টপ্পার আসর ভেঙে যাওয়ার পর
একটা কোড়াপাখির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল
নিঃস্পৃহ, বীতশ্রদ্ধ; চোখে তাবৎ শঙ্কাÑ
বসে আছে কচুরি-জংলার পাশে
শে^তাঙ্গ চাঁদের মতো একা, ভীষণ একাকী
সে রাতেই মধুবালা এসেছিলেন
লীন হয়ে গেছে ভুবন-কাঁপানো হাসি; এবংÑ
রাঙা হালতির মতো নির্মল দেহের লাবণ্য-দ্যুতি
কোথায় যে হারিয়ে গেল মায়াবি ঠোঁটের উচ্ছলতা
মেঘাচ্ছন্ন চেহারায় পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে
চোখের জল মুছতে মুছতে বললেনÑ
শেষ পর্যন্ত মার্বেল পাথরে মোড়ানো
আমার কবরটিও ভেঙে ফেললে তোমরা?
এত নির্দয়! এক জনমে কেন এত লোভী হয় মানুষ?
যেদিকে তাকাই কেবলই দেখি
হিংসা-বিদ্বেষ, পরচর্চা আর লালসার আল্পনা
রক্তের ভেতর থেকে জেগে উঠা
এ পৃথিবী সভ্যদের জন্যে নয়
ভাদু-ঘেটু-ভাওয়াইয়া এবং হালতিগানের মতো
নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় বিশ^াসের নুড়ি
মিটে গেছে পুর্নজন্মের তৃষ্ণা
তোমরাই থাকো প্রনষ্ট সময়ের সাক্ষী হয়ে
তার কথার সদুত্তর দিতে পারিনি
সমস্ত জীবন পার করছে যে যন্ত্রণার লরি টানতে টানতে
কবর ভেঙে ফেললে কতটুকুই বা ক্ষত হয় তার মন
কতটুকুই বা হারায় তার জীবনের মূলধন
যে জনমের নামÑশূন্যতার জার্নাল
তার জন্ম-মৃত্যু কিংবা সুখ-দুঃখের
হিসেব রাখার সময় থাকে কই
যে হাসি ঢেউ তুলেছে কোটি মানুষের প্রাণে
যে চোখ কিশোর কুমারের ধর্ম করেছে হরণ
সে মুখের মলিনতা ঘোচেনি কোনোদিন
সে চোখেও নামেনি একরক্তি শান্তির ঘুম
তার হঠাৎ কবর ভাঙার মায়া
একি জগতের প্রতি পাহাড়প্রতীম প্রেম
নাকি তীব্র অনিহার গোপন তস্তুরি
ভীষণ ভাবনায় ফেলে দিল
দুঃখের কোনো মানচিত্র নেই, নেই ব্যাকরণ প্রকরণ
কারণÑমানুষের চেয়ে বড় কোনো নক্ষত্র নেই
দুঃখ ছাড়া যায় না লেখা মহাকাব্য
এ সময় কোত্থেকে যে উড়ে এল সেই কোড়াপাখি
ঝোঁপের আড়ালে সঙ্গীবিহীন একা একা
শ্লেষমাখা সুরে হঠাৎই গেয়ে উঠলÑ
‘পেয়ার কিয়া ত ডরনা কিয়া
পেয়ার কিয়া কয়ি জুড়ি নেহি কি
চুপ চুপ আওহে ডর না কিয়া’
হায় মধুবালা, মমতাজ দেহলভী!
