‘প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত মেহারন দালাল বাড়ি। বাড়িতে ৬৩০টি পরিবারে প্রায় সাত হাজার লোকের বসবাস। সবাই সনাতন ধর্মের অনুসারী। বাসিন্দারা পেশায় জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ী। বিয়ে-সাদি বেশির ভাগই হয় নিজেদের মধ্যে। বাড়িতে ভোটার ৪হাজর। এ বাড়ির ভোটে নির্বাচিত হয় ওয়ার্ড মেম্বার। নির্বাচনে ঝুলে থাকে চেয়ারম্যানের ভাগ্য।’
বিল্লাল ঢালী:
একটি বাড়িতে সাত হাজার মানুষ বসবাস করে। ৩৬০টি পরিবার। একটি গ্রাম। মূলত একটি ওয়ার্ড। বিশ্বাস হচ্ছে না?কিন্তু বিশ্বাস যে আপনাকে করতেই হবে। সরকারি হিসেবে ওই বাড়িতে মোট মোট ভোটার ৩হাজার ৯শ ৪৩জন। বাকীরা শিশু ও কিশোর। বাড়িটির অবস্থান হচ্ছে মতলব দক্ষিণ উপজেলার ২নং নায়েরগাঁও ইউয়িনে। এ বাড়িটির নাম মেহারন দালাল বাড়ি। গ্রামের নাম মেহারন। ওয়ার্ড নম্বর ৯। বাড়িটিতে রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় উপাসনালয়, বাজার, দোকানপাঠ ইত্যাদি। অথচ এখানে নেই নেই মারামারি, হানাহানি কিংবা ঝগড়া। এবাড়ির কেউ এখনো কোনো মামলার বাদি বা আসামী হওয়ারও খবরও পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ একটি বাড়িই যেন একটি পৃথিবী।
কালেরবিবর্তনের সাথে সাথে আমাদের হচ্ছে পরিবর্তন। যৌথ পরিবার ভেঙ্গে তৈরি হচ্ছে ছোট ছোট পরিবার। দিন দিন কমে যাচ্ছে পরিবার আত্মীয়-স্বজন সবার প্রতি মায়া-মমতা। আধুনিক যুগে ব্যতিক্রম ইতিহাস সৃষ্টি করেছে মেহারন দালাল বাড়ি। বাড়িটিতে সাত হাজার লোকের বসবাস। সবাই মিলেমিশে যেন একটি পরিবার। কারো সাথে কারো নেই সামান্যতম ঝগড়াঝাঁটি। সামাজিক উৎসব আনন্দ দুঃখ পুরো বাড়িটির মানুষ একসাথে ভাগ করে নিচ্ছে। আমরা জানি অধিক মানুষ অধিক মতামত। পরে মতামত থেকে সৃষ্টি মতানৈক্য। অল্প জায়গায় অধিক সংখ্যক লোক মতের মিল থাকলে বসবাস করা যায় তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ যেন মেহরান দালাল বাড়ি। সময়ের সাথে বাড়িটি রূপান্তরিত হয়েছে একটি গ্রামে পরে রূপ ধারণ করেছে একটি ইউনিয়নের ওয়ার্ড হিসেবে।
বিরল এ বাড়িটি চাঁদপুর জেলার মতলব দক্ষিণ উপজেলার ২নং নায়েরগাঁও দক্ষিণ ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ড যা মেহারন দালাল বাড়ি নামে সবার কাছে পরিচিত। বাড়িটি নারায়নপুর ইউনিয়ন পরিষদ থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। বাড়ির চারপাশ ঘিরে ফসলি জমি বা বিল। ৫ থেকে ৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি বিলের মাঝখানে অবস্থিত বাড়িটি। কাছাকাছি নেই অন্য কোন বসতি। বর্ষায় বাড়ির চারপাশ পানিতে টইটুম্বুর থাকে। এই বাড়িতে যাওয়ার জন্য পূর্বে নৌকা ছিলো একমাত্র বাহন। এখন কাজিয়ারা বাজার থেকে একটি আধা পাঁকা রাস্তা আছে বাড়িতে যাওয়ার জন্য। নায়েরগাঁও বাজার থেকে পায়ে হেঁটে, রিকশা কিংবা অটো বাইকেও যাওয়া যায়। বাড়িতে প্রবেশের জন্য পূর্ব ও উত্তর দিক দিয়ে রয়েছে দু’টি মাটির রাস্তা ।
বাড়িটির নামকরণ ইতিহাস সম্পর্কে বাড়িতে বসবাসরত বয়োজ্যেষ্ঠরা তেমন কিছু জানেন না। শুধু জানেন একসময় এখানে জমিদার বংশের লোক বসবাস করত। তাদের আশ্রয়ে সৃষ্টি হয় বাড়িটি। জমিদারদের দো’তলা দুটি ভবন এখনও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটিতে। একটি ভবনের নাম দ্বারকাপুরি ও অপরটির নাম আম্বিকা ভবন। ভবনগুলো যথাক্রমে নির্মাণ করা হয় ১৩৩৫ ও ১৩৪৪ বঙ্গাব্দে। জমিদারদের বংশধর দীপক দালালের মা বলেন দেড়’শ বছর আগে দ্বারিকানাথ দালাল, ও তার আত্মীয়-স্বজন পশ্চিম বঙ্গ থেকে এখানে আসেন। এখানে তারা দীর্ঘদিন ব্যবসা বাণিজ্য করেন। এখন আর জমিদারি নেই। ব্যবসা-বাণিজ্যও নেই।
