বিল্লাল ঢালী:
কবি হেলাল হাফিজের “ফেরীঅলা” কবিতার পঞ্চম লাইন ‘পাথর চাপা সবুজ ঘাসের সাদা কষ্ট’। কষ্টের কতো চমৎকার উপমা। সবুজ ঘাস পাথর চাপায় সাদা হতে হতে কতো কষ্ট সহে যায়, তা পাথর বুঝতে পারে না। নেই প্রতিবাদ করার শক্তিও। অথচ সবুজ ঘাসের ছিলো কতো সতেজ আর প্রাণবন্ত বেঁচে থাকা। এভাবেই চাঁদপুরের হাজার হাজার খন্ডকালীন শিক্ষক পাথর চাপা কষ্ট বুকে নিয়ে দিনপার করছেন। করোনাকালীন সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় জুটছে না নূন্যতম সম্মানী। কাউকে বলতে পারছেন না কষ্ট আর আর্থিক সংকটের কথা। দাবি বা প্রতিবাদের ভাষাও যেন ভুলে গেছেন তারা। চাঁদপুরে ৫৮৩ বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই দুইবা ততোধিক খ-কালীন শিক্ষক রয়েছে। করোনাকালীন সময়ে তাদের জীবন চলছে টানাপোড়নে। কিন্তু মুখ ফুটে কাউকে কিছু বলতেও পারছেন না। স্কুল কলেজ বন্ধ থাকায় প্রতিষ্ঠান থেকে তাদের সামন্য প্রাপ্তিটুকুও পরিশোধ করতে পারছে না। এছাড়াও চাঁদপুরে চারটি প্রাইভেট কলেজ রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাও পাচ্ছে না বেতন বা সামন্যতম প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা। অবশ্য আশার কথা হচ্ছে চাঁদপুর জেলা শিক্ষা অফিসের মাধ্যমে নন-এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও নন-এমপিও শিক্ষকদের একটা তালিকা করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে সে তালিকা পাঠানো হয়েছে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দপ্তরে। বিশেষ করে নন এমপিও শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ কারিগরি ও মাদাসা শিক্ষা বিভাগ এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের আওতায় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্মচারীদের তালিকা করে পাঠানো হয়েছে।
জানা যায়, চাঁদপুরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কয়েক হাজার খ-কালীন শিক্ষক পাঠদান করান। সরকারি সিদ্ধান্ত মোতাবেক মহামারী করোনায় বন্ধ রয়েছে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সাথে বন্ধ হয়ে আছে এসব চুক্তিকালীন কাজ করা শিক্ষকদের আয় রোজগারের পথ। তাই কোন মতে মানবতার জীবন যাপন করছেন এ শিক্ষকরা।
কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে এসব শিক্ষকরা সম্মানী পান ক্লাসের উপর নির্ভর করে। আবার কিছু কিছু শিক্ষক মাসিক নূন্যতম সম্মানীতে নিয়োগ পান। প্রায় তিন মাস শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় এসব শিক্ষকদের আয় বন্ধ হয়ে আছে। প্রতিষ্ঠান বন্ধ তাই আয়ও বন্ধ। যে কারণ প্রতিষ্ঠানের নীতি নির্ধারকরা সম্মানীও দিতে পারছে না চুক্তিভিত্তিক এসব শিক্ষকদের। তাই বুকে কষ্টের পাথর বেঁধে নিভৃতে বয়ে বেড়াচ্ছেন জীবনের ঘানি। সরকার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে মহামারীতে। কিন্তু দূর্ভাগ্যক্রমে অন্তরালে থেকে গেছে আলোর পথ দেখানো এ মানুষজন।
