দুটো বিশেষ কারণে মৌলভীবাড়িতে মোহর আলীর আলাদা একটি পরিচিতি আছে। যদিও বিষয় দুটো বেশ বিরক্তিকর। প্রথমত আজকাল তিনি কোনো ধর্মকথা শোনামাত্র হাউমাউ করে চিৎকার জুড়ে দেন। ‘আহা-হা হারে’ বলে এমনভাবে কান্নাকাটি করেন যে অপরিচিত কেউ কাছে থাকলে অথবা বাড়িতে নতুন কোনো মেহমান আসলে তারা হকচকিয়ে যান-না জানি কী ঘটেছে! দ্বিতীয় ব্যাপারটা আরো বিদঘুটে। হঠাৎ করেই রাতগভীরে ‘আল্লারে ও মাগো’ করে ভীষণ জোরে চিৎকার করে ওঠেন মোহর আলী। বাড়ির লোকজন তার এই চিৎকার শুনে শুনে অভ্যস্ত হলেও বাহিরের কোনো মেহমান থাকলে তারা ভয় পেয়ে যান। মোহর আলীকে রাতে ভূতে ধরে কিনা এমন প্রশ্ন তাদের মনে জাগে। কিন্তু সত্য ঘটনাটি হলো এই, বেশ ক’বছর যাবতই মোহর আলী আচানক এক বাতরোগে ভুগছেন। কবিরাজি, ঝাড়ফুঁক, টোটকা-তাবিজ-কবজ অনেক কিছুই করেছেন কিন্তু অসুখ কমেনি। রাতেই ব্যামোটা তাকে বেশি ভোগায়।
আদতে মোহর আলী খুবই গরিব। অবশ্য এ বাড়িতে গরিব মানুষ আরো আছে কিন্তু তারপরও মোহর আলীর গরিবিয়ানাটা একটু ভিন্ন ধাঁচের। তিন ছেলে আছে, তিনজনই রুজিদার। তিন মেয়ে ছিলো তাদেরও বিয়ে হয়ে গেছে। এসব বিবেচনায় মোহর আলীর দিন ভালো যাবার কথা, কিন্তু ভালো যাচ্ছে না। বড়ছেলে রাস্তার মোড়ে তেমাথায় একটি চায়ের দোকান দিয়েছে। মেঝছেলে জুট মিলে কাজ করে। ছোট ছেলেটাকে পড়িয়েছেন মাদ্রাসায়। ভালোভাবে পাসও করেছে কিন্তু এখন কী রোজগার করে, কোথায় কোথায় থাকে কিছুই জানা নেই মোহর আলীর। সবাই আছে সবার ধান্ধায়। বাধ্য হয়েই মোহর আলী এই বয়সেও কাজ করে নিজের সংসার নিজে চালায়। সবধরনের কাজই করে মোহর আলী। জমিন কোপানো, জমিন নিড়ানো হতে শুরু করে ঘরের চাল দেয়া, বেড়া বানানো সবই করে। দিনে যখন মোহর আলী ক্ষেতে খামারে কাজ করে তখন বোঝার কোনো উপায় থাকে না যে তার শরীরে কোনো ব্যামো আছে। কিন্তু রাত শুরু হলেই বাড়ে রাজ্যের সব বিপত্তি।
শুধু কি রাতের ব্যামোই মোহর আলীকে রাতে ভোগায়? না। রাত হলেই মোহর আলীর মাথায় যতো রাজ্যের চিন্তা এসে ভর করে। চিন্তার ভেতরেই একসময় ঘুমিয়ে পড়ে মোহর আলী। কিন্তু সে ঘুমও বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না, বাতের ব্যথাসহ নানা কারণে অনেক রাত থাকতেই ঘুম ভেঙ্গে যায় তার। মোহর আলী ফজরের আজানের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে। কোনো কোনো সময় ডাহুকের কোরাস শোনার জন্যেও কান পেতে থাকে। মোহর আলীর বাড়ির আশপাশের ঝোঁপঝাড়ে অনেক ডাহুক বাসা বেঁধে