স্টাফ রিপোর্টার:
চাঁদপুর সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি, দেশের শীর্ষস্থানীয় চলচ্চিত্র প্রযোজক-পরিচালক ও পরপর দুইবার জেলার শ্রেষ্ঠ করদাতা মো. সেলিম খানের বিরুদ্ধে অতি সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলা দায়ের করেছে। জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও সম্পদ গোপনের অভিযোগে মামলাটি দায়ের করা হয়েছে। এই মামলা দায়েরের পর থেকে তার নিজ জেলা চাঁদপুরে এ নিয়ে ধুম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। জেলা আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের বিরোধ প্রকাশ্য হওয়ার পর থেকেই জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ সেলিম খানের বিরুদ্ধে একের পর এক ব্যবস্থা গ্রহণ ও প্রকাশ্য বিরোধিতায় নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
সেলিম খানের ঘনিষ্ঠজনরা জানান, চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগ কয়েক মাস আগে সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ ছাড়াই কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের অনুমতি বা নির্দেশনা না নিয়ে আজীবনের জন্য তাকে বহিষ্কার ঘোষণা করে একটি সভায় বক্তব্যের মাধ্যমে। যদিও এ বিষয়ে এখনো লিখিত কোনো চিঠি ও প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেয়নি জেলা আওয়ামী লীগ। এ ধরণের বহিষ্কারাদেশ আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র পরিপন্থী। জেলা কমিটি বহিষ্কারের সুপারিশ করতে পারে। অনুমোদন দেওয়ার এখতিয়ার শুধু কেন্দ্রের। অপরদিকে মহিলা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেত্রী ও চাঁদপুর জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাবেক আহŸায়িকা অধ্যক্ষ অধ্যাপিকা শাহীন সুতলানা ফেন্সীর হত্যার এজাহারভুক্ত আসামী তার স্বামী জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. জহিরুল ইসলামকে সাথে নিয়ে প্রকাশ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করছে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। হত্যার ঘটনায় জহিরুল ইসলামের নিজের কন্যারা জহিরুল ইসলামকে হত্যাকারী হিসেবে দাবি করে বিবৃতি দেবার পর এবং তিনি চার্জশীটভুক্ত প্রধান আসামী হওয়া সত্তে¡ও তাকে বহিষ্কার বা অব্যাহতির সুপারিশ না করে বরং তাকে পাশে নিয়ে সর্বক্ষণ চলেন জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ দুই নেতা। এ কারণে এলাকাবাসীর প্রশ্ন- সেলিম খান কি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বা গ্রুপিংয়ের শিকার।
মূলত জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ ও প্রশাসনের সাবেক একজন কর্তাব্যক্তির যৌথ বিরুদ্ধাচারণে ব্যবসায়িক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও আইনী একের পর এক বৈরীতার মুখোমুখি হন সেলিম খান। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের প্রেক্ষিতে বিআইডবিøউটিএ ও জেলা প্রশাসনের লিখিত অনুমতি নিয়ে তিনি চাঁদপুরের কিছু নির্ধারিত মৌজায় বালু উত্তোলন করলেও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তাকে ‘বালুখেকো’ তকমা দিয়ে সারাদেশে বিতর্কিত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। উচ্চ আদালতে তার অনুক‚লে প্রদত্ত রায়ের বিরুদ্ধে সাবেক জেলা প্রশাসক কর্তৃক নির্ধারিত সময়ের কয়েক বছর পর আপিলের কারণে বালু উত্তোলন স্থগিত করা হয় ও পরবর্তীতে সেই আদেশের আলোকে আর বালু উত্তোলন না করায় রায় দেওয়া হয়। আদালতের স্থগিতাদেশ হওয়ার সাথে সাথেই বালু উত্তোলন বন্ধ রাখেন সেলিম খান।
এদিকে দুদক কর্তৃক সেলিম খানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের প্রসঙ্গে তার আইনজীবী বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তার প্রদর্শিত অস্থাবর সম্পদের হিসাবের সাথে সেলিম খানের নিজ নামের অস্থাবর সম্পত্তি অথবা তার সন্তানদের সাথে যৌথভাবে প্রদর্শিত অর্থের কোনটার সাথেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তদন্তকারী কর্মকর্তার বর্ণিত জমির পরিমান ও ফ্ল্যাটের মূল্যর সাথে প্রকৃত জমি ও ফ্ল্যাটের মূল্য সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
দুদকের সাম্প্রতিক মামলায় তদন্তকারী কর্মকর্তা সেলিম খানের গ্রহণযোগ্য আয় হিসেবে ৪,১৪,২৪,৫৭৬ টাকা রেকর্ডপত্র ও সম্পদ বিবরণী যাচাইকালে পেয়েছেন মর্মে উল্লেখ করেছেন। অথচ রেকর্ডপত্র অনুযায়ী ২০০৬-২০০৭ করবর্ষ হতে ২০২০-২০২১ করবর্ষ পর্যন্ত আয়কর রিটার্ন অনুযায়ী তার প্রদত্ত আয়করের বিপরীতে ১২,৯০,৩১,৩৮৭ টাকা অর্জিত আছে। তদন্তকারী কর্মকর্তা তার অগ্রহণযোগ্য আয়ের সমর্থনে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য প্রমাণের বিষয়ে এজাহারে উল্লেখ করেন নাই।
অন্যদিকে তদন্তকারী কর্মকর্তা সেলিম খানের সম্পদ বিবরণী দাখিলের পূর্বে পর্যন্ত রেকর্ড পত্র অনুযায়ী তার নামে স্থাবর সম্পদ (২৬,৪২,৩২,০২১-২৫,৭৫,৩২,৫৪৪)= ৬৬,৯৯,৪৭৭ টাকা দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতে সে গোপনপূর্বক মিথ্যা তথ্য প্রদান করেছে মর্মে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ এর ২৬ (২) ধারায় অপরাধের অভিযোগ আনেন। অথচ সেলিম খান ও তার সন্তানদের সকলেরসহ যৌথভাবে তিনি দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতে স্থাবর সম্পদের হিসাব বাবদ নিজ নামে ১৯,৯০,৩১,৪৪৪ টাকা, সন্তানদের নামে ৬,৪২,১৫,০০০ টাকাসহ মোাট ২৬,৩২,৪৬,৪৪৪ টাকা প্রদর্শন করেছেন।
দুদক তদন্তকারী কর্মকর্তা সেলিম খানের সন্তানদের প্রত্যেকের নিজ নিজ নামের টিআইএন নাম্বার ও আয়কর নথি থাকার পরেও এবং দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতে তাদের টিআইএন নাম্বার উল্লেখ থাকার পরেও তাদের নামে অর্জিত সম্পদের হিসাব তার দাখিলকৃত সম্পদের সাথে একত্রিভূত করেছেন। যা বিধিসম্মত নয়।
এ ব্যাপারে আইনজীবীর মাধ্যমে প্রদত্ত বক্তব্যে সেলিম খান বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তা আমার বিরুদ্ধে ৩৪,৫৩,৮১,১১৯ টাকা জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মনগড়া এক অভিযোগ আনিয়াছেন। কেননা আমার অর্জিত সকল আয়ের বিপরীতে নিয়মিত আয়কর প্রদান করা হয়েছে এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বিধি মোতাবেক ১৯ বিবিবিবিবি ধারা অনুযায়ী আয়কর প্রদান করা আছে। আমার সম্পদ বিবরণীর প্রদর্শিত আয় ও অর্জিত সম্পদের বাইরে অবৈধ কোন সম্পদ নাই। আমি ২০১৯-২০২০ ও ২০২০-২০২১ সনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক চাঁদপুর জেলার সর্বোচ্চ আয়কর প্রদানকারী হিসেবে সম্মাননা লাভ করি। আমার সন্তান মোঃ শান্ত খান চাঁদপুর জেলার তরুন সর্বোচ্চ করদাতা হিসেবে সম্মাননা লাভ করে। আমার দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতে আমার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের টিআইএন নাম্বার উল্লেখ করা আছে। তারা কেউ আমার উপরে নির্ভরশীল নয়। তারা প্রত্যেকে সাবালক। নিয়মিত আয়কর প্রদানকারী। তাদের নিজ নিজ নামে পৃথক আয়কর নথি থাকা সত্তে¡ও সম্পদ বিবরণীতে তাদের নামে উল্লেখিত সম্পদ আমার নামে প্রদর্শন করে কথিত হিসাব অনুযায়ী যে অভিযোগ আনয়ন করা হয়েছে তা বিধিসম্মত নয়।
সেলিম খান যেখানে হাইকোর্টের আদেশের ভিত্তিতে এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের লিখিত অনুমোদন নিয়ে সম্পূর্ণ বৈধভাবে বালু উত্তোলন করছিলেন সেখানে গণমাধ্যমে তাকে ‘বালুখেকো সেলিম’ বলে অপপ্রচার চালানো, কোনো কারণ প্রদর্শন না করে জেলা আওয়ামী লীগ কর্তৃক তাকে এখতিয়ারবহির্ভূতভাবে আজীবন বহিষ্কারের অবৈধ কথিত সিদ্ধান্ত প্রচার করা এবং সকল রেকর্ডপত্রে তার আয় ও সম্পদের সঠিক সব হিসাব প্রদর্শিত থাকা সত্তে¡ও তার বিরুদ্ধে মনগড়া অভিযোগ তুলে দুদকের সাম্প্রতিক মামলা দায়ের মূলত কি উদ্দেশ্যে করা হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সেলিম খানসহ চাঁদপুরের বহু মানুষ।
সেলিম খান চাঁদপুর-৩ নির্বাচনী এলাকার সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন এবং আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক হিসেবে পরিচিত লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়নের নির্বাচিত একাধিকবারের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি। উল্লেখ্য, ওই ইউনিয়নেই জেলা বিএনপির সভাপতি ও চাঁদপুর-৩ আসনের বিএনপির প্রার্থী শেখ ফরিদ আহমেদ মানিকের বাড়ি। চাঁদপুরের সচেতন মহল প্রশ্ন তুলছেন, সেলিম খানকে ঘায়েল করে জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা অন্য কোনো বড় ব্যক্তি স্বার্থ হাসিল করতে চাচ্ছেন কিনা?