নজরুল ইসলাম আতিক:
২ মাসের নিষেধাজ্ঞা শেষে ৩০ এপ্রিল মধ্যরাত থেকে চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনায় মাছ শিকারে নেমেছে জেলেরা। এ নিয়ে জেলেপাড়ায় চলছে উৎসবের আমেজ। তবে দীর্ঘদিন পর নদীতে নেমে মাছ পাওয়া না পাওয়া নিয়ে তাদের মধ্যে রয়েছে সংশয়। আর মৎস্য বিভাগ বলছে, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবছর জাটকা রক্ষা অভিযান সফল হয়েছে। এতে আগামীতে ইলিশের কাক্সিক্ষত উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে বলে দাবি তাদের।
ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি ও জাটকার নিরাপদ বিচরণ নিশ্চিতে ২০০৬ সাল থেকে প্রতিবছর মার্চ-এপ্রিল এই দুই মাস দেশের পাঁচটি অভয়াশ্রমে জাটকা রক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে সরকার। কর্মসূচি আওতায় গত দুই মাস চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার ষাটনল থেকে হাইমচর উপজেলার চরবৈরভী পর্যন্ত ৭০ কিলোমিটার এলাকায় সকল প্রকার মাছ ধরায় ছিলো নিষেধাজ্ঞা। এতে দুই মাস অলস সময় কাটিয়েছেন চাঁদপুরের প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক জেলে। তবে নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ায় খুশি জেলেরা ইতিমধ্যে তাদের নৌকা ও জাল মেরামতের কাজ শেষ করেছেন অনেকে। এখন শুধু অপেক্ষার পালা।
এদিকে নিষেধাজ্ঞায় যাতে জেলেরা নদীতে না নামে সেজন্য অভিযানকালে নিবন্ধিত জেলেদেরকে খাদ্য সহায়তা হিসেবে ৪০ কেজি করে ৪ কিস্তিতে মোট ১৬০ কেজি চাল খাদ্য সহায়তা দেয়া হয়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র চাল দিয়ে সংসার চলে না দাবি করে চালের সাথে অন্যান্য সহযোগিতার দাবি জানিয়েছেন জেলেরা।
এদিকে মৎস্য বিভাগের দাবি, এবছর জাটকা রক্ষা কার্যক্রম সফল হয়েছে। এতে বাড়বে ইলিশের উৎপাদন। অভয়াশ্রম বাস্তবায়নে জেলা টাস্কফোর্সের সমন্বয়ে অভিযান পরিচালনা করে জেলা প্রশাসন, নৌ পুলিশ, কোস্টগার্ড ও নৌ বাহিনী।
চাঁদপুর জেলা মৎস্য বিভাগের দেওয়া তথ্য মতে, জাটকা রক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নে এবছর ৭৩৭টি অভিযান ও ১৫৫টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালতে বিভিন্ন সময় আটককৃত ৩৬৮ জন জেলেকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা প্রদান করা হয়। এছাড়াও আরো নিয়মিত অভিযানে আটককৃত ৩১০ জেলের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা দায়ের করা হয়। দুই মাসের অভিযানে ৮০ লক্ষ মিটার কারেন্ট জাল ও ৩৮ মেট্রিক টন জাটকা জব্দ করা হয়েছে।
সদর উপজেলার তরপুরচন্ডী ইউনিয়নের আনন্দবাজার এলাকার জেলে সুমন, জুয়েল, মাসুদ গাজীসহ বেশ কয়েকজন দাবি করেন, অভয়াশ্রমে নিবন্ধিত জেলেদের শুধুমাত্র চাল দেয় সরকার। এতে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। শুধুমাত্র চাল দিয়ে সংসার চলে না তাদের। সঙ্গে আনুষাঙ্গিক যে খাদ্যদ্রব্য প্রয়োজন তা কিনতে তাদের অর্থের প্রয়োজন হয়। কিন্তু নদীতে না নামলে সে অর্থের যোগান দেওয়া তাদের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। এতে বাধ্য হয়েই অনেক সময় জেলেরা নদীতে নামেন বলে দাবি করেন তারা।