শিক্ষা অফিসের তথ্য মতে, চাঁদপুরে ¯œাতকোত্তর বা ডিগ্রি কলেজ রয়েছে ২৫টি। এরমধ্যে দুইটি সরকারি ২৩টি বেসরকারি। উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ রয়েছে ১০টি, স্কুল এন্ড কলেজ ১৬টি, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ২৫৬টি (এরমধ্যে সরকারি ৭ আর বেসরকারি ২৪৯টি), নিন্ম মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১০টি, কামিল মাদ্রসা ৭টি, ফাজিল ৪৯টি, আলিম ৩৯, দাখিল ১০১টি, এবতেদায়ী ১৪ ও কাওমী মাদ্রাসা ৬৫টি। এছাড়া চারটি প্রাইভেট কলেজও রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন খ-কালীন শিক্ষক বলেন, শিক্ষকতা সম্মানের পেশা। এ পেশায় জড়িত সকলকে সমাজের মানুষ দেখে ভিন্ন চোখে। সমাজের সকল মানুষ এ পেশায় জড়িত মানুষদেরকে সর্বোচ্চ সম্মান দেওয়ার চেষ্টা করে। জীবন যাপনে অসুবিধা হলেও চক্ষুলজ্জায় কষ্টের কথা বলতে পারি না। চাইতেও পারি না।
বাবুরহাট উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজেই ১৭জন খন্ডকালীন শিক্ষক রয়েছে। এ শিক্ষকদের বিষয়ে অধ্যক্ষ মোঃ মোশারফ হোসেন জানান, আমরা গত মাস পর্যন্ত বেতন চালিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছি। ভবিষ্যতে পারবো কী না ভাবনার বিষয়।
শহরের গণি আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় ১৪জন খন্ডকালীন শিক্ষক রয়েছেন। এসব শিক্ষকদের গতমাস পর্যন্ত সম্মানী দেয়া সম্ভব হলেও আগামী মাস নিয়ে অনিশ্চয়তা পড়েছেন প্রতিষ্ঠান প্রধান। এবিষয়ে প্রধান শিক্ষক মোঃ আব্বাস উদ্দিন জানান, গত মাসেও তাদের সম্মানী দিয়েছি। অন্তত পার্টটাইম টিচারদের টাকা দেয়া দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। ভিন্ন ফান্ড থেকে এ টাকা ম্যানেজ করেছি। কিন্তু এভাবে কতোদিন চালাতে পারি জানি না। অনেক প্রতিষ্ঠান মার্চ পর্যন্তও চালাতে পারেনি। মূলত এসব শিক্ষকরা মানবেতর জীবন যাপন করছে।
চাঁদপুর রেসিডেন্সিয়াল কলেজ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ ওমর ফারুক জানান, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত বেতনই হলো বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান আয়। এ সময়ে প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত খরচের পাশাপাশি শিক্ষকদের বেতন চালিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। প্রথম মাস শিক্ষক বেতনসহ বিবিধ খরচ কোনো মতে মেটানো সম্ভভ হলেও পরে আর সম্ভব হয়ে উঠেনি। তাই যেমনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থায়ী খরচ জোগাতে বিপাকে পড়েছে তেমনি এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরাও সাময়িক অসুবিধার মধ্যে আছে বলতে দ্বিধা নেই। এ দূর্যোগে সরকারি কোনো সহায়তাও পায়নি প্রতিষ্ঠানগুলো।
চাঁদপুর জেলা শিক্ষা অফিসার মোঃ গিয়াসউদ্দিন পাটওয়ারী জানান, নন-এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও নন-এমপিও শিক্ষকদের একটা তালিকা করে জেলা প্রশাসনের কাছে দেয়া হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে খন্ডকালীন শিক্ষকদের বিষয়ে কোনো প্রকার নির্দেশনা না পাওয়ায় কোনো কাজ করা হয়নি।
চাঁদপুরে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা আইসিটি) দাউদ হোসেন চৌধুরী জানান, জেলা শিক্ষা অফিসের মাধ্যমে প্রায় নন-এমপিও ১২শ শিক্ষকের তালিকা করে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দপ্তরে।