আস্ত একটা জীবন উৎসর্গ করলেন স্বেচ্ছায়
ভারতবর্ষকে মুখরিত করেছিলেন অভিনয়ে, নৃত্যমুদ্রায়Ñ
পিতার অভাবের সংসারে ধরেছিলেন হাল
বিনিময়ে ক্ষত যকৃত আর রক্ত বমি ছাড়া
কিছুই জোটেনি কপালে
তোমার দুঃখ কীভাবে বুঝবে দীলিপ কুমার
সায়রার উজ্জ্বল মুখ যে বারবার ইউসূফের দরোজায়
কড়া নেড়েছেÑতোমার প্রেম, দুঃখবোধ অধরাই থাকুক
জগতের লক্ষকোটি ভক্ত-স্বজন এখনও শুনতে পায়
‘ইক পারদেছি মেরা দিল লেগায়া
জোতে জোতে মিঠা মিঠা হাম দেগায়া’
হঠাৎ বিকট শব্দে কেঁপে উঠল পৃথিবী
শুনতে পেলাম চিরচেনা এক কণ্ঠস্বর
বিস্মায়ভিভূত হয়ে তাকিয়ে রইলাম Ñ
‘আয়াদত হোতি জাতি হ্যায় ইবাদত হোতি জাতি হ্যায়
মেরে মরনে কি দেখো সব কো আদত হোতি জাতি হ্যায়
দোস্ত মেরি গমেখোয়ারি মেঁ সয়ি ফরমাওয়েঙ্গে কেয়া
যখম কে ভরনে তলক নাখুন না বাঢ় আওয়েঙ্গে কেয়া’
গাইতে গাইতে এগিয়ে এলেন মিনা কুমারি
চেহারার রক্তিম উজ্জ্বল আভা চোখ ধাঁধিয়ে দিল
হাতে কাফনের মতো এক টুকরো কাগজ, সাদা
বললাম, হে বেবি নায, মীনাÑ
আপনি তো কবি ছিলেন
সিনেমার অভিনয়কলা আপনার
কবি পরিচয় লুপ্ত করে দিয়েছে
কবিতার শরীরে গিলাপ লাগিয়ে দিয়েছে
যেমনিভাবে মেহেজাবিন বানু নামের গায়ে
একদিন গিলাপ লাগিয়ে দিয়ে হয়ে উঠেছিলেনÑ
মীনা কুমারি, কবি নায কিংবা বেবি মীনা
ভারত-পাকিস্তানের অসংখ্য বিদগ্ধ পাঠক
আপনার কাব্যের প্রতি অনুরক্ত ছিল
পাইরেটেড কপি বইও কিনে কিনে পড়েছে তারা
কবি তকমা তো জুটেছে মৃত্যুর পর; যদিওÑ
পাকিযা, বেজু বাওরা সিনেমাই আপনাকে
দিয়েছে অমরত্বের ঘ্রাণ; কিন্তু কবিতার মতো
পবিত্রতম সম্পদের প্রতি একটু যেন বেখেয়ালি ছিলেন
জীবৎকালে চাইলে আরও শক্তভাবে দাঁড়াতে পারতেন
কাব্যবেদীতে; আপনি তা করেনিÑ
এ যে প্রতিভার প্রতি অবিচার, সত্তার প্রতি অন্যায়
এতকাল পরে হঠাৎ এই ডেরায় পদধুলি দিলেন
আপনার আগমনে ঋদ্ধ হয়েছে পৃথিবী
মুগ্ধ হয়ে জেগে উঠছে চরাচর
আপনাকে জানাই সাদর সম্ভাষণ
কিছুটা বিব্রত হলেন মহানায়িকা মীনা
বিস্ফারিত চোখে পরোখ করলেন চর্তুদিক
এসব যেন নতুন করে শুনছেনÑ
একটুখানি দীর্ঘশ^াস ছাড়লেন; বললেন,
যে পৃথিবীতে একটি বিশ^স্ত হাত নেই
সেখানে কবিতারাও একদিন বিশ^াসযোগ্যতা হারাবেÑ
এটাই যে নিয়ম!
