বিশেষ প্রতিনিধি:
পৃথিবী বদলে গেছে/যা দেখি নতুন লাগে/তুমি আমি একই আছি/যেমনি ছিলাম আগে। কিশোর কুমারের গানের মতোই বদলে গেছে চাঁদপুর। জীবনাচরণ বা মানুষজনও কি আগের মতোই আছে? যদিও এ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এই তো কয়েক মাস আগেও চাঁদপুরের যে স্বাভাবিক চিত্র ছিলো। তা পুরোই পাল্টে গেছে। পুরো জেলা জুড়ে ইতিবাচক দিক ছিল মানুষের কোলাহল, কর্মব্যস্ততা, অবাধ চলাচল, রাজনৈতিক জনসভা, মিটিং মিছিল, কালচারাল কর্মকা- কিংবা আড্ডাবাজি। এছাড়া নীতিবাচক দিকগুলোর মধ্যে এলাকায় কিশোর গ্যাং দৌরাত্ম্য, মাদকের বিস্তার, চুরি ছিনতাই, খুন, মারামারি, পারিবারিক কলহ, জমি-জমা বিরোধ, সড়ক দুর্ঘটনা। নিত্যদিনের উল্লেখিত ঘটনাসমূহ অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সতেন মহলের মতামতে জানা যায়, গত সাড়ে তিনমাসে করোনা ভাইরাস মহামারী রূপ নিয়ে এলেও আমাদের কিছু কিছু বিষয় শিখিয়েছে। মানুষ এখন নিয়ম মাফিক চলার চেষ্টা করে। নিয়ম মেনে কাজ করে। অশান্ত পরিবেশ আজ কেমন যেন নিরবতা খেলে যায়। কর্ম ব্যস্ততা কমে মানুষ পাচ্ছে অবসাদ। বাড়ছে মানুষের প্রতি মানুষের সহানুভূতি ভালোবাসা যা হারিয়ে যাচ্ছিল দিনদিন।
চাঁদপুরের পুরো জেলায় যেসব পরিবর্তন এসেছে তা একটু বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সামাজিক পট পরিবর্তন হয়েছে। সন্ধ্যা নামলেই চায়ের দোকানে আড্ডা আসর বসতো। যা এখন অনেকটাই কমে এসেছে। মোড়ে মোড়ে উঠতি বয়সী কিশোর আড্ডা এখন তাও নেই বললেই চলে। মার্কেট শপিং-মলে লেগে থাকতো উপচে পড়া ভিড়। এখন মানুষ চলছে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে নিয়মের গন্ডিতে। কাজ সেরে এখন সবাই দ্রুত বাসায় ফেরার চেষ্টা করেন। সামাজিক বা পারিবারিক অনুষ্ঠান পারত পক্ষে করা হচ্ছে না। যদি করা হয় তবে তা সীমিত পরিসরে।
রাতের শহরও যেন নিভৃত কোনো পল্লী। সন্ধ্যা রাতেই নেমে আসে গভীর রাত। সবাই পরিবারকে সময় দিচ্ছে। এতে বৃদ্ধি পাচ্ছে পরিবারিক বন্ধন, ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ। মানুষের মাঝে বৃদ্ধি পাচ্ছে স্বেচ্ছাসেবী মনোভাব। যে যার অবস্থান থেকে বাড়িয়ে দিচ্ছে সহযোগিতার হাত। কমে এসেছে প্রতিবেশীদের প্রতি হিংসা বিদ্বেষ ঝগড়া বিবাদ। কমে এসেছে কথায় কথায় মামলা করার প্রবণতা। কোর্ট বা থানার বারান্দায় ক্রোধের ঘুরোঘুরি।
যদিও আইনজীবীরা বলছে ভিন্ন কথা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন আইনজীবী জানান, করোনাকালে অনেক প্রভাবশালী সুযোগ পেয়েছে সাধারণ মানুষের উপর অত্যাচারের খড়গ বসাতে। এমনো জানি কোর্টে নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও কোথাও কোাথাও বাড়ি নির্মাণসহ দখল অব্যাহত আছে। ইচ্ছে করলেই এখন মামলা। বা আইনশৃংখলাবাহিনীর মাধ্য প্রতিকার পাওয়া যায় না। থানায়ও জরুরি না হলে মামলা নেয়া হচ্ছে না। কোর্টেতো শুধুমাত্র জামিন শুনানি ছাড়া নতুন কোনো মামলা নথিভুক্ত হচ্ছে না।