সদর উপজেলা লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের বহরিয়া নদী তীরবর্তী এলাকার জেলে আনোয়ার রাঢ়ি, হানিফ গাজী ও ফারুক খান জানান, নিষেধাজ্ঞার আগে আমাদেরকে বলা হয়েছিল দুই মাস বিভিন্ন এনজিও সংস্থা থেকে নেয়া ঋণের কিস্তি বন্ধ রাখা হবে। কিন্তু এনজিও কর্মীরা এই দুই মাস আমাদের কাছ থেকে কিস্তি আদায় করেছে। একে তো নদীতে মাছ ধরা বন্ধ, তার উপর ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা আমাদের উপর বোঝা হয়ে যায়। তাই সরকারের কাছে আমাদের আবেদন জেলেদেরকে চাল দেয়ার পাশাপাশি সামান্য আর্থিক সহযোগিতা ও নিষেধাজ্ঞার সময়গুলোতে অন্তত ঋণের কিস্তি বন্ধ রাখার ব্যবস্থা করা হোক। এতে অভয়াশ্রমে জেলেদের নদীতে নামার প্রবণতা অনেক কমবে বলেও মনে করেন তারা।
তবুও অপেক্ষার পালা শেষে নদীতে নামতে পেরে খুশি এসব জেনেরা। ইতিমধ্যে অনেকেই বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি এনজিও সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে জাল ও নৌকা মেরামতের কাজ শেষ করেছেন। স্বপ্ন বুনছেন নদীতে মাছ শিকার করে এসব ঋণ পরিশোধ করার এবং পরিবার পরিজন নিয়ে একটু ভালো থাকার।
বহরিয়া এলাকার সাকুয়া গ্রামের জেলে হাসান বেপারী জানান, জাল ও নৌকা কিনতে প্রায় ৭ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এখন আবার পুনরায় মেরামত করতে ৬০ হাজার টাকা খরচ হলো। এখন আল্লাহই ভাল জানে নদীতে গিয়ে মাছ পাবো কিনা। নদীতে মাছ ফেলে ভালো নয় তো আমাদের কষ্টে কষ্টেই দিন কাটবে। একই গ্রামের জয়নাল খান জানান, নৌকা জাল সব মেরামত করা হয়েছে। এছাড়াও আমার নৌকায় প্রায় ১০ থেকে ১২ জন জেলে কাজ করেন। তাদের সবাইকে দাদন দিতে হয়েছে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা করে। সবমিলিয়ে ধারদেনা করে আমার প্রায় ১৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এখন নদীতে গিয়ে মাছ শিকার করে এসব দেনা পরিশোধ করতে পারব কিনা জানি না।
জাটকা রক্ষা কার্যক্রমের বিষয়ে চাঁদপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা গোলাম মেহেদী হাসান বলেন, জাটকা রক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নে এ বছর আমরা অনেক বেশি অভিযান পরিচালনা করেছি। এতে অন্যান্য বছরের চেয়ে এ বছর বেশি জেলেকে আটক করা হয়েছে এবং জরিমানা আদায় করা হয়। অভিযান চলাকালীন সময়ে আমরা দেখেছি এ বছর নদীতে প্রচুর পরিমাণ জাটকা রয়েছে। তাই আমরা মনে করি যেহেতু আমরা জাটকা সংরক্ষণ করতে পেরেছি। এতে আমাদের যে ইলিশের কাঙ্ক্ষিত ৬ লক্ষ মেট্রিক টন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা তা অতিক্রম করবে বলে বিশ্বাস করি।
তিনি বলেন, চাঁদপুর জেলা প্রশাসক নিষেধাজ্ঞার আগেই জেলেদের কাছ থেকে দুই মাস যাতে ঋণের কিস্তি আদায় করা না হয় সেজন্য চিঠি দিয়েছিলেন। সেই চিঠি প্রেক্ষিতে আমরা প্রত্যাশা করেছি এনজিও সংস্থাগুলো জেলেদের কাছ থেকে কিস্তি আদায় করবে না। বিষয়টি সরাসরি জেলা প্রশাসক মহোদয় ট্রেনিং করছেন যদিও এখন পর্যন্ত কোন জেলের কাছ থেকে আমরা এই ধরনের কোন অভিযোগ পাইনি।
তবে যদি কোন জেলের কাছ থেকে কিস্তি আদায় করে থাকে এবং এ বিষয়ে আমরা যদি কোন লিখিত অভিযোগ পাই তাহলে বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখবো।