কাদের পলাশ
১২মার্চ ২০২০ বৃহস্পতিবার খুব ভোরে ঘুম ভাঙে। বাসায় কেউ নেই। স্ত্রী সন্তানরা বেড়াতে গেছে। আমি বিছানায় একা ছটপট করছি। বেশ কয়েকটি কাজের পরিকল্পনা থাকলেও কোথা থেকে শুরু করবো বুঝতে পারছি না। দীর্ঘ প্রায় ১৫দিনের ভ্রমণ শেষে চাঙ্গা হওয়ার চেয়ে আরো অলস হয়ে গেছি মনে হচ্ছে। সকালে গোসল সেরে বের হই সাপ্তাহিক শপথ-এর অফিসের উদ্দেশ্যে। অফিসে এসে ভাবি কি করা যায়। হঠাৎ মনে হলো চাঁদপুর পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদ প্রার্থী জিল্লুর রহমান জুয়েল ভাইকে নিয়ে কাজ করেছি। এবার বিএনপি প্রার্থী সফিকুর রহমান ভূঁইয়াকে নিয়ে কাজ করতে হবে। তখন সকাল ৯টা ৩৪ মিনিট। সফিক ভাইকে ফোন করি। জানতে চাই গণসংযোগ কোথায় করছেন? সফিক ভাই বললেন, ৫নম্বর ওয়ার্ডে। সাপ্তাহিক শপথ অফিস থেকে কালীবাড়ি কোর্ট স্টেশনে গিয়ে মোটরবাইক থামালাম। কারণ সাড়ে দশটায় চাঁদপুর প্রেসক্লাবে একটি সংবাদ সম্মেলন হওয়ার কথা। অনিবার্য কারণ বশত সংবাদ সম্মেলনটি স্থগিত করা হয়। সফিক ভাইয়ের গণসংযোগের ছবি ও ওপেনিয়ন লাগবে নির্বাচনী রিপোর্টের জন্যে। তখনো আমি একাই যাবার চিন্তা করছি। ১০:২০ মিনিটে বৈশাখী টিভির প্রতিনিধি ওয়াদুদ রানা ভাই কল করে বললেন, চারদিন পর ঢাকা থেকে এসেছি। কোনো নিউজ আছে? আমি বললাম, সফিক ভাইয়ের গণসংযোগ কাভার করতে যাচ্ছি। আমাকে অপেক্ষা করতে বলে তিনি দ্রুত ছুটে এলেন। র্কোট স্টেশনেই দেখা হয়ে গেলো ডিবিসি নিউজের চাঁদপুর প্রতিনিধি তালহা জুবায়ের-এর সাথে। সে জানতে চাইলো কোনো কাজ আছে ভাই? আমি বললাম তেমন কাজ নাই। তবে বিএনপি প্রার্থীর কিছু গণসংযোগের ভিডিও লাগবে আর একটা স্বাক্ষাৎকার নিবে। তাই ৫নম্বর ওয়ার্ডে যাবো। তালহা যাবে কি যাবে না আমতা আমতা করছিলো। কিছুক্ষণের মধ্যে তালহা উধাও হয়ে গেলো। ততোক্ষণে রানা ভাই চলে এলেন। দুজন রওনা করলাম সফিক ভাইয়ের গণসংযোগের উদ্দেশ্যে। পুরানবাজার সেতু পার হতেই তালহার কল। রিসিভ করতে বলে, ভাই আপনি কোথায়? আমিও যাবো। আমি বললাম জুট মিলের সামনে দাঁড়ালাম। চলে এসো। তালহা চলে এলো।
৫নম্বর ওয়ার্ড সীমানায় পৌঁছালাম। কিন্তু সফিক ভাই ঠিক কোথায় গণসংযোগ করছেন জানতে বা বুঝতে পারলাম না। ঠিক ১১টায় সফিক ভাইকে আবার ফোন দিয়ে অবস্থান নিশ্চিত হলাম। পরে ভাঙারপুল এলাকায় গিয়ে সফিক ভাইয়ের দেখা পেলাম। শতশত নেতা কর্মীকে সাথে নিয়ে গণসংযোগ করছেন। প্রধান সড়কে এনে ভিডিও নিলাম। একনিষ্ঠভাবে গণসংযোগ করছেন সফিক ভাই। মাথা থেকে কপাল বেয়ে টপটপ করে ঘাম ঝরছে। চেহারায় ক্লান্তি আছে কিন্তু কাউকে বুঝতে দিচ্ছে না। অচীন পাখিতে এতোমধ্যে আপন হয়েছে কাউকে বুঝতে না দিয়ে গণসংযোগ করে যাচ্ছেন। ভাইকে বললাম, কয়েকটা বিষয়ে আপনার বক্তব্য দিতে হবে। আমি একসাথে কয়েকটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিই। তিনি একএক করে উত্তর দিচ্ছেন। উত্তর দেয়া শেষ হতেই তালহা প্রশ্ন করলো ‘আপনি কি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনী মাঠে থাকবেন’ ভাই প্রশ্নটি শুনে বিরক্ত হলেন। সাংবাদিকদের কাছ থেকে তিনি এমন প্রশ্ন প্রত্যাশা করেননি। কারণ তিনি জয়ের জন্যেই মাঠে নেমেছেন। উত্তরে বলেছিলেন, নির্বাচনী পরিবেশ সুষ্ঠু রাখতে সাংবাদিকদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। স্বাক্ষাৎকার নেয়া শেষ হলো, আমাকে কাছে ডেকে বলেন, পলাশ তুই সন্ধ্যায় বাসায় আসিস। আমি আগ পিছ না ভেবে বলেছি আচ্ছা ভাই। রানা ভাই তালহাকেও বললাম সন্ধ্যায় ভাইয়ের বাসায় গিয়ে দেখা করবো। কিন্তু তালহা প্রথম থেকেই বলছে সে যাবে না। সবশেষ আমি জোরে বলেছিলাম সন্ধ্যায় কল দিস। কথাটা তালহা শুনেনি। অবশ্য ততোক্ষণে সে কিছুটা দূরে চলে গেছে।
সন্ধ্যায় নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। রানা ভাই বা তালহা কেউ সফিক ভাইয়ের সাথে দেখা করার কথাটি মনেও করলো না। আমিও ভুলে গেলাম। রাত চলে যায়। ভোর নামে। আকামে সূর্য ঢু মারে। আমিও ফেসবুকে ঢু মারি। ভাবি ফেসবুকে কোনো নিউজ তথ্য পাওয়া যায় কিনা। মোবাইলের নেট কানেকশন দিতেই চমকে উঠি। বিশ্বাস করতে পারছি না। অনেক সময় ফেসবুক বাজে তথ্য শেয়ার করে অনেকে। এ যেমন কোয়ারেন্টাইনকে মানুষ ভেবে বসেছে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। অথচ এটি শুধুমাত্র একটি পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়া। বাধ্য হয়ে ফেসবুকে আরেকটু সময় দিই। না অনেক বিশ্বস্থ সূত্রও একই তথ্য জানান দিচ্ছে। চাঁদপুর পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান সফিকুর রহমান ভূঁইয়া আর নেই। বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো।
খবরটি শুনে আমি শোয়া থেকে উঠতে পারলাম না। সহকর্মী নিউজ২৪ এর সাংবাদিক খোকন দাদা কে ফোন করে সফিক ভাইয়ের মৃত্যুর খবর দিই। বলি ভাই আমিতো শোয়া থেকেই উঠতে পারছি না। আপনি গিয়ে কিছু কাজ করে নিয়ে আসনে। দাদা ঠিক আছে বলে ছুটে গেলেন। আমার শরীর যেন বিছানা ছাড়তে চাচ্ছে না। কি এক মায়া আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। কি এক বিষাদ আমায় তরল করে রাখে। ভেতরটা হুহু করে উঠে। চোখের জল নামতে চায় কিন্তু পারে না। আমার কানে শুধু বারবার প্রতিধ্বনি হয় ‘পলাশ সন্ধ্যায় বাসায় এসে দেখা করিস’। দুঃখিত সফিক ভাই। আপনার সাথে শেষ দেখা করতে পারিনি বলে। আজকাল খুব পরিচিত বা আপন মানুষগুলো হুট হাট করে চলে যাচ্ছে। পনের ঘন্টার ব্যবধানে না ফেরার দেশে চেলে গেলেন চাঁদপুরের দুইজন বিজ্ঞ রাজনৈতিক।বুধবার বিকেলে চলে গেলেন মতলব দক্ষিণ উপজেলা পরিষদের চেয়াম্যান উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা গিয়াসউদ্দীন ভাই। দেখা হলেই চওড়া হাসি দিয়ে বলতেন ক্যামন আছ ভাই? দিনদিন নিখাদ ¯েœহ থেকে বঞ্চিত হচ্ছি আমি। কারণটা হচ্ছে, সবশেষ এক দিকেই ছুটছি আমরা সবাই। তারপরেও আগে চলে যাওয়া শ্রদ্ধা আর প্রিয় মানুষগুলো ভালো থাকুক ওপাড়ে। ওপাড়ে ভালো থাকুক সফিক ভাই, ভালো থাকুন গিয়াস ভাই…