মুহাম্মদ ফরিদ হাসান:
সফল কবিতা মহাকালের যাত্রী হলেও এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সমকালে পা রেখেই কবিতা মহাকালের দিকে যাত্রা শুরু করে। সে কারণে অধিকাংশ কবিতাকে সমকালেই চিহ্নিত করা যায় এবং এও অনুভব করা যায়Ñএর উজ্জ্বল আলো কতদূর থেকে পাঠক দেখতে পারবেন। সময়কে সবচেয়ে সফল বিচারক বলা হয়, যদিও এ নিয়ে বিতর্ক কম নেই। তবু সাহিত্যের বিবেচনায় সময়ের পরিবর্তন অনেক বার্তা সমকালীন লেখকদের দিয়ে যায়। সময় যতো পার হয় ততোই অপেক্ষাকৃত মানহীন লেখা ও লেখক বিস্মৃত হতে থাকেন। সবচেয়ে ভালো ও মহৎ সাহিত্যকর্মকে মহাকাল সযতেœ আগলে রেখেছে এবং ধারণ করেছেÑবিগত দু হাজার বছর পর্যালোচনা করলে এমন সত্যতা আমরা সহজেই অনুধাবন করতে পারি। কাজী নজরুল ইসলাম ও জীবনানন্দ দাশের জন্ম ১৮৯৯ সালে আর জসীম উদ্দীনের জন্ম ১৯০৩ সালে। এই তিনজন কবি সমসাময়িক হলেও কাব্য চর্চায় তাদের মধ্যে প্রভেদ স্পষ্ট। নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী হয়েছেন, জীবনানন্দ নিমগ্ন থেকেছেন বিচিত্রভাবে এবং জসীম উদ্দীন এ দুজনের থেকে দূরে সরে গিয়ে পল্লীর অন্দর-বাহিরে হেঁটেছেন। যার ফলে তাঁদের মৃত্যুর এতো বছর পর তিনজনই বাংলা সাহিত্যে স্ব-স্ব অবদানে উজ্জ্বল হয়ে আছেন। আলোচ্য প্রবন্ধে নজরুল ইসলাম বা জীবনানন্দ দাশ নন, আমরা জসীম উদ্দীন-এর দিকে দৃষ্টি দিয়ে তাঁর কবিতার অন্দর-বাহির, বেদনা ও দহন, উচ্ছ্বাস ও অনুষঙ্গ নিয়ে আলোকপাত করতে চাই।
জসীম উদ্দীন তাঁর কবিতার অধিকাংশ উপকরণ পল্লীর অনুষঙ্গ থেকে নিয়েছেন। এই নির্বাচনই শুরু থেকে তাঁকে অন্যদের চেয়ে পৃথক করে রেখেছে। জসীমউদ্দীন সম্পর্কে ড. আনিসুজ্জামান বলেছেন, ‘রবীন্দ্র প্রভাব থেকে মুক্তিলাভের চেষ্টায় আমাদের আধুনিক কবিরা যখন পাশ্চাত্য প্রভাবকে অঙ্গীকার করেছিলেন, জসীমউদ্দীন তখন দেশীয় ঐতিহ্য ও গ্রামীণ পরিবেশের মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন কবিতার নতুন উপাদান। তাঁর কবিতায় পল্লীজীবনের সুখ-দুঃখ হাসিকান্না প্রেম-ভালোবাসা ঈর্ষাদ্বন্দ্ব তার সকল আদিমতা নিয়ে দেখা দিয়েছিল। কবিতার ভাষায়ও তিনি নিঃসঙ্কোচে আমদানি করেছিলেন গ্রাম্য শব্দ।’ বস্তুত ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করলেও জসীম উদ্দীন নাগরিক যাপনকে ঐভাবে তুলে ধরেন নি, যেভাবে গ্রামীণ জীবনকে তুলে ধরেছেন। এর কারণ, তিনি নিজের ভেতর ও বাহিরে গ্রামের প্রতি অপরিসীম দরদের ¯্রােতধারা জিইয়ে রেখেছিলেন। তিনি কেবল কবিতাতেই নয়, ব্যক্তিগতভাবেও পল্লী জীবনের সুখ-দুঃখ, দাহ অনুসন্ধানে আগ্রহী ছিলেন। মাটির কাছাকাছি থেকে তিনি মাটির মানুষদের খোঁজ-খবর নিতেন নিয়মিত। আবার কখনো কখনো তাঁর বাড়িতে বসতো গানের আসর। জসীম উদ্দীনের কবিতার অনেক চরিত্রই বাস্তব এবং চর্মচক্ষে দেখা। গ্রামীণ জীবনের নিবিড়তম পথচলা, ফসলের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশের মাধুর্য, নি¤œবিত্ত সরল মানুষের বেদনাকে তিনি বারবার তুলে ধরেছেন কবিতায়। উপমা, উৎপেক্ষাগুলোকেও গ্রামীণ অনুষঙ্গে সাজিয়েছেন নান্দনিকভাবে। সেজন্যেই দেহকে তিনি কখনো ‘তমাল তরু’, কখনো ‘লাউয়ের ডগা’র মতো দেখেছেন। কখনো তাঁর মনে হয়েছে লাল মোরগের পাখা মতো নায়িকার শাড়ি উড়ছে, চুলকে মনে হচ্ছে ‘মেঘবরণ’ এবং কখনো কবি মুখকে দেখেছেন ‘নতুন চরের মতো’। কবির এমন উপমা, রূপক ও উৎপ্রেক্ষার প্রয়োগ নিঃসন্দেহে অনেক বেশি দৃষ্টিগ্রাহ্য ও ব্যতিক্রম। এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে আরো কিছু কবিতাংশের পাঠ নেয়া থেকে বিরত থাকার লোভ সংবরণ করা গেল না :
ক) ‘কলমিলতা শাড়ি মেয়ের, কলমি রাঙা মুখ/ঠোঁট দুখানি সিঁদুর ভাঙা, রাঙা যে টুকটুক।’
খ) ‘এক পুতুলে আদর করে আরেক পুতুল লয়ে/কোনটি পুতুল, কোনটি যে নয় যায় যে রে ভুল হয়ে।’
গ) ‘জালি লাউয়ের ডগার মতোন বাহু দুখান সরু,/ গা খানি তার শাওন মাসের যেমন তমাল তরু।’
জসীম উদ্দীন তাঁর কবিতার উপমার প্রয়োগেও পল্লীর অনুষঙ্গ নিপুণভাবে ব্যবহার করেছেন। তাঁর এই প্রয়োগ দেখে বিশ্লেষকগণ একমত হবেন যে, জসীম উদ্দীন পল্লীর পথ-প্রান্তরে যা দেখেছেন, সযতনে কুড়িয়ে নিয়েছেন এবং কবিতায় ব্যবহার করেছেন। মানুষের রূপ ও গুণের সাথে পল্লীর অনুষঙ্গের যে তুলনা, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে।
জসীম উদ্দীনের কবিতার পরতে পরতে পাওয়া যায় মটরশুটি, ধানক্ষেত, আঁকাবাঁকা পথ, কলমিলতা শাড়ি, নদী, সবুজ খেত, চাষা, কৃষাণীর মুখ, কালো ভ্রমণ, ফুল, কচি ধান, নতুন চর, বাঁশি, কাজল, লাল মোরগ, পাটের বন, হাঁড়ি, শিকা, হেমন্ত চাঁদ, ক্ষেতের আল, সিঁদুর, খোঁপা, লাঠি খেলা, মাঠ, বিল, মাটির প্রদীপ, ফাগুনের হাওয়া, নূপুর, সাঁঝের বেলা, বাউল বাতাস, নৌকা, সোনার অঙ্গ, রাঙা ঠোঁট, আঁচল, হালের গরু, সিঁথি’র মতো আরো বিচিত্র সব পল্লীসংশ্লিষ্ট উপকরণ। এমন সহজ-সরল শব্দ এবং চিরচেনা প্রকৃতি ও মানুষকে জসীম উদ্দীন কবিতার নান্দনিক ক্যানভাসে শৈল্পিকভাবে এঁকেছেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘সহজ কথা যায় না লেখা সহজে’। কবিতায় শিল্পমান অক্ষুণœ রেখে সরলভাবে ভাব প্রকাশ করা সত্যিই সহজ কাজ নয়। অথচ জসীম উদ্দীন সহজ বলার মতো কঠিন কাজটিই সিদ্ধহস্তে করেছেন। কবির এমন সরলতা আমাদের দৃষ্টির বাইরে যেতে পারে না। তিনি অদ্ভুত সরলতায় রাখাল ছেলেকে পেছনে ফিরতে বলেন এবং দেখাতে চান, ‘ওই যে দেখ নীল-নোয়ান সবুজ-ঘেরা গাঁ/কলার পাতা দোলায় চামর শিশির ধোয়ায় পা;’। আবার প্রেমিকপ্রবণ ভাবনায় তিনি প্রেমিকার জন্যে সহজেই বলতে বলতে পারেন : ‘কলমী ফুলের নোলক দেব, হিজল ফুলের দেব মালা,/মেঠো বাঁশী বাজিয়ে তোমার ঘুম পাড়াব, গাঁয়ের বালা।’ এমন সরলতার কারণে বাংলা ভাষাভাষী পাঠককুল তাঁকে খুব দ্রুত গ্রহণ করে নিয়েছিলো। কেবল তা-ই নয়, পাঠকদের পাশাপাশি সাহিত্য সমালোচক ও বোদ্ধাদের প্রশংসায়ও তিনি অতিদ্রুত সিক্ত হয়েছেন। আমাদের স্মরণ হয়, জসীম উদ্দীনের বিখ্যাত ‘কবর’ কবিতাটি তাঁর ছাত্রজীবনের লেখা। এ অসামান্য কবিতাখানি প্রথমে বিখ্যাত ‘কল্লোল’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পরে ড. দীনেশ চন্দ্র সেন কবিতাটি কলকাতা বিশ^বিদ্যালয়ের প্রবেশিকার (বর্তমানে যাকে এসএসসি বলি) পাঠ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেন। বিরল সম্মানের বিষয় এই যে, জসীম উদ্দীন নিজেই তখন একই বিশ^বিদ্যালয়ে বিএ অধ্যায়ন করছিলেন। এ ঘটনা থেকে স্পষ্ট, জসীম উদ্দীনকে কবি হিসেবে পাঠক মহলে সমাদৃত হতে বেশি বেগ পেতে হয় নি। ১৯২৭ সালে পলাশী প্রকাশন থেকে কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রাখালী’ প্রকাশিত হলে সর্বত্রই এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ড. দীনেশ চন্দ্র সেন পূর্ব থেকে জসীম উদ্দীনের কবিতার অনুরাগী ছিলেন। ‘রাখালী’ সম্পর্কে তাঁর অকপট অভিমত : ‘তার কবিতায় আম-কাঁঠালের ছায়ায় ঘেরা সেই পল্লীমায়ের শীতল স্পর্শ পাই। মায়ের চেয়ে আপন বলতে আমি আর কাউকে জানিনে। তার পদ্ম-শালুক ফোটা খাল-বিল, ভাটিয়ালি গানে মুখর পদ্মা-যমুনা নদী, অতসী-অপরাজিতা, টগর-চামেলি ফুলের সুবাস-ভরা আঙ্গিনায় মায়ের এই অপরূপ মূর্তি আমি পাই জসীমের কবিতায়।’ কেবল এ অভিব্যক্তি দীনেশচন্দ্র সেনের নয়, এমন মন্তব্য আরো বিদগ্ধজনেরই। যদিও জসীম উদ্দীনের কবিতা সম্পর্কে এর বিপরীত মন্তব্যও রয়েছে (এমনকি ‘পল্লী কবি’ অভিধা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে)। আর এমন সমালোচনা থাকাটাও অস্বাভাবিক নয়।
জসীম উদ্দীনের ভাষাশৈলী বিষয়ে কিছু কথা না বললেই নয়। তিনি যে সময়ে লিখতে বসেছিলেন, নিঃসন্দেহে তিনি অন্যান্য শক্তিমান লেখকদের মতো তিনিও শ্রমলব্ধ চর্চার মাধ্যমে নিজস্ব ভাষাশৈলী তৈরি করে নিয়েছিলেন। তাঁর উপস্থাপনের সাথে পূর্ববর্তী এবং তাঁর সময়কালীন কারো শব্দচয়নের মিল নেই। শব্দের উপস্থাপন, উপমার অনুষঙ্গ নির্ধারণ, চরিত্র চয়নে তিনি সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য সত্তার পরিচয় দিয়েছেন। এজন্যেই স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বলতে শুনি তিনি জসীম উদ্দীন সম্পর্কে বলেছেন, ‘জসীম উদ্দীনের কবিতার ভাব, ভাষা ও রস সম্পূর্ণ নতুন ধরনের। প্রকৃত কবির হৃদয় এই লেখকের আছে। অতি সহজে যাদের লিখবার ক্ষমতা নেই, এমনতর খাঁটি জিনিস তারা লিখতে পারে না।’ রাখালী থেকে শুরু করে নক্সীকাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট হয়ে ‘কাফনের মিছিল’ পর্যন্ত তাঁর সবকটি কাব্যগ্রন্থে নতুন ধরনের ভাব, ভাষা ও রসের প্রবাহ অব্যাহত ছিলো। এখন প্রশ্ন হতে পারে এর আগে বা সমকালে এমন পল্লী নিমগ্ন হয়ে কেউ কি লিখেন নি? এর জবাবে কালিমোহন ঘোষ, যতীন্দ্রমোহন বাগচীর নাম উচ্চারণ করা যেতে পারে। তাঁদের কর্ম ও সাধনা স্বীকার করেই বলতে হয়, তাঁরা পল্লীর চিত্র এঁকেছেন ঠিকই, কিন্তু পূর্ণচিত্র যথার্থভাবে আঁকতে সমর্থ হননি। জসীম উদ্দীন যেভাবে সুবৃহৎ ক্যানভাসে পল্লীর রূপ-রস-দুঃখ উপস্থাপন করেছেন, সেভাবে আর কেউ পারেনি। জসীম উদ্দীনের ভাষা শৈলী নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তাঁর সময়ের দিকেও দৃষ্টি দেয়া চাই। বাংলা কবিতার ইতিহাস হাজার বছরের বেশি সময়ের হলেও কবিতায় আধুনিকতা এসেছে বেশি সময় পার হয়নি। আমাদের মনে রাখতে হবে মাইকেল মধুসূদন দত্ত সাহিত্যে পা রেখেছিলেন ১৮৫৯ সালে, অমিতাক্ষরে ‘তিলোত্তমাসম্ভব’ লিখেছেন ১৮৬০ সালে। মধুসূদনকে প্রথম আধুনিক কবি বলা হয়। এরপর রবীন্দ্রনাথ, ত্রিশের কবিরা আধুনিকতাকে আরো অর্থবহ করে তুলেছিলেন। সে-হিসেবে বাংলা কবিতা আধুনিকতায় পা রাখার ছয় দশক পর জসীম উদ্দীন ‘রাখালী’ নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ যেমন সময়ের সাথে মানিয়ে নিয়েছেন, জীবনানন্দ দাশ যেমন আধুনিক শব্দাবলী প্রয়োগ করেছেন এবং এ প্রয়োগে তাঁর কবিতার দুর্বোধ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিলোÑজসীম উদ্দীন একই ভাবে কবিতার শব্দ প্রয়োগে এবং বাক্য গঠনে আধুনিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। যেহেতু এদেশে বেশিরভাগ মানুষ গ্রামে বাস করে, তাই তাদের জীবন প্রবাহ আধুনিক ভাবধারায় তুলে ধরার মাধ্যমে জসীম উদ্দীন সহজেই আধুনিক কবিদের মধ্য থেকে আলাদা হতে পেয়েছিলেন এবং পাঠক-বোদ্ধা মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। এখানে উল্লেখ্য, তাঁর কবিতার দেহ জুড়ে অজ¯্র গ্রামীণ শব্দ ব্যবহৃত হলেও সেগুলো কখনোই আধুনিকতাকে ম্লান করেনি।