থাকে। ওরা ভোরের আভাস পেতে না পেতেই কোড়াক ক-ক করে ডেকে ওঠে। কিন্তু পাড়ার পোলাপানগুলো বড় বজ্জাত। আজকাল ডাহুকগুলোকে গুলতি মেরে আহত করে ধরে নিয়ে যায়। এসব পোলাপান দেখলেই মোহর আলী দৌড়ানি দেয়। কিন্তু পোলাপানগুলো এমন বজ্জাত যে সহজে সরতে চায় না। বলে তোমার কী? মোহর আলী খেকিয়ে ওঠে। বলে, অগরে আমি পালি, তোমরা কেন্ ওগোরে মারবা? মোহর আলীর কথা শুনে বজ্জাত পোলাপানগুলো মুখ ভেঙচায়। হিঃ হিঃ করে হাসে। পোলাপানের হাসির মাঝেই মোহর আলী বলে চলে, কী আর খাবি? ইলিশের পোনা খাইলি, বাইলার পোনা খাইলি, শৈল-গজারের পোনা খাইয়া ওগো বংশ নির্বংশ করলি। অহন আইচস্ ডাহুক মাইরা খাইতি। কিন্তু তারপর কী খাইবি? তোগ জাতের মাথা খাইবি? মোহর আলীর বক্বকানির মধ্যেই একসময় বজ্জাত পোলাপানগুলো এলাকা ছাড়ে। তার সামনে থেকে চলে যায়।
অন্যান্য দিনের মতো আজও ভোরের অনেক আগেই ঘুম ভেঙ্গে যায় মোহর আলীর। ঘুম ভেঙেই কেনো আজ ডাহুক মারা বজ্জাত পোলাপানগুলোর কথা মনে পড়ে গেলো। আজ মনে হয় বাতের ব্যথাটা একটু বেশিই বেড়েছে। এরপরই মনে পড়লো ছোটমেয়ের কথা। গত কদিন ধরেই মোহর আলীর কাছে খবর আসছিলো যে, ছোটমেয়ে জ্যোৎস্নার খুব অসুখ। খবর পেলেও টাকার জন্যে মেয়েটাকে দেখতে যেতে পারে না মোহর আলী। কয়দিক সামলাবে সে। নিজেতো বাতের রোগী। ওদিকে স্ত্রীরও হাতে টিউমার হয়েছে। তারও চিকিৎসার দরকার। এসবের মধ্যেই আজ এই মেয়ের এই সমস্যা, কাল ওই মেয়ের সমস্যা। শুয়ে শুয়ে আফসোস করে মোহর আলী। তার একটা মেয়ের কপালও ভালো হলো না। এর মধ্যে গতকাল খবর আসে ছোট মেয়েকে দেখতে চাইলে যেনো যায়। তার অবস্থা ভালো না।
ভোরের আকাশ কতকটা ফর্সা হতেই মোহর আলী মসজিদের দিকে পা বাড়ায়।
দুই.
তেমাথায় রাস্তায় বড়ছেলে সিরাজ মিঞার চায়ের দোকান। এ দোকানে তিন রাস্তা দিয়ে আসা-যাওয়া করা লোকজনের অনেকেই বসে। চা খায়। কেউবা দাঁড়িয়ে থেকেই পান-সিগারেট, এটা-সেটা কিনে নিয়ে যায়। সিরাজ মিঞার ছোট দোকান। চা-পান-সিগারেট-বিস্কিট ছাড়াও হালকা কিছু সদাই-পাতিও রাখে দোকানে। চানাচুর-লজেন্স-আচার-পটেটো চিপস্ ইত্যাদি। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত একবার এবং বেলা দুটো থেকে রাত দশটা পর্যন্ত একবার মিলিয়ে মোট দুইবারের জন্যে দোকান খোলা থাকে। মধ্যখানে গোসল গা ধোওয়া ও খাওয়া-দাওয়ার জন্যে দুই ঘণ্টা দোকান বন্ধ রাখতে হয়।
সিরাজ মিঞার ছেলে নেই। দুটো মেয়ে আছে। স্ত্রী আর মেয়েদের নিয়েই তার সংসার। চলে চা বেচা রুজি দিয়েই।
চায়ের দোকানের সামনে একটি এবং ভেতরে আরেকটিÑমোট দুটি টুল আছে। এই টুল দুটিতে বসেই লোকজন চা খায়, পান খায় ও গল্পসল্প করে। মসজিদ থেকে বেরিয়ে আনমনে হাঁটতে হাঁটতে মোহর আলী কখন যে বড় ছেলের চায়ের দোকানের সামনে এসে পড়েছে নিজেরই তা খেয়াল নেই। বিষয়টা খেয়াল হতেই দ্রæত পা বাড়িয়ে হাঁটা শুরু করলো। আর তখনই ছেলে সিরাজ মিঞার ডাক পড়লো, বাজান চা খাইয়া যান।
‘না, এখন চা খাবোনারে বাবা’ বলেই মোহর আলী আরো জোরে পা চালায়।
আরে বহেনতো বাজান। এতো সকালে আর কী কাজ, বহেন। চা খান। ছেলের অমন কথার পরও মোহর আলী পায়ের গতি বাড়িয়ে দেয়। আর ঠিক তখনই উজানি হুজুর ডেকে বসলেন।
আরে মোহর আলী বসো, বসো। তুমিতো তোমার ছেলের দোকানে আসইনা বলতে গেলে। তা ছেলে যখন অত করে বলছে তখন একটু বসো। চা খাও। আপন ছেলেইতো, পর তো না।
উজানি হুজুরের কথায় পা আটকে যায় মোহর আলীর। এই হুজুর বড় বালা মানুষ। দোকানের পাশের বড় মাদ্রাসায় ছাত্র পড়ায় আর খাঁ বাড়ির মসজিদে ইমামতি করে। সহজ-সরল হাসি-খুশিমাখা মুখ। সকলেই তাকে মান্য করে। মোহর আলীরও খুব পছন্দের মানুষ এই উজানি হুজুর।
ওয়াজ-নসিহত করলে মন গলে যায়। গতকাল বিকেলেও আছরের নামাজের পর মুসল্লিদের নিয়ে নবী (সাঃ)-এর আগমনের পূর্বের কথা বল্ছিলেন। আইয়ামে জাহিলিয়াতের সে যুগে কীভাবে মেয়েদের জীবন্ত কবর দিতো তার একটি উদাহারণ তুলে ধরেছিলেন উজানি হুজুর। শুনেই মোহর আলী হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। কান্নার মাঝেই চেয়ে দেখলেন, উজানি হুজুরের চোখেও পানি জমে ওঠেছে। মোহর আলী উজানি হুজুরের পাশে এসে বসলেন।
উজানি হুজুর বললেন, তোমার মন কি খারাপ মোহর আলী?
জি¦ হুজুর।
কী হয়েছে?
ছোট মেয়েটার ভীষণ অসুখ। বলেছে দেখতে চাইলে যেনো দেখে আসি। কিন্তু…
হাতে টাকা-পয়সা নাই?
জি¦ হুজুর।
তা ছেলেরা আছে। নিজেও কিছু লও। যাইতেতো হইবই। আপনা মেয়ে, না গেলে কেমনে হইবো? উজানি হুজুর মোহর আলীকে সান্ত¡না দেয়ার চেষ্টা করেন।
সিরাজ মিঞা চা-বিস্কিট দিলো। চায়ের কাপ এগিয়ে দিতে দিতেই বললো, এইসব আমারে কইয়া লাভ নাই বাজান। আমার হাত এখন পুরাপুরি খালি। দোকানে মাল উঠাইতে পারি না। তা নূরুরে কইয়া দেহেন কিছু দেয় কি না?
বড় ছেলের কথা শুনে মোহর আলীর মেজাজ বিগড়ে যায়। বললো, তোর দুইটামাত্র মেয়ে আর নূরুর হইলো গিয়া ৫টা পোলাপান। সে হপ্তায় মেইলে পায় ২শ’ টাকা। এই দিয়া অর অতবড় সংসার চলে? ওরে টাকার কথা কই কোন্ মুখে?
