মোহাম্মদ সোহেল/ বিশাল দাস:
মসজিদ পরিচালনা কমিটি মাসে তিন হাজার টাকা বেতন দেয়। তাও প্রতিমাসে পাওয়া যায় না। যদিও কোনো কোনো মসজিদ পরিচালনা কমিটি দেয়। অবশ্য আমি মাসে মাসেই পাই। ফাঁকেফুকে দুই একটা টিউশনি করি। এসবদিয়ে কোনো মতে চলে। কিন্তু পুরো এগারো মাস অপেক্ষায় থাকি একটি মাসের জন্যে। তা হলো রমজান মাস। রমজান মাসে ভালোই উপড়ি ইনকাম হয়। যা দিয়ে ঈদসহ বিশেষ বিশেষ প্রয়োজনীয় কাজ সারতে পারি। কিন্তু এবছর কোনো দিশে পাচ্ছি না। সরকারি নির্দেশ মোতাবেক মানুষ মসজিদেও আসছে না। মসজিদ পরিচালনা কমিটিও একপ্রকার হতাশ। কিভাবে কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। কথাগুলো গ্রামের একটি মসজিদের ইমাম-এর। নাম প্রকাশ না করা শর্তে তিনি এসব কথাগুলো বলেন। তিনি আরো যোগ করে বলেন, ইমাম, মুয়াজ্জিন, খাদেম বা খতিবরা না খেয়ে থাকলেও কারো কাছে প্রকাশ্যে হাত পাতবে না। আমাদের কষ্টগুলো আমরা নিজের ভেতর লালন করি। আল্লাহ হয়তো একদিন আমাদের দিকে মুখ তুলে তাকাবেন। সে জন্যেই আল্লার ইবাদত করে যাই। এমন কথা শুধু একজন ইমামের নয়, এমন কথা হাজার হাজার ইমামের। যারা মুখ ফুটে কাউকে কিছু বলতে পারে না। যারা ইচ্ছে করলেই কারো কাছে কিছু চাইতে পারে না। চাঁদপুরে পাঁচ হাজারেরও বেশি ইমাম মুয়াজ্জিন রয়েছে। তাদের গোপন আর্তনাদ যেন আকাশ ভারি হয়ে উঠছে। কিন্তু কেউ তা টের পাচ্ছে না।
২৫এপ্রিল থেকে শুরু হয়েছে পবিত্র মাহে রমজান। কিন্তু প্রতি বছর রমজান মাসে যেই দৃশ্য পরিলক্ষিত হয় এই বছর তা অন্যরকম। মসজিদে মানুষ নেই। ইফতারের জন্য দোকানে দোকানে ভিড় নেই। কতশত বছর পর এমন রমজান দেখলো মানুষ? হিসেব মেলানো কঠিন। মসজিদের ইমাম মুয়াজ্জিনরা সামান্য বেতন পেয়ে তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে সংসার জীবন অতিবাহিত করে। কিন্তু রমজান মাস আসলে তাদের উপরি আয়ের একটি সুযোগ থাকে। কারণ রমজান মাসে তারা মসজিদে তারাবি, খতম তারাবি পড়িয়ে ভালো টাকা হাদিয়া পায়। এছাড়া এসময় ঘরে ঘরে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করে। সেখান থেকেও মিলে কিছু সম্মানী। যা দিয়ে পরবর্তী ২/১ মাসের জন্য তাদের একটি সঞ্চয় হয়ে যেতো। কিন্তু এই রমজানে করোনা তাদের হতাশ করেছে। সরকারি নির্দেশনা মানতে গিয়ে এ শ্রেণীর মানুষগুলো পড়েছে এক মহাবিপাকে।
ইসলামি ফাউন্ডেশন চাঁদপুর এর তথ্য মতে, চাঁদপুরে ৪হাজার ৮শ ৪২টি মসজিদ রয়েছে। যা গত ২০১৭ সালের হিসেব। বর্তমানে আরো অন্তত পাঁচশ মসজিদ বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব মসজিদে একজন করে ইমাম, মুয়াজ্জিন, খতিব এবং খাদেম থাকলে সংখ্যাটা অনেক বড় হয়ে যায়। হয়তো সকল মসজিদে খতিব বা খাদেম নেই। তবে প্রায় মসজিদেই ইমাম ও মুয়াজ্জিন রয়েছে। এদের মধ্যে চাঁদপুর জেলায় প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ইমাম ও মুয়াজ্জিন আছে ৬৮২জন। এছাড়া মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রকল্প ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি সফল প্রকল্প। ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতা গ্রহণ করে মউশিক প্রকল্পের প্রতি সুদৃষ্টি দিয়ে ২০০০ থেকে ৪৫০০ টাকা সম্মানীর ব্যবস্থা করেন। চাঁদপুরের ১ হাজার ২শ’ ৩৬ জন শিক্ষক এ সম্মানী ভাতা পাচ্ছে না গত জানুয়ারী মাস থেকে।
বিষয়গুলো নিয়ে মহা চিন্তায় পড়েছে মসজিদ পরিচালনা কমিটি। তারা দ্রুত ইমাম মুয়াজ্জিনদের বিষয়ে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে সহযোগিতার হাত বাড়ানোর দাবি জানান।
ইসলামি চিন্তাবিদ ও গবেষক এস এম আনওয়ারুল করিম বিষয়টি নিয়ে বলেন, মানুষ সব জাগতিক বিষয় নিয়ে আছে। সমাজের ইমাম মুয়াজ্জিনদের বিষয়টি দেখা উচিৎ। তারাও তো মানুষ। ত্রাণতো সবাই পেতে পারে। যাদের সমস্যা তারাই এ সহযোগিতা গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু দেখা যায় এই মানুষদের কাছে কেউ যায় না। এ মানুষগুলোর পাশেও দাঁড়ানো দরকার। ইমাম মুয়াজ্জিনরা মাসিক যে বেতন বা সম্মানী পায় সে বিষয়টি নিয়ে মসজিদ কমিটি যেন যথাযত সিদ্ধান্ত নেয়।
চাঁদপুর প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এ এইচ এম আহসান উল্ল্যাহ সম্প্রতি একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেন, পবিত্র রমজানে যাঁরা খতম তারাবীহ পড়াতেন সেসব সম্মানিত হাফেজ সাহেবগণ এবার খুবই দুঃখ দুর্দশায় আছেন। কারণ অনেক মসজিদে খতম তারাবীহ হচ্ছে না। সকলের কাছে বিনীত অনুরোধ-পবিত্র কোরআন মাজীদের সম্মানে হলেও হাফেজ সাহেবদের জীবন জীবিকার বিষয়টি যেনো আমরা বিবেচনায় আনি। সরকার, প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ, বিত্তশালী এবং সমাজসেবীরা যেনো তাঁদের দৃষ্টি রাখি। পরম করুণাময় সকলকে ভালো রাখুক, এটাই তাঁর কাছে আর্জি।
ইসলামি ফাউন্ডেশন চাঁদপুর এর উপ-পরিচালক মোঃ খলিলুর রহমান জানান, মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা প্রকল্পটির ষষ্ঠ পর্যায় গত ডিসেম্বর ২০১৯ মাসে শেষ হয়েছে। উক্ত প্রকল্পের সপ্তম পর্যায় শীঘ্রই অনুমোদন হওয়ার পথে। আশা করছি দেশের আলেম-ওলামাদের কর্মসংস্থানের উক্ত প্রকল্পটি খুব দ্রুত অনুমোদিত হবে । যদিও করোনার কারণে এ প্রকল্প অনুমোদনের সুযোগ পাচ্ছে না।