কাদের পলাশ
ইদানিং আমার সাথে সময়ের চরম দ্বন্দ্ব চলছে। সময় চলছে সময়ের গতিতে। আমি চলছি আমার…। সময় আর আমার অবস্থান এখন দুই মেরুতে। আমার অপরাধ, কাজ আমার অনেক কাছাকাছি, কাজকেই বেশি ভালোবাসি। অবশ্য এ কারণে নতুন বন্ধুত্ব পেতেছি বৈরী আবহাওয়ার সাথে। কখনো ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা আবার কখনো তীব্র দাবদাহ ভেদ করে হালকা মিহি বৃষ্টি। যে বন্ধুত্ব ভালো থাকতে দেয় না। বিশেষ করে এমন বৈরী আবহাওয়ার দরুণ মাথা ব্যথা নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাত জেগে কাজ করি আর হাঁচি দিই। গবেষকদের মতে, গভীর রাত জাগা স্বাস্থ্যসম্মত নয়। রাত ১১টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়া স্বাস্থ্যের জন্যে অনেক ভালো। আর আমি ঠিক এই মুহূর্তে যখন ল্যাপটপের কী-র্বোড চাপছি, তখন ঠিক রাত ২টা ১৯ মিনিট ৩৬ সেকেন্ড। আজ চাঁদপুরের অন্যতম প্রধান স্থানীয় দৈনিক ‘চাঁদপুর কণ্ঠের’ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এ উপলক্ষ্যে গত প্রায় মাসখানেক কিছু লিখবো লিখবো ভাবছি। কিন্তু লেখা হয় না। কারণ ? ওই যে আমার আর সময়ের মাঝে চরম বিরোধ… তবুও যে কথাটি না বললেই নয়। আমি ২০১৪ সালের ১মে চাঁদপুর কণ্ঠের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট হিসেবে কাজ করেছি। অবশ্য চাঁদপুরের একাধিক পত্রিকায় এর চাইতেও অনেক বড় বড় পদে দায়িত্ব পালন করেছি। তবে তৃপ্তির ঢেঁকুর গিলতে পারিনি। কারণ প্রবাদে আছে, ‘বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’। চাঁদপুর কণ্ঠে যোগ দেয়া নিয়ে অনেকেই বিভিন্ন প্রশ্ন তুলেছেন। অনেক মন্তব্য করেছেন। এ নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ বা অনুযোগ নেই। তবে বিবেকের তাড়নায় চাঁদপুর কণ্ঠ নিয়ে আজ কিছু বলতে মন খুব সায় দেয়। চাঁদপুর কণ্ঠের পাঠক হিসেবে যখন পাঠক ফোরাম বিভাগে লিখতাম তখনও ভাবিনি সাংবাদিক হবো। কখনো জীবনের লক্ষ্য ঠিক করিনি। ভাবিনি জীবনে এটা হবো.. সেটা হবো। অথচ বাস্তব জীবনে কলম শ্রমিক পেশায় নিবেদিত হয়ে গেলাম। পেশাদারিত্ব নিয়ে যদিও কারো কারো সন্দেহ আছে। তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমি অবশ্য পেশাদারিত্ব বুঝি না। কলম শ্রমিক হিসিবে কাজ করছি..এ-ই বুঝি। যারা খুব বুঝেন, তারা কতটুকু বুঝেন তা নিয়ে সাংবাদিক মহলেই কারো কারো প্রশ্ন রয়েছে। সেদিকে যাচ্ছি না। চাঁদপুর কণ্ঠের পাঠক ফোরাম বিভাগ দিয়ে আমার লেখালেখি শুরু। এ বিভাগটি ছিল আমার প্রাণ। প্রতি শনিবার এ বিভাগের জন্যে পত্রিকার সার্কুলেশন অনেক বেড়ে যেতো এমনটা শুনেছি।
‘চাঁদপুর কণ্ঠ’ আমাকের কাছে এক ভিন্ন রকম অনুভূতির নাম। কারণ চাঁদপুর কণ্ঠে ২০০৭ সালের ১৪ ফ্রেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবসে আমার প্রথম লেখা প্রকাশ হয়। লেখার শিরোনাম ছিলো ‘ভালোবাসার খোঁজে’। মূলত আমার তিন বছরের প্রবাস জীবনের ইতি টেনে দেশে আসার পর অনুভূতি প্রকাশ করেছিলাম লেখাটিতে। লেখাটি প্রথমে ছিলো মক্তগদ্য। পরে অবশ্য গল্পের ঢং দিই। এর আগে শ খানেক কবিতা লিখেছি। একটা উপন্যাসও লিখেছি ২০০২ সালে। সাদা গণিত খাতায় লেখা উপন্যাসটি কুয়েতের একটি ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছি। কেন লিখি জানি না, কেনো ফেলি দিলাম তাও জানি না। তবে কবিতা (কবিতার মতো করে) লেখার যে চেষ্টা ছিলো তা অন্তত আমার পরিবারের সদস্য আর ভাই বন্ধুরা জানতো। বিশেষ করে আমার বড় ভাই (লেখক ও সাংবাদিক-আবু ইউসুফ) ভালো করে জানতেন। তিনি আমাকে ব্যাপক উৎসাহ দিতেন। সময়ের সাথে লেখালেখি চলতে থাকলো। কিন্তু লেখা প্রকাশ করতে হবে তা নিয়ে কখনো চিন্তাও করিনি। আমার বাল্যবন্ধু নিপুর মাধ্যমে কবির হোসেন মিজির সাথে পরিচয় হওয়ার আগে কথা। আমি তখন কুয়েত প্রবাসী। কবির মুঠোফোনে আমার গান শুনতে চাইলো। এর আগে অবশ্য আমার বন্ধু নিপুর তাকে বলেছে যে, আমি সখ করে গান গাই। গাওয়ার চেষ্টা করি। কুয়েতে বসেই তাকে গান শুনালাম। এরপর দেশে এসে কবির মিজির সাথে দেখা হলো, কথা হলো। জানলাম সে কবিতা লিখে। তার লেখা পত্রিকায়ও প্রকাশ হয়। আমি কবির মিজিকে বললাম, আমার লেখাগুলো প্রকাশ করতে চাই। কবির মিজি বললো, লেখা পাঠিয়ে দে। মনোনীত হলে অবশ্যই ছাপবে। আমি ঠিকানা দিতে বললাম। সে ঠিকানা দিলো, কবির হোসেন মিজি, শাহী ফার্মেসী, মিশন রোড, চাঁদপুর। ‘ভালোবাসার খোঁজে’ লেখাটি পাঠালাম। কবির মিজি রিসিভ করে চাঁদপুর কণ্ঠের বিভাগীয় সম্পাদক ক্ষুদীরাম দাস-এর কাছে পৌঁছে দিলেন। এখনকার কবির হোসেন মিজি তখন ভিন্ন পেশার মানুষ ছিলেন। এখন সাংবাদিক হিসেবেই সবাই চেনে ও জানে। লেখক মানুষ তাই সুযোগ পেলেই তার সাথে আড্ডায় মেতে উঠতাম। কিন্তু এখন আর হয়ে উঠে না।
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ সাল দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ আমার অনুগল্পটি প্রকাশ করবে আগের রাতে জানতাম। সেদিন রাত ঘুমাতে পারিনি। এ এক অন্যরকম অনুভূতি। রাত যেন ভোর হয় না। একপ্রকার ঘুমহীন রাত কাটলো। ভোরে পত্রিকার স্টলে পৌঁছে গেলাম। তখনো পেপারের বাণ্ডিল খোলা হয়নি। যখন খোলা হলো পাতা উল্টে বেজায় খুশি। তিন কপি দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ কিনে বাড়ি আসি। মা-কে দেখাই, ভাই ও বোনকে দেখাই। কিন্তু অন্য কাউকে দেখাতে সাহস পেলাম না। কি কারণে জানি না। তবে কেনো যেনো ইতস্ত হলো অন্য কাউকে দেখাতে। এরপর দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের বিভাগীয় সম্পাদক ক্ষুদীরাম দাস-এর সাথে মুঠোফোনে কথা হলো দেখা হলো। সম্পর্কটা নিবিড় হলো। প্রতি সপ্তাহে আমার লেখা প্রকাশ শুরু হলো। বলে রাখা ভালো জীবনের দ্বিতীয় গল্প লিখেই পুরস্কার জিতেছি। তখন চাঁদপুর কণ্ঠ বিষয় ভিত্তিক গল্প প্রতিযোগীতার আয়োজন করতো। আমার দ্বিতীয় প্রকাশিত লেখাটির নাম ছিলো ‘বিচ্ছেদের অনল’। প্রতিযোগীতার বিষয় ছিলো ‘বিচ্ছেদ’। পুরস্কারটি জিতে গেলাম। এরপর চাঁদপুর কণ্ঠের-ই অসংখ্যা পুরস্কার পেয়েছি। আজো লিখে চলেছি। ইতোমধ্যে আমার দুইটি গল্পের বই, একটি কবিতা ও তিনটি সম্পাদনা গ্রন্থ প্রকাশ হয়েছে। আরো অন্তত তিনটি পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত রয়েছে। আমার লেখার উৎকর্ষের জন্যে অবশ্যই চাঁদপুর কণ্ঠের কাছে আমি ঋণী। এ ঋণ শোধাবার সম্ভব নয়। কারণ চাঁদপুর কণ্ঠ আমার লেখা ছাপার সুযোগ করে দিয়েছে বলেই হয়তো লেখক হিসেবে অন্তত পরিচয় দিতে পারছি। আমার লেখাই এখন জাতীয় পত্রিকা, অনলাইন নিউজ পোর্টাল, লিটলম্যাগসহ বিভিন্ন কাগজে প্রকাশ হচ্ছে। কাগুজে পত্রিকার সে রমরমা দিন এখন আর নেই। এখন ভার্চ্যুয়াল যুগ। তবুও চাঁদপুরের পাঠক হৃদয় জয় করে আছে এ পত্রিকাটি। একজন লেখক হিসেবে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের আরো সমৃদ্ধি কামনা করছি।
আগেই বলেছি আমার আর সময়ের মাঝে বৈরি সম্পর্ক। দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের পাঠক ফোরাম হচ্ছে, নতুন উদীয়মান তরুণ লেখকদের প্রাথমিক স্কুল। প্রেরণা, সাহস, যোগ্যতা অর্জনের সুবর্ণ সুযোগ দেয় চাঁদপুর কণ্ঠের পাঠক ফোরম বিভাগ। এ বিভাগ থেকে যেমনি আমার পথ চলা শুরু। চাঁদপুরে এমন অনেকেই আছেন সিনিয়র ও জুনিয়র যাদের পথ চলা এখান থেকেই। আমি কারো নাম উল্লেখ করতে চাই না। অনেকেই পেছনের কিংবা অতীতের কথা ভুলে যেতে চান বর্তমান প্রেক্ষাপটে। অবশ্য শেকড়কে ভুলে শিখরে ভালো থাকা যায় না। অন্তত সত্য প্রকাশ না করতে পারায় মানসিক অতৃপ্তি থেকে যায়। যা অন্য কারো ক্ষেত্রে না হোক, আমার বেলায় প্রযোজ্য। মন যা বলতে চায়, তা সাজিয়ে গুছিয়ে প্রকাশ করাই হয়তো কবিতা। আর গল্প, কল্পনা আর বাস্তবতার শব্দগুচ্ছ। অবশ্য সময়…! যে কারণে সাহিত্য জগৎ আর আমার পৃথিবীর মাঝে একটি অদৃশ্য সাড়ে তিন ইঞ্চি ইটের দেয়াল উঠেছে। অবশ্য আমার সাহিত্য চর্চা চলছে কচ্ছপ গতিতে। তবে একেবারে থেমে নেই। কারণ লেখালেখির জগতেই তো আছি। এই তো বেশ আছি। অফিসের অ্যাসাইনম্যান্টে কাজ করতে গিয়ে সকালে বের হলে প্রায় দিন শেষে রাত হয়। খাওয়া-দাওয়া অনিয়ম করতে করতে পেটের ভেতর গ্যাস্ট্রিকের ফ্যাক্টরী বানিয়ে ফেলেছি। রাতে যখন বাসায় ফিরি তখন চোখে আবছা আবছা দেখি। কী বোর্ডে চাপতে গেলে চোখ বুঁজে আসে। ক্লান্তি… তারপরেও কাজ শেষ করতে হবে, তাই অনেক কষ্টের মাঝেও পরদিন সকালে অফিসের অ্যাসাইনমেন্ট বুঝিয়ে দিই। আর তাই অমূল্য সম্পদ সময় আমার সাথে খুব নিষ্ঠুর আচরণ করে। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া হয় না। বহুদিন হয় দূরে কোথাও বেড়াতে যেতে পারি না। কাজের চাপে প্রিয় মানুষটির সাথে কখনো কখনো খুব নিষ্ঠুর আচরণ করতেও দ্বিধা করি না। পরে অবশ্য খুব অনুতপ্ত হই। মনে হয় সবাই স্বার্থ নিয়েই বেশি ব্যস্ত। আমিও। এভাবেই চলছে জীবন..
লেখক: সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক শপথ।