না কইলে নাই। আমারও কিছু করার নাই বাজান।
বড় ছেলের কথা শুনে মোহর আলীর মনে হলো চায়ের কাপ থেকে চাগুলো উপুড় করে ফেলে দেয়। কিন্তু পাশে উজানি হুজুর বসা। চা না খেলে উনি মনে কষ্ট পাবেন তাই কোনোমতে চা খেয়ে রাস্তায় পা বাড়ায়। রাগের কারণে বিস্কিটও মুখে দেয় নাই।
আকাশে হালকা মেঘ। ঝাপসা ঝাপসা আলো। বাড়ির কাছে আসতেই ডাহুক মারা বজ্জাত পোলাপানগুলোকে দেখলো। দু-তিনটা ছেলে মিলে একসাথে একটা ডাহুকের পেছনে দৌড়াচ্ছে। ডাহুক পাখিটি উড়াল দিয়ে অদুরেই একগোছা কচুরী পানার মধ্যে মুখ লুকালো। মোহর আলী জানে, এ সময় ক্লান্ত ডাহুকটি চোখবুঝে থাকবে। তার ধারণা হবে, চোখবুঝে মুখ লুকালেই কেউ তাকে দেখতে পাবে না। সে বেঁচে যাবে। কিন্তু বজ্জাত পোলাপানগুলা একসময় ঠিকই তাকে ধরে নিয়ে যাবে। মোহর আলী পাখিটিকে ধাওয়া দেয়া, অসহায়ভাবে কচুরীপানায় তার মুখ লুকানো এবং সর্বশেষ ডাহুকটিকে ধরে নিয়ে যাওয়াসহ পুরো প্রক্রিয়াটিকেই দেখলো কিন্তু আজ আর সে কোনো কিছুই বললো না। অবশ্য একসময় ছেলেগুলোর চোখ মোহর আলীর ওপর পড়তেই তারা ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় দেয়।
ঘরে পৌঁছতেই মোহর আলীর স্ত্রী নেকজান বিবি জিজ্ঞেস করে যে এতোক্ষণ তিনি কোথায় ছিলেন।
মোহর আলী এ কথার কোনো জবাব দেয় না। শুধু বলে যে তার লুঙ্গি এবং গামছাটা দিতে।
নেকজান বিবি লুঙ্গি এবং গামছাটা এগিয়ে দেয়।
মোহর আলী তাড়াতাড়ি গোসল সেরে ভাত খেতে বসে। আঁটা-আঁটা চালের ভাত, সাথে পুঁটি শুটকির তরকারি। মন্দ লাগেনি। তারপরও দুটো শুকনো পোড়া মরিচ চেয়ে নেয়। ভাত খেয়ে পুরনো ছেঁড়া লুঙ্গি দিয়ে হাত মুছে তারপর আপন মনেই বলে, ‘শোকর আলহামদুলিল্লাহ’।
ভাত খাওয়া শেষ হলে নেকজান বিবি আবারও জানতে চায় যে এতোক্ষণ মোহর আলী কোথায় ছিলো। উত্তরে মোহর আলী জানায় যে, বড়ছেলের দোকানে গিয়েছিলো।
নেকজান বিবি জানতে চাইলো, টাকা-পয়সা কি কিছু দিছে?
মোহর আলী বললো, নাহ।
নেকজান বিবি বললো, আমি একটু মেঝো বৌ-মার কাছে যাই?
মোহর আলী বললো যাও, তবে টাকা-পয়সা পাবা বলে বিশ্বাস হয় না।
যা আন্দাজ করেছে, তা-ই। নেকজান বিবি খালি হাতে মুখ কালো করে ঘরে ফিরে।
মোহর আলী বলে, কী খবর, পেলে কিছু?
নেকজান বিবি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
তিন.