ছুরি ফলার মতো কথাগুলি কানে এসে বিঁধল
নিঃসঙ্গ আকাশে বসে আছে নির্বিকার চাঁদ
দুচোখ নিক্ষেপ করলাম সেখানে
কথা বলার ভাষা খুঁজছি, পাই নাÑ
আবারও আড়াল থেকে করুণ সুরে
গান গেয়ে উঠল একটি কোড়াপাখিÑ
‘বাচপান কি মহাব্বত কো
দিল-ছে নাজুদা কারনা
যব ইয়াদ মেরিয়ায়ে
মিল-নে কি দোয়া কারনা’
করুণ সুরে চিনচিন করে উঠল বুক
টনটন করে ঘুরতে লাগল মাথা
চারপাশ আরও গুমোট পাকিয়ে এল
ইতিউতি পায়চারি করা ছাড়া
গতি রইল না আর
নির্মম এক বৃত্তের ভেতর দাঁড়িয়ে রইলাম স্থির
ধীরে ধীরে লীন হয়ে গেল পাখির সুর
শীতল হয়ে এল শরীর; বুজে এল চোখ
সম্বিৎ ফিরতেই দেখি মিনা কুমারি নেই
সামনে আরেক বিস্ময়কর নারীমূর্তি
হন্তদন্ত হয়ে এসে দাঁড়ালেন সিলভিয়া প্লাথ
মুচকি হেসে বললামÑআপনি বড্ড অভিমানী
টেড হিউজের সঙ্গে রাগ দেখিয়ে অযথা
নিজেকে শেষ করে দিলেন; এ যেÑ
কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়
কবিতার স্বেদস্নিগ্ধতা থেকে তাবৎ মানুষকে
এভাবে বঞ্চিত না করলেও পারতেন
জগতে এখনও কবিতা বলতে আপনাকেই বুঝি
‘বিভ্রান্তিকর সঙ্গীত আর মন্থিত পানীয়ের
ভিতরে মেয়েটি অনিবার্য শুনতে পায়
দেওয়াল ঘড়ির মর্মান্তিক টিকটিকানি’
বোধকরি, সিন্ডারেলাÑকবিতার পঙক্তিগুলো
আপনি আপনাকে উদ্দেশ্য করেই লিখেছেন
রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেন সিলভিয়া প্লাথ
গ্যাসের চুল্লির মতো ধক করে জ¦লে উঠলেন
কর্কষকণ্ঠে আপন মাতৃভাষায় উচ্চারণ করলেনÑ
‘আরক্তিম রেকাবের মেয়েটির ওপর
রাজপুরুষটি ঝুঁকে থাকে
তালের সমান কিঞ্চিৎ মন্দ হয়ে এলে
উল্টে যাওয়া বেহালায় ঘূর্ণিরা প্রসারিত হতে থাকে
মেয়েটির সবুজ চোখ চমকে ওঠেÑ
রুপোর পাতের মতো চুলগুলি ফ্যানের হাওয়ায় ঝলসায়
সুউচ্চ কাঁচের প্রাসাদে সবকিছুরই যেন
অবিরাম পুনরাবৃত্তি
যেখানে অতিথিরা মসৃণ আলোয় পিছলে যায়
মহার্ঘ্য সুরার মতো’
সিলভিয়ার কথার জবাব দিতে পারিনি
এমন বিক্ষত আত্মার বিক্ষোভ রোধ করার মতো
জগতে সাধ্য আছে কার
ঝাঁঝালো শব্দের তলায় পড়ে
পিষ্ট হয়ে গিয়েছিলাম
হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে এবংÑ
কবিকে নিবৃত্ত করতে
ভয়ে ভয়ে কয়েক দফা আবৃত্তি করলাম
তার লেখা কবিতাংশ
ও যধাব ফড়হব রঃ ধমধরহ
ঙহব ুবধৎ রহ বাবৎু ঃবহ
ও সধহধমব রঃ-
অ ংড়ৎঃ ড়ভ ধিষশরহম সরৎধপষব গু ংশরহ
ইৎরমযঃ ধং ধ ষধসঢ়ংযধফব
ঔবি ষরহবহ
কী আশ্চর্য! এ দিকে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই
শব্দহীন পা ফেলে ফেলে এগিয়ে গেলেন শূন্যতার দিকে
পেছনে পড়ে রইল সময়ের রুগ্ন ফসিল
আকাশ বাতাস হাহাকার করে ধ্বনিত হতে লাগল
‘রেফ্রিজারেটরগুলোর মৃদু হাসি আমায় সম্পূূর্ণ বিনষ্ট করে দেয়
আমার প্রেমিকটির শোণিত শিরায় এমনই অশ্লীল বিদ্যুৎপ্রবাহ
আমি শুনতে পাই তার বিশাল হৃদয়ের গরগর আওয়াজ
তার ঠোঁট থেকে প্রতি মুহূর্তে আর শতাংশে
চুম্বনের মতো সঙ্কেতের নিষ্ক্রমণ হয়
তার প্রবৃত্তিতে কি সপ্তাহের সূচনা এখন?