অপরদিক অন্যান্য সময়ের তুলনায় সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে এসেছে। অবশ্য এর অন্যতম কারণ সড়কে যানবাহন চলাচল কম থাকা। বাহিরে মানুষের অপ্রয়োজনে বের হওয়ার হারও কমেছে। পারিবারিক দায়িত্ববোধ বৃদ্ধি পাওয়ায় পানিতে পড়ে শিশু মৃত্যুহার অনেকাংশে কমে এসেছে। ইউনিয়ন পরিষদের গ্রাম আদালতে কমেছে মামলা সংখ্যা। হয়তো অবাধ চলাফেরায় বিধিনিষেধ থাকায় কলহ কমেছে। অথবা মানুষ সব রাগ ক্ষোভ ফুসে রাখছে। পৃথিবী স্বাভাবিক হলে তা উথলে উঠতে পারে। এমনটাই আশঙ্কা করছেন কোনো কোনো জনপ্রতিনিধি।
কচুয়া উপজেলার ৯নং কড়ইয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোঃ আহসান হাবিব জুয়েল বলেন, আগে প্রতি মাসে আমার ইউনিয়নে ১০-১৫ অভিযোগ হতো। বর্তমানে তা কমে ৪-৫টিতে নেমে এসেছে। অর্থাৎ মানুষের মধ্যে একটা পরিবর্তন এসেছে।
চাঁদপুর সদর উপজেলার ১২নং চান্দ্রা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান খান জাহান আলী কালু বলেন, মানুষের মাঝে একটা পরিবর্তন এসেছে। তাই পূর্বের থেকে গ্রাম আদালতে মামলার পরিমান কমেছে। যদিও কিছু কিছু ঘটনা আমি এসময়ে কোর্ট পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ দেই নি। আমি বিষয়গুলো মিমাংসা করে দিয়েছি।
সুশাসনের জন্যে নাগরিক (সুজন) এর চাঁদপুর জেলা শাখার সভাপতি গোলাম কিবরিয়া জীবন বলেন, সবাই আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে স্বার্থপর হয়ে গেছে মানুষ। মূলত পরিস্থিতি বাধ্য করেছে। মানুষের মাঝে সম্পর্ক ঠিকই আছে। পরিস্থিতি বাধ্য করেছে কাছাকাছি না এসে মুঠোফোনে যোগাযোগ রক্ষা করতে। অথবা পারিবারিক অনুষ্ঠান আয়োজন না করা।
করোনাকালীন সময়ে আইনশৃংখলা পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়নি বলে মনে করেন সুশীল সমাজের এ নেতা। তিনি বলেন আইনশৃংখলা আগের মতোই আছে। একটা বৈশ্বিক মহামারির কারণে আমার আপনার কোনো সমস্যা হলেও তা নিয়ে আইনগত বা প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থায় অগ্রসর হচ্ছি না। অথবা ঝামেলায় জড়াতে চাচ্ছি না। তার মানে এই নয় যে অপরাধমূলক কর্মকা- কমে গেছে।
চাঁদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার(পুুলিশ সুপার) মোঃ মিজানুর রহমান, করোনার কারণে আমাদের সামাজিক অবস্থান বা বন্ধন একটু নড়েচড়ে বসেছে। এতে কোনো প্রকার সন্দেহ নাই। কারণ মানুষ জানে দেশ তথা পুরো পৃথিবী একটা অস্থিতিশীল অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একটা দূর্যোগে দেশ আপতিত। উদাহরণ দিলে একজন চোরও চুরি করতে যাচ্ছে না, কারণ সে ভাবছে যদি ওই ঘরে করোনা রোগী থাকে তবে সেও করোনা আক্রান্ত হতে পারে। এছাড়ার সবার মাঝে একটা ভীতসন্ত্রস্তবোধ আছে। যদিও অনেকেই নিয়ম মানছেন না। নিয়মের বেড়াজাল টপকে যাচ্ছাতাই চলফেরা করছে। আবার এটাও ঠিক যে নিয়মের মধ্যেও অনেকেই থাকার চেষ্টা করছে। তবে আশার কথা হচ্ছে অপরাধ পরিসংখ্যান কিছুটা কমেছে।