কী আর করা। মোহর আলী নিজের সামান্য কটা টাকা নিয়েই মেয়েকে দেখার জন্যে রওনা দেয়। মেয়ের বাড়ি বেশ দূরেই।
মেয়ে জ্যোৎস্নার জামাই একটা হোটেলে কাজ করে। সামান্য কটা টাকা পায়, তাই দিয়ে সংসার চালায়। নাতনীরা তিনজন, নাতি একজন। নাতিটা ছোট, বড় নাতনির বিয়ে হয়েছে এক মৌলভীর সাথে কিন্তু তারপরে যৌতুক দিতে হয়েছে। এই যৌতুকের দেনা শোধ করতে গিয়েই নানা চাপে মেয়েটা বিছানায় পড়ে। এখন প্যারালাইসিসের মতো অবস্থা। সাথে মাথা ঘুরানি ও থেকে থেকে বমি করে। এসবই শোনা কথা। টাকার অভাবেই মেয়েটাকে দেখতে যেতে পারেনি মোহর আলী। শেষ অবস্থার কথা শুনেই মেয়েকে গতকাল দেখতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় মোহর আলী।
উপজেলা হাসপাতালের এককোণে একটা সিটে মেয়ে জ্যোৎস্না শুয়ে আছে। বিশাল হাসপাতাল কিন্তু ডাক্তার-নার্স কিছু আছে বলে মনে হয় না। মেয়েকে দেখেতো মোহর আলীর চোখ ছানাবড়া। একি চেহারা হয়েছে মেয়ের! কঙ্কালসার শরীর, চোখ কোটরাবদ্ধ। বাবাকে দেখে মেয়ে জ্যোৎস্না ক্ষণিকের জন্যে চোখ তুলে তাকায়, আবার চোখ বন্ধ করে। হাতটা একটুখানি বাড়াতে চেয়ে আবার নামিয়ে নেয়। কথা বলতে চেয়েছিলো কিন্তু বলতে পারেনি। মেয়ের চোখ বেয়ে অশ্রæ গড়িয়ে পড়ে।
মোহর আলীরও চোখে অশ্রæ ধরে রাখতে পারেনি। সে কাঁদে। গলায় গামছার মতো জড়ানো রুমাল দিয়ে চোখ মুছে। মেয়ের গায়ে আলতো হাত বুলায়। মেয়ের শীতল হাতে কটা টাকা গুঁজে দিয়ে একসময় বেরিয়ে আসে হাসপাতাল থেকে। তারপর সোজা বাড়িতে। নাতি-নাতনীদেরও ভালো করে তেমন কিছু বলতে পারেননি।
এখন শুয়ে শুয়ে মেয়ের কথা ভাবে মোহর আলী। মেয়েটা বাঁচবে তো? যদি না বাঁচে তবে নাতি-নাতনীগুলোর কী হবে? এরপরই রাতের আঁধারকে ফালি ফালি করে একসময় মোহর আলী হাঁক দিয়ে ওঠে… ‘আল্লা গো’।
আরো অনেক পরে মসজিদ থেকে আজানধ্বনি ভেসে আসে। মোহর আলী আলহামদুলিল্লাহ বলে পাশ ফেরে। তারপর আস্তে আস্তে বিছানা থেকে ওঠে পড়ে। বাইরে এসে একটা বন লেবরি ডাল ভেঙে তাকে দাঁত দিয়ে থেতলিয়ে দাঁত মাজে। পায়খানায় যায়। এরপর পাকসাফ হয়ে অজু করে ঘরে আসে।
মোহর আলীর ইচ্ছে ছিলো মসজিদে গিয়েই নামাজ পড়বে। কিন্তু চিন্তা-ভাবনায় শরীর তার অবশ হয়ে আসছে যেনো। কিছুক্ষণ আগে এক পশলা বৃষ্টিও হয়েছে। রাস্তার অবস্থাও ভালো হওয়ার কথা নয়। সবমিলিয়ে মোহর আলী সিদ্ধান্ত নিলো আজকে ফজরের নামাজ সে ঘরেই পড়বে। মসজিদে পড়বে না।
একটু আলো হবে ভেবে দরজা সোজা মাদুর বিছিয়ে নামাজ পড়তে বসে মোহর আলী এবং একসময় নামাজ শেষও হয়। নামাজ শেষ করে মোহর আলী মোনাজাত ধরে, ‘ইয়া আল্লাহ, ইয়া রাহমানুর রাহিম’ বলে দু হাত উপরে তুলে। এরপরই হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দেয় মোহর আলী।