নীতিশাস্ত্রে?’
একটি বারের জন্যেও ফিরে তাকাননি অভিমানী সিলভিয়া
প্রিয় টেড হিউজÑনারীর বিশ^াস হরণ করে
আপনি যে পুরুষত্ব জমা দিয়ে এসেছিলেন
অভিশপ্ত এক ইবলিশের কাছে
মৃত্যু পর্যন্ত ফিরিয়ে আনতে পারেননি তা
এ ভুলের কি ক্ষমা হয় কখনও
সেই যে কোড়া পাখি, ততক্ষণে সেও হাওয়া
কোথাও শোনা যায় না তার কণ্ঠধ্বনি
ভীষণ হাশপাশ করছে মন
এ মুহুর্তে পাখিটার সঙ্গ পাওয়া জরুরি
তার সাড়া পাওয়া ভীষণ দরকার; কিন্তু বজ্জাত পাখিটা
কোথাও নেইÑযেন একলহমায় বিলীন হয়ে গেছে
পৃথিবীর সমস্ত কোড়া
অন্ধকারে বেরিয়ে পড়লামÑ
হাঁটতে হাঁটতে পথের বাঁকে এসে থামলাম
আলোহীন শিমুলের ছায়ায়
তানপুরা হাতে বসে আছেন শ্রীমতি গীতা দত্ত
চোখ বন্ধ করে গেয়ে চলেছেনÑ
‘কোন রক্তিম পলাশের স্বপ্ন
মোর অন্তরে ছড়ালে গো বন্ধু
এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়
একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধ’ু
আর না। অনেক হয়েছে। পালানো ছাড়া গতি নেই।
পেছনের দিকে ছুটতে লাগলাম
বাঁচতে হলে এ তল্লাট ছাড়তে হবে
দেহের সমস্ত শক্তি একত্র করে দৌড়ুতে লাগলাম
কোথায় যেন আটকে যাই বারবার
সাঁড়াশির মতো কারা যে খাঁমচে ধরেছে পেছন থেকে
অন্ধকার এতটা দীর্ঘ হয় কেন
হঠাৎ অসংখ্য কোড়া পাখি উড়ে এসে
পথ আগলে ধরল; সমস্বরে গাইতে লাগল
‘বাঁশি বুঝি সেই সুরে আর ডাকবে না
ফাগুনের দিনগুলি কি আর থাকবে না’।
ছোট ছোট পাখিগুলির গলায় এত শক্তি আজ
কোথা থেকে এলো; এরা কি আসলেই…
দুই হাতে দুই কান চেপে ধরলাম
মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম। কিন্তুুÑ
আঙুলের ভেতর থেকে এবার বেরিয়ে এল
রামকুমার মুখার্জীর টপ্পা গানের সুললিত ঝংকারÑ
‘যুমনায় জল আনতে যাচ্ছো সঙ্গে নেই তো কেউ
তুমি কাদের কুলের বউ গো তুমি কাদের কুলের বউ
যাচ্ছো তুমি হেসে হেসে কাঁদতে হবে অবশেষে
আর কলসি তোমার যাবে ভেসে ঐ রাগলে চরের ঢেউ’
টপ্পা গান শুনতে শুনতে মাটিময় শীতল পাটিতে
পরম আনন্দে ঘুমিয়ে পড়লাম সে রাতে!
মাটির মতো এতটা স্নেহ-ভালবাসা; পৃথিবীর মানুষের কাছে
কোনোদিন, কোনোকালেই পাইনি।