জসীম উদ্দীনের কবিতায় প্রচুর রঙের ব্যবহার লক্ষ্যণীয়। তবে রঙের ব্যবহারে কবি সতেচনভাবে ‘কালো’ রঙের পক্ষপাতি ছিলেন। পাশাপাশি লাল ও সোনালী, সবুজ রঙের ব্যবহার তাঁর কবিতায় কম নেই। কবিতায় রঙের উপস্থাপন তাঁর কবিতাকে নিঃসন্দেহে বর্ণিল করেছে। তাঁর কবিতায় কালো রঙের উদ্যাপন :
ক)
কালো চোখের তারা দিয়েই সকল ধরা দেখি
কালো দতের কালি দিয়েই কেতাব কোরান লেখি
জনম কালো, মরণ কালো, কালো ভুবনময়
চাষীদের ওই কালো ছেলে সব করেছে জয়।
Ñনক্সীকাঁথার মাঠ
খ)
এই গাঁয়েতে একটি মেয়ে চুলগুলি তার কালো কালো
মাঝে সোনার মুখটি হাসে আঁধারেতে চাঁদের আলো।
Ñরাখালী
গ)
কাল সে আসিবে, মিছাই ছিড়িছি আঁধারের কালো কেশ
আজকের রাত পথ ভুলে বুঝি হারাল ঊষার দেশ।
Ñকাল সে আসিবে
কালো শোকের প্রতীক হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জসীম উদ্দীন কালোকে রঙকে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করেছেন। উপরোক্ত কবিতাংশের মতো আরো কিছু কবিতা রয়েছে সেগুলো পাঠ শেষে কালোকে আলোকিত করে উপস্থাপন করার প্রয়াস লক্ষ্যণীয় হয়। কিন্তু এও সত্য যে, জসীম উদ্দীনের কবিতায় দুঃখবোধের উপস্থিতি খুব প্রবল। কোনো কোনো দুঃখের দহন এমনি যে পাঠক হৃদয়ে সেটি দীর্ঘ হাহাকারের সৃষ্টি করে। যেমন, সুদীর্ঘ ‘কবর’ কবিতাটি। পাঠকমাত্রই জানেন এটি কবিতা, বাস্তব নয়। তারপরেও দাদুর জন্যে এবং তাঁর প্রয়াত স্বজনদের জন্যে আমাদের মন কেঁদে ওঠে। আমরা শোকে বিহ্বল হই। কবিতার আবেগকে পাঠকের মধ্যে প্রবাহিত করার মধ্যে দিয়ে কবি অনন্য হয়ে ওঠেন। আমরা জসীম উদ্দীনের আরেকটি কবিতার কথা এ ব্যাপারে স্মরণ করতে পারি। ‘পল্লী জননী’ কবিতায় কবি চিরকালীন একজন মায়ের চিত্র তুলে ধরেছেন। রুগ্ন ছেলের শয্যাপাশে শুয়ে মা কত কিছু ভাবেন, কত প্রার্থনা করেন ¯্রষ্টার দরবারে। কত আশঙ্কা, অলুক্ষণে ভাবনা তার মনে আসে। মা নির্ঘুম থেকে ছেলের শিয়রে বসে থাকলেও মনে হয় ‘পাশের্^ জ¦লিয়া মাটির প্রদীপ বাতাসে জমায় খেল,/আঁধারের সাথে যুঝিয়া তাহার ফুরায়ে এসেছে তেল!’ আমরা এমন ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্যে যে ভাষা পাই তা আমাদের দুঃখবোধকে আরো উস্কে দেয় এবং হৃদয়কে বিদীর্ণ করে। আবার ‘নক্সীকাঁথার মাঠ’-এর সাজু-রূপাইয়ের কথা কার না মনে আছে! রূপাই ও সাজুর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জসীম উদ্দীন নক্সীকাঁথার মাঠের সমাপ্তি টেনেছেন। কবির এমন বেদনাবহ আরো অনেক কবিতা রয়েছে, যে কবিতাগুলো পাঠকের মনকে মুহূর্তে থমকে দেয় আর পাঠক প্রবেশ করে জসীম উদ্দীনের নিজস্ব জগতে।