তিনি আরো যোগ করে বলেন, আগে থানায় যে পরিমান মামলা হতো সে পরিমানে হচ্ছে না। আর থানায় মামলা নিচ্ছে না কথাটা ভুল। কারণ করোনার মধ্যে মার্ডার মামলা হয়েছে, আদার্স সেকসনেও মামলা হয়েছে। সেগুলোর বিষয়ে পুলিশ কাজ করছে। মার্ডার মামলার ক্লু বের হচ্ছে। অপরাধ একটা চলমান প্রক্রিয়া। মানুষের মধ্যে ক্ষোভ হিংসার বশবর্তি হয়ে বিভিন্ন রকমের ক্রাইম কিন্তু মানুষ করে। অপরাধ প্রবণমন কিন্তু খুব সহজে নিবৃত করতে পারে না। অপরাধ হচ্ছে না তা কিন্তু বলা যাবে না। অপরাধ হচ্ছে এবং পুলিশ সেটা নিয়ে কাজও করছে। করোনায় ভীতসন্ত্রস্ত না হয়ে যদি নিজ ও পরিবারকে সুরক্ষার মধ্য দিয়ে চলা যায় বা এভাবে জনসচেতনতা বাড়ানো যায় তবেই সবার কল্যাণ। অবশ্য সচেতনতা বেড়েছে।
মানুষ এখন বুকে জড়িয়ে ধরা, মুসাফা করা থেকে বিরতো থাকছে। ঘনিষ্ট কাউকে সামনে পেলেই জড়িয়ে ধরছে না বা সামনে হাত প্রসারিত হয় না। মাস্ক পড়ার প্রবণতা বাড়ছে। এখন প্রায় সবাই মাস্ক ব্যবহার করছে। একেবারে হকার থেকে শুরু করে রিক্সা চালককেও মাস্ক ব্যবহার করতে দেখা যায। অর্থাৎ আমাদের মাঝে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার মানসিকতাও তৈরি হয়েছে। এটা অবশ্যই ইতিবাচক দিক। মানুষ বুঝে গেছে করোনায় ঘরে বসে থাকলে চলবে না। তবে অবশ্যই নিজের সুরক্ষা নিশ্চিত করেই কাজে বের হতে হবে।
চাঁদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আবদুল্লাহ আল মাহমুদ জামান জানান, করোনায় তরুণ প্রজন্ম যে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছে এটা আমাকে আশাবাদি করেছে। স্বাস্থ্যবিধি বিষয়ে চাঁদপুরের মানুষ অনেকটাই উদাসীন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে লকডাউন কার্যক্রম বাস্তবায়নের খুব ভালো সাড়া পাচ্ছি। যেহেতু ধারণা করা হচ্ছে করোনা সহসা যাচ্ছে না। এটাকে সঙ্গী করেই আরো অনেকদিন আমাদের পথ চলতে হতে পারে। এ কারণে স্বাস্থ্য বিধি মানানোর জন্যে সর্বোচ্চ জোর দিবো। আমরা প্রচুর পরিমানে মাস্ক সরবরাহ করার চেষ্টা করছি। ইতোমধ্যে আমাদের হাতে পাঁচ হাজার মাস্ক চলে এসেছে। মাস্ক ব্যবহার শতভাগ বাস্তবায়ন করতে চাই। বিশেষজ্ঞরা বললেছ শতভাগ মানুষ যদি মাস্ক পড়ে অন্তত আক্রান্তের সম্ভবনা ৭০ভাগ কমে যায়। সর্বশেষ র্ভাচুয়াল মিটিং এ মাস্ক ব্যবহারে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। গতকাল রোববার মাস্ক ব্যবহারে পুরোপুরি প্রচারপ্রচারণায় নেমেছে প্রশাসন। সবশেষ যদি মানুষ মাস্ক ব্যবহারে অনিহা দেখায় তবে ওই ব্যক্তির ছবি তুলে ফেসবুকে দিয়ে দেবো। যেন সামাজিক ভাবেও সে হেও হয়। সোমবারের ভেতরেই শতভাগ মাস্ক ব্যবহারে কাজ করবে প্রশাসন ও শহরের ৮০জন স্বেচ্ছাসেবী। চারটার পর ওষুধের দোকান ব্যাতিত সব দোকান পাঠ বন্ধ থাকবে। এ দুটি বিষয় নিয়েই আমরা সামনে অগ্রসর হচ্ছি।