকোন অনুষ্ঠানে, পণ্যের প্রচার কাজে, রাজনৈতিক অঙ্গনে নিজেকে জানান দিতে ও বিলবোর্ডে ব্যবহার হচ্ছে ব্যানার।
যদিও ডিজিটাল প্রিন্টের সহজলভ্যতায় হারিয়ে যেতে বসেছে হাতে আঁকা ব্যানার। সাথে হারিয়ে যাচ্ছেন ওই ব্যানার-পোস্টার এঁকে জীবিকা নির্বাহ করা চারুশিল্পীরা। ইতোমধ্যে কেউ কেউ পেশাও বদ করেছন। যারা এ পেশা কোনো মতে বাঁচিয়ে রেখেছেন তারাও আছেন কঠিন সংকটে। চাঁদপুর শহরের বিভিন্ন এলাকার কয়েকজন আর্টিস্টের সাথে কথা হলে তারা জানান, বছরের পর বছর ধরে হাতে ব্যানার লিখে সংসার চালিয়েছি। এক সময় যখন ব্যবসা জমজমাট ছিল। তখন তিন চারজন কর্মচারীও ছিল। দিনেতো বটেই রাত জেগেও কাজ করতে হতো। শুক্রবার ছুটির দিনেও থাকতো কর্মব্যস্ততা। রাজনৈতিক সংগঠন, কোচিং সেন্টার, স্কুল, সাংস্কৃতিক সংগঠন সবাই আসতো ব্যানার লিখাতে। ডিজিটাল প্রিন্ট ব্যবসা এসে ধসংস করে দিয়েছে চারুশিল্প। এখন মানুষ আর হাতে লেখা ব্যানার ব্যবহার করে না। তাই কাস্টমারও নেই। দোকান গুটিয়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন অনেকে। যে কজন আছেন ভালোবাসার টানে বা অন্য কাজ না জানায় এখনো চালিয়ে যাচ্ছেন পেশা।
আবার অনেকে পুরোনো ব্যবসা ধরে রাখলেও সাথে যোগ করেছেন আধুনিকতার ছোঁয়া। ডিজিটাল কাজ। তেমন একজন চারুশিল্পী সন্দ্বীপ কুমার দাস। ১৭ বছর আগে অল্প কিছু পুঁজি নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন হাতে ব্যানার লেখা। পরে সাইনবোর্ড, গাড়ির নাম্বার প্লেট লেখা এবং বড় গাড়িতে আর্ট করার কাজ শুরু করেন তিনি। তখন সময়টা খুব ভালো যাচ্ছিলো উল্লেখ করে বলেন, একসাথে সাত আটজন লোক কাজ করতাম। দোকান বন্ধ করতে করতে রাত ১১টা/১২টা বেজে যেত। তবুও কাজ থেকে যেত। এখনও কেউ কেউ কাপড়ের ব্যানার তৈরি করে, বিশেষ করে কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলো। কিন্তু হাতে লেখা নয়। সেখানেও ডিজিটাল প্রিন্ট। আমরা তাদের কাছ থেকে অর্ডার নিয়ে সাব কন্ট্রাকে কাজ করে থাকি। পেটতো চালাতে হবে।
চাঁদপুর শহরের কালীবাড়ি এলাকার ব্যবসায়ী সুমন জানান, কাপড়ে হাতে আঁকা ব্যানার তৈরি করতে খরচ পড়ে গজ প্রতি ৮০ থেকে ১০০ টাকা। আর ডিজিটাল প্রিন্টে প্রতি স্কয়ার ফিট ২০ থেকে ২৫ টাকা। সে কারণে মানুষ ডিজিটাল প্রিন্টের দিকে ঝুঁকছে। আর হাতে লেখা ব্যানারে খুব বেশি ডিজাইন করা যায় না, কিন্তু ডিজিটাল ব্যানারের কাজ যেহেতু কম্পিউটারে হয় সে কারণে সেখানে ছবি থেকে শুরু করে পছন্দমতো সব ডিজাইন, সব কালার ব্যাবহার করা যায়। সাথে খরচ কম, সেটাও মুখ্য বিষয়। তাছাড়া ডেলিভারিও খুব অল্প সময়ের মধ্যে পাওয়া যায়। আর্জেন্ট কাজ হলে এক ঘণ্টার মধ্যে ব্যানার তৈরি করে দেওয়া যায়।
আননুর গ্রাফিক্স দোকানের স্বত্বাধিকারী মুহাম্মদ ইউনুছ নূরী নাজিম জানান, ব্যানারের খরচটা নির্ভর করে মূলত কত গজের ব্যানার বানানো হচ্ছে তার ওপর। যেমন আড়াই গজ ব্যানার কাপড়সহ বানাতে খরচ হবে ডিজাইন ও ধরন অনুযায়ী ২৮০ থেকে ১হাজার ৫শ টাকা। আর যদি অনেক বড় সাইজের ব্যানার বানানো হয় তাহলে গজ প্রতি খরচ পড়বে ৮০ থেকে ২৫০ টাকা। ডিজিটাল ব্যানারের জন্য প্রতি স্কয়ার ফিট খরচ হবে ২৫ থেকে ৩শ টাকা। এটা মূলত নির্ভর করে সাইজ আর ব্যানারটি কতোটা জাকজমক হচ্ছে তার ওপর। ডিজিটাল ব্যানার বানাতে আকার ভেদে ফিট প্রতি খরচ হতে পারে ১৬-২০টাকা।
ব্যানারের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ হল ফেস্টুন। ফেস্টুন সহজে বহনযোগ্য। স্কুল-কলেজে ভর্তি কোচিংয়ের জন্য যে ধরনের ফেস্টুন পাওয়া যায় সেগুলো বানাতে খরচ খুবই কম পড়ে আর টেকসইও বেশি। ফেস্টুনের খরচটা বেশ কম পড়বে যদি আপনি একসঙ্গে ১শ থেকে ৫শ পিস বানান। এক্ষেত্রে খরচ পড়বে ২ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকা। তবে একটা বা দুটো করে বানালে খরচটা একটু বেশিই পড়বে। প্রতি পিস ফেস্টুনের জন্য খরচ পড়বে ৫০ থেকে ২০০ টাকা। তবে ডিজিটাল ফেস্টুনের দাম পড়বে ২৫০ থেকে ৫০০ টাকা। তবে মান অনুযায়ী খরচের পরিমাণটা কমবেশি হতে পারে।
বিগত কয়েক বছরে বিলবোর্ড রাজনীতিতে দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। রাস্তার ধারে বিশাল বিশাল বিলবোর্ডে ঢাকা পড়েছে শহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও।
বিভিন্ন দিবসকে ঘিরে শুরু হয় বিলবোর্ডের রমরমা প্রতিযোগিতা। কার চেয়ে কে বেশি বিলবোর্ড আর ব্যানার লাগাতে পারে তা নিয়ে রীতিমতো শুরু হয় প্রতিযোগিতা। এখন সামাজিক, রাজনৈতিক কিংবা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বিলবোর্ডই যেন হয়ে উঠেছে প্রচারের একমাত্র মাধ্যম। সময় ও খরচ বাচাতে ডিজিটাল প্রচার মাধ্যমে ঝুঁকছে মানুষ। আর এতে অলস সময় পার করছে চারুশিল্পীরা। আর দিন দিন কমছে জনপ্রিয়তা। ফলে আগ্রহ হারাচ্ছে নতুন প্রজন্ম। তাতেই বিলুপ্তির পথে এক সময়ের জনপ্রিয় চারুশিল্প পেশা।