জসীম উদ্দীনের কবিতা পাঠ শেষে কিছু প্রশ্ন যে আমাদের সামনে উত্থাপিত হয় না, এমন নয়। আমরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, তিনি পল্লীর যে গৃহখানি নির্মাণ করেছিলেন, এর বাইরে নিজেকে কখনো নিয়ে যেতে পারেন নি। বিষয় নির্বাচন ও এর বৈচিত্র্য নিয়েও কথা বলা যায়। জসীম উদ্দীন নিজেকে প্রায় একরৈখিক অবস্থানে রেখেছিলেন। সেকারণে তাঁর কবিতায় কিছু কিছু উপকরণ ও ভাবের পুনঃপুন ব্যবহার আমরা দেখেছি। আবার সময়ের যে তীব্র অভিঘাত, যাপনের যে তীব্র দাহÑতার কোনো প্রভাবও আমরা ঐভাবে জসীম উদ্দীনের কবিতায় দেখতে পাই না। অথচ তিনি পুরোমাত্রাই সমাজ ও অধিকার সচেতন ছিলেন। কবির আত্মজীবনী ‘জীবনকথা’কে স্বাভাবিকভাবে এমন মন্তব্যের বাইরে রাখা যায়। জসীম উদ্দীনের কবিতা নির্দিষ্ট সীমারেখা অতিক্রম না করলেও শিল্পসৌন্দর্য কবিতাগুলোকে ঐশ^র্য্যশালী সর্বোতভাবে করে তুলেছে এবং পাঠের যে আনন্দ তা দান করেছে।
এসব বিষয় স্মরণ রেখেও একথা নিঃসঙ্কোচে বলা যায়, বাংলা সাহিত্যে জসীম উদ্দীনের কবিতা এক নতুন সংযোজন। তাঁর কবিতা সহজ-সরল শব্দবন্ধের দেহে অসাধারণ ভাব নিয়ে পাঠকসম্মুখে উপস্থিত হলেও বর্তমান প্রজন্ম তাঁকে ঐভাবে পাঠ করতে পারছে না। জসীম উদ্দীন কেবলমাত্র তাদের মুখে উচ্চারিত হচ্ছে, অনেকেই কবিকে নামেমাত্র জানেন। আবার একদল আছে, যারা জসীম উদ্দীনের কবিতার পাঠ না নিয়েই উত্তরাধিকারসূত্রে জানে : জসীম উদ্দীন বরেণ্য কবি। কবিতা পাঠব্যতীত এমন উপলব্ধি আমাদের জন্যে অনেক হতাশা ও বেদনাবহ। কবির পরিচয় তাঁর কবিতায়, তাঁর সৃষ্টিকর্মে। জসীম উদ্দীনকে পাঠপূর্বক মূল্যায়ন করলে সেটি যর্থার্থ মূল্যায়ন হবে। এর বাইরের মূল্যায়ন ফাঁপা উচ্চারণ মাত্র, অযৌক্তিকও বটে।
দিন দিন পল্লীর অন্দরে ঢুকে পড়ছে নগর, পল্লীজগৎ তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হারাচ্ছে। এই সময়ে এসে জসীম উদ্দীনের দেখা ও লেখা অনেক উপকরণই হারিয়ে গেছে। কিন্তু তাঁর অনন্ত যৌবনা কবিতা সেই ঐতিহ্যকে স্বগৌরবে এখনো ধারণ করে আছে। এই উপস্থাপন কম গুরুত্ববহ নয়। শব্দ চয়ন, নিজস্ব জগৎ সৃষ্টি, উপমা-উৎপ্রেক্ষার প্রয়োগ ও ভাব প্রকাশের পারঙ্গমতা বিচারে জসীম উদ্দীন নিঃসন্দেহে বাংলা ভাষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কবি। বাংলা কবিতার অন্দরে-বাহিরে হাঁটা সফল এই বরপুত্র যে আরো কয়েক শ’ বছর কবিতার রহস্যে পাঠকদের বিমোহিত করে রাখবেন, সেকথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।