বিল্লাল ঢালী:
মনা মিয়া চাঁদপুর ক্লাবের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছেন। পেশায় একজন ভিক্ষুক। সারাদিন ভিক্ষা করে যে কয় টাকা রোজগার হয় তা দিয়ে চলে তার সংসার। ক্লাবের সামনে কয়েকবার ঘোরাঘুরি করতে দেখে ক্লাবের এক কর্মচারী জিজ্ঞেস করল আপনি বারবার ঘোরাঘুরি করছেন কেনো? কাউকে খুঁজছেন নাকি? মনা মিয়া উত্তর দিল না আমি কাউকে খুঁজতাছি না। দেখলাম কোন অনুষ্ঠান হয় কিনা। অনেকদিন হইছে দুইটা ভালো-মন্দ খাইতে পারি না। তাই ভাবলাম যদি কোন অনুষ্ঠান হয় তাইলে খাওন খুঁজমু।
মহামারী করোনা পাল্টে দিয়েছে সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজনের চিত্র। বিয়ে মানেই একটি বিশদ প্রস্তুতি। একটা মোটা অংকের বাজেট। সমাজ বা দেশের অল্পকিছু পরিবার এমন বিলাসী খরচ করতে পারলেও কারো জন্যে এটা হয় বড় বোঝা। অবশ্য করোনা মৌসুমে মানুষের মাঝে তৈরি হয়েছে ব্যয় সংকোচনের প্রবণতা। যে কারণে সব ধরণের সামাজিক অনুষ্ঠান হচ্ছে এখন ঘরোয়া আয়োজনের মধ্য দিয়ে। করোনা মানুষকে বাধ্য করেছে মিতব্যয়ী হতে। তাই গত কয়েক মাস ধরে চোখে পড়ছে না জমকালো কোনো বিয়ে, বৌ-ভাত, জন্মদিন, আকিকা কিংবা মৃতের চারদিনামিলাদ বা চল্লিশা। কোন বাড়ির সাজানো হচ্ছে না ঝলমলে আলোয়। বিয়ের অনুষ্ঠানে চোখে পড়ছে না বিশাল গাড়িবহর।
বিয়ে, বৌ-ভাত, জন্মদিন, মেজবানের মত সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজন উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। যে কটা অনুষ্ঠান হচ্ছে তা হচ্ছে ছোট পরিসরে, পারিবারিক বা ঘরোয়াভাবে। বিশেষ করে শুক্রবার মানুষের ব্যস্ততা বেশি থাকতো অনুষ্ঠানগুলোতে অংশগ্রহণের জন্য। এখন মানুষের সে ব্যস্ততা নেই। সমাজের অবস্থা সম্পন্ন লোকদের হিমশিম খেতে হতো কোন অনুষ্ঠান ছেড়ে কোন অনুষ্ঠানে অংশ নেবে। তারা এখন মুক্ত। দিনের শুরুতে তাদের এখন অনুষ্ঠান নিয়ে হিমশিম খেতে হয় না। পরিবারকে বিয়ের আয়োজনে চিন্তা করতে হয় না, কত লোক দাওয়াত দিবে কিংবা কত টাকা খরচ হবে তা নিয়ে।
করোনাকালে বিয়ে হয়েছে এমন পরিবারের সাথে কথা বললে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকটি পরিবার প্রধানরা জানায়, বিয়ে একটি সামাজিক অনুষ্ঠান। সব পরিবারের চাওয়া থাকে তার ছেলে মেয়েকে একটু জমকালো আয়োজন করে বিয়ে দেওয়ার। কিন্তু বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে তা সম্ভব হচ্ছে না। এটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানুষের জন্য উপকার বয়ে এনেছে। অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য আমাদের সবাইকে চিন্তায় থাকতে হয় কত টাকা খরচ হবে? কিভাবে টাকা আসবে? কি কি আয়োজন থাকছে। এসব বিষয় নিয়ে। কাকে রেখে কাকে দাওয়াত দিব? ষোল আনা দাওয়াত দিবে নাকি ব্যক্তি বিশেষ। অনুষ্ঠানে এটি একটি বড় বিষয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কারো সাধ্য আছে ১০০ জনকে দাওয়াত দেয়ার। কিন্তু সামাজিক কারণে ২০০ জনের আয়োজন করতে হচ্ছে। এতে অনেকেই বাড়তি খরচের চাপে পড়েন। হয়ে পড়েন ঋণগ্রস্থ। তার সাথে অনুষ্ঠানের অন্যান্য খরচ তো আছেই। এখন সবাই এসব ঝামেলা থেকে মুক্ত।
বিপরীত কথাও বলছে কিছু কিছু পরিবার। ছোটবেলা থেকেই ছেলে মেয়ে বড় করেছি, স্বপ্ন দেখেছে একটি জমকালো অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বিয়ে দিবে। সকল আত্মীয়-স্বজনকে দাওয়াত দিবে। সকল আত্মীয়-স্বজন এক জায়গাতে জড় হবে, আনন্দ করবে। এখন তা হচ্ছে না। বিয়ে তো মানুষের জীবনে একবারই হয়। সে বিয়েতে যদি খরচ না হয় তাহলে কি তাকে বিয়ে মনে হয়?