প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এই বাড়ি। বাড়িটিতে ৬৩০ টি পরিবারে প্রায় সাত হাজার লোকের বসবাস। সবাই সনাতন ধর্মের অনুসারী। বাসিন্দারা পেশায় জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ী। বিয়ে-শাদি বেশির ভাগই হয় নিজেদের মধ্যে। বাড়িতে ভোটার সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার ৫’শ। বাড়ির ভোটারদের থেকে নির্বাচিত হয় ওয়ার্ড মেম্বার। নির্বাচনে ঝুলে থাকে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের ভাগ্য।
বাড়িতে চলাচলের রাস্তা খুব সরু। একটি ঘরের সাথে আরেকটি ঘর। মনে হবে কোন এক বস্তি । বাড়িতে বাইরের কেউ প্রবেশ করলে বেরোতে পারবে না। রাস্তা ভুলে যাবে। বাড়িতে রাস্তা চেনার একটাই উপায় তাহলো সিমেন্ট ঢালাই করা সরু অংশ। তাও কোথাও কোথাও কিছু অংশ মাটিতে মিশে গেছে। প্রয়োজনীয় সবকিছুর দোকান বাড়ির ভেতরেই রয়েছে। শুধুমাত্র ডাক্তার দেখাতে এবং জামা-কাপড় কিনতে যেতে হয় বাড়ির বাহিরে। বাড়িতে অবস্থিত দোকানগুলো নজর কাড়বে সবার। ঘরের মধ্যেই সামান্যতম জায়গা ব্যবহার করে বানানো হয়েছে দোকান। মাছ ও কাঁচা বাজারের জন্য প্রতিদিন সকালবেলা বাড়ির সামনে বসে বউবাজার। সেখান থেকেই পুরো বাড়ির লোকজন কেনাকাটা করে। প্রতিটি ঘরে ব্যবহারের জন্য রয়েছে স্যানিটারি টয়লেট। পুরো বাড়িতে বিশুদ্ধ খাবার পানির জন্য টিউবয়েল রয়েছে ৫০ থেকে ৬০ টি। বাড়ির বাচ্চাদের পড়াশোনার জন্য রয়েছে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। যেখানে বাড়ির ৬০ ভাগ শিশু পড়াশোনা করে। উপাসনার জন্য বাড়িতে রয়েছে ৮টি মন্দির। এছাড়াও ১টি স্বর্ণের দোকান, ৪টি সেলুন, ২টি ফার্নিচারের দোকান, ১টি মোবাইল সরঞ্জাম ক্রয়-বিক্রয়ের দোকান রয়েছে বাড়িটিতে।
এই বাড়িতে বসবাসকারী মেহারন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গৌতম দাস বলেন, আমাদের কয়েক পুরুষ ধরে আমরা এই বাড়িতে বসবাস করছি। আমাদের মাঝে কোনো ঝগড়া-বিবাদ নেই। আনন্দ উৎসবের দিনগুলি আমরা একসাথে পালন করি। দুঃখের দিনে পাশে থাকে একে অপরের। বাড়ির ঘরগুলো এমনভাবে তোলা, কোথাও এক ঘরের মূল দরজার সামনেই আরেক ঘরের বেড়া। অধিকাংশ ঘর টিনের। রাস্তগুলো সরু। বৃষ্টি হলে দূর্ভোগে মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। বাড়িতে কোন ড্রেনেজ ব্যবস্থা নেই। সাথে নেই কোনো স্বাস্থ্য ক্লিনিক।
দীর্ঘ ২২ বছর যাবৎ বাড়ির লোকজনের ভোটে নির্বাচিত ওয়ার্ড মেম্বার উত্তম কুমার দাস। বাড়িটি সম্পর্কে তিনি জানান, বাড়িতে প্রায় সাত হাজার লোকের বসবাস। সবাই নিম্নবিত্ত। এখন দিন দিন বাড়ির লোকদের অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। গ্রাম ছেড়ে কিছু কিছু লোক শহরে যাচ্ছে। পড়াশোনা করছে। বাড়িতে কোন বিচার সালিশ করতে হয়না। সবাই মিলে মিশে থাকি। আমাকে কোথাও ভোট খুঁজতে যেতে হয় না। বাড়ির লোকজন আমাকে ভোট দেয় আমি মেম্বার নির্বাচিত হই। বাড়ির সবাই নিম্নবিত্ত হওয়ায় সরকারি যে সহায়তা পাই তা সবার মাঝে বিতরণ করি। বাড়িতে সব কিছুই আছে। শুধু প্রয়োজন আমাদের একটি রাস্তা ও একটি স্বাস্থ্য ক্লিনিক। বাড়িতে আসার জন্য একটি আধা পাকা রাস্তা আছে। রাস্তাটির অবস্থা খুব করুণ। বারবার আবেদন করছি রাস্তাটি মেরামতের জন্য। কিন্তু বরাদ্দ পাচ্ছিনা। আমরা সবাই একই ধর্মের অনুসারী। পূজা পার্বণে, আনন্দ উৎসবে, দুঃখ কষ্টে আমরা সবাই মিলেমিশে একসাথে থাকি। কালের পরিক্রমায় লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় আমরা একটি বাড়ি থেকে একটি গ্রামে রূপান্তরিত হয়েছি। গ্রাম থেকে রূপান্তরিত হয়েছে একটি ইউনিয়নের ওয়ার্ড।