মোহর আলী কাঁদতে থাকে। কাঁদতে থাকে আর চিৎকার করতে থাকে। মোহর আলীর চিৎকার শুনে ঘরের সবাই ছুটে আসে। তার স্ত্রী নেকজান বিবি স্বামীর হাত ধরে। মিনতি করে বলে, ‘আপনি কান্না থামান। কানতে কানতে আপনার শরীরের সব পানিতো ঝইরা যাইবো। আপনি বাঁচবেন কীভাবে? আপনি কান্না থামান।’
মোহর আলী বলে, আমি পাপী, আমি গুনাহগার। না হইলে এই জগতে কেনো এতো অসহায় আমি? সে নেকজান বিবিরি দিকে তাকিয়ে বলে, আমার চোক্ষেও পানিতো চোক্ষের পানি না। এ হইলো গিয়া দরিয়ার পানি। কহর দরিয়ার পানি। এই পানি জীবনেও শেষ হইবো না।
মোহর আলী কাঁদে আর কথা বলে। তার চিৎকারধ্বনি পাশের বাহারি দালানের শিক গলিয়ে গড়িয়ে পড়ে অদূরে ডোবার জলে।
দূরের মরীচিকা
আনিস ফারদীন
তোমার প্রেমে হারিয়ে গেছে মাস্তুল
দিকভ্রান্ত সারস হয়ে গেছে ইচ্ছেরা-
বিস্তর গলি এসে ঠেকেছে কানা গলিতে।
ভুলের খাতায় নাম লিখিয়ে হৃদয় ভাসে শুন্যতায়-
উর্বরতা হয়ে যায় ক্ষয়,
মৃত্তিকা হয়ে উঠে পোড়া ফলক, নক্ষত্ররাও যেন ঝরে পড়ে অনিচ্ছায়।
তবু আমি ভুলে যাই সব হিসেব,
খেরো খাতার হিসেব মুছে আবার অগত্যা হাত বাড়াই,
পুড়ে ফেলি হাত,
নক্ষত্ররাও পুড়ে কয়লা হয়ে যায়।
স্মৃতির মিনার দাঁড়িয়ে থাকে উর্ধ্বে মাথা তুলে,
বেদনাদের বুকে নিয়ে এগিয়ে যায়, মিথ্যে আঁকড়ে ধরে স্বপ্নে বাঁচে,
আশা হয়ে উঠে গুড়েবালি দূরের মরীচিকায়;
দু’চোখ জলে ভাসে-
পুর্ণতায় গন্তব্য না পেয়ে সব যেন হয়ে যায় শুন্যতা!
মেয়েটির জন্যে ফুল
ক্ষুদীরাম দাস
মেয়েটির জন্যে ফুল ছিলো ঔ বাগানে
ভুল হয়নি তার, ঠিকই ছিলো মনে
মেয়েটি ছিলো ছেলেটির অপেক্ষায়
ভালোবাসার ভঙ্গিমায় আড়চোখে তাকায়।
ঐ মেয়ে মরে যাবে তুমি প্রেমে পড়ো না
পরের গল্পটি অনেকেরই জানা।
বাগানের ফুলগুলো মরে গেছে, পচে গেছে
মািটতে পড়েছিলো দেখেছি মাটিতেই মিশে গেছে,
হয়তো ফুলগুলো চলে গেছে কোনো এক বর্ষায় ভেসে
হয়তো সেদিনই ছেলেটিকে বন্দী করলো মেয়েটি হেসে।
বাগানের ফুলগুলোর দুঃখ আছে মেয়েটির মতো
চোখে চোখ রাখি খেলে ওরা, ইস ওরা পারেও কতো।
দু’টি হৃদয়ে ভালোবাসা জড়িয়ে গেলে
প্রেমিক প্রেমিকা পরস্পরে আবিস্কার করে!
পরস্পরে গাল ছুঁয়ে দেখে!
পরস্পরে হাত ধরে হাঁটে!
পরস্পরে আরো কাছে আসে!
মেয়েটির জন্যে ফুল
ফুল যে ভালোবাসা জাগায়
মেয়েটা কতো হেসেছিলো
আহা! কতো হেসেছিলো
বাগানের ফুলগুলো দেখেছিলো আহারে!
শুকনো গোলাপ
ইউসুফ আল সাইফ
শুকনো গোলাপে বন্দি স্মৃতি
বর্ষার আদরে তোমার নামে আজো
মনের শহর জুড়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস!
হেরে গেছি সেদিন,
যেদিন বিবেকের কাছে ভালোবাসা হারল!
এ প্রেম সেই প্রেম নয়!
বুকের উষ্ণতায় তুমি যতবার প্রেম পোড়াতে চেয়েছ,
আমি ততবার বুকে টেনে বলেছি ভালোবাসি।
তবুও অবহেলায় ঠেলে দিয়ে,
সমস্ত আবেগ টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেছ
রাতের অগোছালো বিছানায়!
আমার শরীরে তোমার স্পর্শ
অথচ একবিন্দুও ভালোবাসতে পারোনি!