অপরদিকে করোনায় চাঁদপুরের কমিউনিটি সেন্টার ও পার্টি হলের মালিকরাও পড়েছেন মহাবিপাকে। এ সংকটে পড়ে গত চার মাস ধরে কমিউনিটি সেন্টার ও পার্টি হাউসগুলো বন্ধ রয়েছে। এ কারণে হল মালিকসহ এ পেশায় জড়িত শ্রমিক, বয়, ক্রোকারিজ ধোয়ার লোক, বাবুর্চিসহ নানান পেশার মানুষ গত চার মাস ধরে একপ্রকার বেকার। কাজ না থাকায় তাদের অভাবে দিন কাটছে। সামাজিক, ধর্মীয়সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে কমিউনিটি সেন্টার ও পার্টি হল প্রতিনিয়ত লোকে জমজমাট থাকলেও এগুলো যেন খাখা করছে। সিকিউরিটি গার্ডরা চার মাস ধরে এগুলো পাহারা দিয়ে রেখেছেন। কোন আয় নেই। প্রতি মাসে আর্থিক ক্ষতি গুণছেন মালিকরা।
বিয়ে, বউভাত, জন্মদিন, মেজবানের মতো উৎসব পালন হয় ঘরোয়া ভাবে। এতে কমিউনিটি সেন্টার ও ডেকোরেটরসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো লোকসানে পড়েছে। মানভেদে প্রতিটি কমিউনিটি সেন্টারে গড়ে ২০ থেকে ২৫টি অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। কিন্তু এবারই ব্যাতিক্রম। অধিকাংশ মানুষই কমিউনিটি সেন্টার বুকিং বাতিল করেছে। নতুন করে বুকিং দেওয়াও বন্ধ রয়েছে। মান ভেদে এসব কমিউনিটি সেন্টারে ভাড়া ১০ হাজার থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত।
শুধু কমিউনিটি সেন্টারগুলোই নয়, সামাজিক উৎসবে ভাটা পড়ায় লোকসানে পড়েছে ডেকোরেটর, বাবুর্চি, ফুলসহ সংশ্লিষ্ট আরও অনেক ব্যবসায়। পালকি কমিউনিটি সেন্টারের স্বত্ত্বাধিকারী মোঃ সিদ্দিকুর রহমান জানান, ‘কমিউনিটি সেন্টার ও পার্টি হলে ব্যবসায়ীরা লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছি। কিন্তু সময় খুব খারাপ যাচ্ছে।
লাকি ডেকোরেটর মালিক দীপক জানান, গত চার মাসে আমাদের ব্যবসা পুরোপুরি বন্ধ আমরা কর্মচারীদের ঠিকমত বেতন দিতে পারছি না। লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যবসায় মূলধন। এখন ধারদেনা করে চলছি। অর্ধেক কর্মচারী ছাঁটাই করেছি। অর্ধেক কর্মচারী আছে। যারা আছে তাদের কাজ নেই তারপর ব্যবসার স্বার্থে তাদেরকে রাখতে হচ্ছে।
কমিউনিটি সেন্টার ও পার্টি হল ব্যবসার সাথে জড়িত শ্রমিক, বয়, ক্রোকারিজ ধোয়ার লোক, বাবুর্চি, বাবুর্চি সহকারী, মরিচ বাটা লোকসহ অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষ গত চার মাস ধরে বেকার। কোন রকম কাজ কর্ম নেই। কষ্টে দিন কাটাচ্ছে তারা। বর্তমানে প্রতিটি কমিউনিটি সেন্টারের অফিস ম্যানেজার, সিকিউরিটি গার্ড, সুইপার, ইলেকট্রিশিয়ান ইত্যাদির বেতন, পানি ও বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে। বিপরীতে প্রতি মাসের হল ভাড়া বাবদ বিরাট অংকের টাকার লোকসান গুনতে হচ্ছে। এ অবস্থায় প্রতিটি কমিউিনিটি সেন্টার ও পার্টি হলের সেন্টারের ব্যবসায়ী মালিকরা আর্থিক ও মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েছে এবং এক অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। তাছাড়া কমিউিনিটি সেন্টার ও পার্টি হল বন্ধ থাকায় মালিকরা বিশাল অংকের ক্ষতি গুনছে।
পোলট্রি ব্যবসায় জড়িত আল-আরাফা পোল্ট্রি ফিড এন্ড চিকস এর স্বত্ত্বাধিকারী মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম পাটোয়ারী জানান, করোণা মহামারীতে আমাদের ব্যবসার অবস্থা খুব একটা ভালো নেই। অধিকাংশ খামারি বাচ্চা ওঠানো বন্ধ করে দিয়েছে। আমাদের ব্যবসায়ীদের লক্ষ লক্ষ টাকা খামারিদের কাছে আটকা পড়েছে। আমাদের খামারে উৎপাদিত মুরগী ও ডিম স্থানীয় বাজারের চাহিদা যোগান দেয়। বর্তমানে খামারের উৎপাদিত মুরগি ডিম বাজারজাত কম হচ্ছে। এর একটি বড় কারণ হচ্ছে এখন সামাজিক ধর্মীয় অনুষ্ঠান বড় পরিসরে হচ্ছে না। যা হচ্ছে তা ঘরোয়া পরিবেশে আয়োজিত হচ্ছে। আগে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে ৪০০/৫০০ লোকের খাবারের আয়োজন করা হতো। খাবারের মেনুতে মুরগি ডিম থাকতো। কিন্তু এখন বাজারে ডিম মুরগির চাহিদা কম। যদিও অনেক খামারি দাম না পাওয়ায় মুরগি উঠানো বন্ধ করে দিয়েছে। যে কারণে খুচরা বাজারে দামের উপর খুব বেশি প্রভাব পড়েনি।
অবশ্য সুশিল সমাজ বলছে, মানুষের আয় কমেছে যেমনি করচের মানসিকতাও অনেকাংশেই কমে গেছে। মূলত আয়ের প্রবাহ কম হওয়ায় সামাজিক আয়োজনগুলোর পরিসর ছোট করে নিয়েছে মানুষ। যদি মানুষকে মিতব্যয়ী হতে শিখিয়েছে করোনা।