কাদের পলাশ:
২০০৩ সাল। আমি তখন কুয়েতে অবস্থানরত রেমিটেন্স যোদ্ধা। সে সময় প্রবাসে খুব অল্প মানুষ মুঠোফোন ব্যবহার করে। আমি সখের বসে নকিয়া-২৬০০ মডেলের একটি মোবাইল কিনি। সখ বলে কথা। কাজের ফাঁকে ফ্রি সময়ে স্নেকস (সাপ) খেলতাম। বর্তমান সময়ে মোবাইলের যে কাজ তার ন্যূনতম কাজেও তখন হতো না। সর্বোচ্চ মানুষ অর্থাৎ আত্মীয়-স্বজনরা মিসকল দিতো। পরে ফোনের দোকানে গিয়ে কথা বলা হতো। কারণ নেটওয়ার্ক কোম্পনীগুলো তখন মিনিটে প্রচুর টাকা কাটতো। আমি মুঠোফোন কিনেছি সখ করে। কিন্তু মাসখানেক পর সখ খুব বিরক্তির কারণ হয়ে উঠে। কারণ একমাসে একটিও কল আসেনি। একপর্যায়ে মোবাইলটি বিক্রি করে দেই। তখনো চিঠি লেখা ও ক্যাসেটে রেকর্ড করে খোঁজখবর দেয়ার প্রথা প্রচলিত ছিলো। তো মুঠোফোনের চেয়ে ওই চিঠি আর ক্যাসেট প্রথাতে আমি আশ্রয় নেই। তারপর ২০০৭ সালে দেশে এসে সাংবাদিকতায় জড়িয়ে যাই। তাও একই অর্থাৎ নকিয়া-২৬০০ মডেলের মোবাইল ব্যবহার করি। আত্মীয় স্বজন ছাড়া আর কারো সাথে খুব বেশি কথা বলা হতো না। একময় কলের পর কল। বিষয়টি অনজয়ও করতাম। কিন্তু গত প্রায় এক দশকে মুঠোফোনে এতো এতো কল রিসিভ করতে হয় যে বিরক্ত না হয়ে উপায় নেই। কিন্তু নিউজের তথ্যের খাতিরে সব সয়ে যাই। কারণ সাংবাদিকতার ১৪ বছরে অন্তত ৭হাজার ভিজিটিং কার্ড মানুষকে দিয়েছি। মানুষ প্রয়োজনে অপ্রয়োজন, খোঁজখবর নিতে, কেউ বা তথ্য দিতে অনেকেই তার সমস্যার কথা জানাতে ফোন করে। কারো সাথেই বিরক্ত হতে পারি না। এখন রিং টোন বেজে উঠলেই মগজে গিয়ে আঘাত করে। রিং টোন অর্থাৎ কলের চেয়ে কেউ যদি ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে ম্যাসেজ দেয় খুশি হই। কারণ কাজের খাতিরে হলেও অফিসিয়াল গ্রুপ ম্যাসেঞ্জারের কারণে কিছুক্ষণ পরপরই ফলো রাখতে হয়। মূল কথায় আসি। সম্প্রতি চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার (আরএমও) সুজাউদ্দৌলা রুবেল ভাই একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। স্ট্যাটাসটি হলো ‘সদর হাসপাতালে আজকের স্যাম্পল কালেকশন করলাম ৪৫৫ টা। তারপরেও কারো ফোন ধরতে না পারলে যদি কেউ আজে বাজে স্ট্যাটাস দেয় তাহলে কাজ করার মানসিকতা কমে যায়….’ রুবেল ভাই কল ধরবেন অথবা ধরবেন না এটা তার একান্ত নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু বড় দায়িত্বে থাকলে কল এড়ানো কঠিন। নিশ্চয় তিনি প্রতিদিন শ শ কল রিসিভ করেন। এছাড়া করোনাকালীন সময়ে রুবেল ভাইয়ের চাঁদপুরবাসীর প্রতি যে দায়িত্ববোধ তা অনস্বীকার্য। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি প্রতিদিন কাজ করে যাচ্ছেন। তার ঋণ কখনো অন্তত চাঁদপুরের মানুষ শোধ করতে পারবে না। কারণ চাঁদপুর সরকারি হাসপাতালে আরো অনেক ডাক্তার রয়েছেন। এ করোনাকালীন সময়ে তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে চাই না। তবে রুবেল ভাইয়ের দায়িত্ববোধ আমাকে ঋণী করে রেখেছে। শুধু আমাকে নয় চাঁদপুরের হাজার হাজার মানুষ তার সেবা পেয়েছে। একটি উদাহরণ দিলে ভালো হয়, আমি গত ২৫ জুলাই দিবাগত রাত সাড়ে ৩টায় সমস্যা বলে পরামর্শ চাইলাম। কল দিতে ইতস্ত হওয়ায় ম্যাসেঞ্জারে সমস্যাটি বলে পরামর্শ নিয়েছি। তিনি প্রেসক্রাইব করলেন সে মোতাবেক আমার ছোট মামার চিকিৎসা চলছে। আমার ঋণ শোধ করার সাধ্য আমি দেখছি না। একজন চিকিৎসক কতোটা আন্তরিক ও দায়িত্ববান হলে রাত সাড়ে ৩টায় বিরক্ত না হয়ে পরামর্শ দিতে পারে। আর সে মানুষ কল না ধরায় যদি অপবাদ নিতে হয় তা সত্যিই দুঃখজনক। আমি ব্যক্তিগতভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি। রুবেল ভাই আপনি কষ্ট পাবেন না। কারণ কোনো না কোনো কারণে কেউ না কেউ কষ্ট পেতেই পারে। পৃথিবীর সকল মানুষের মন জয় করে চলা কারো পক্ষেই সম্ভব না। আপনার পক্ষেও সম্ভব না। কারো সমালোচনায় বিচলিত হবেন না কারণ আপনি কাজ করেন বলেই হয়তো কেউ কেউ অভিযোগ তোলে। অথচ অনেক ডাক্তারের নামও মানুষ জানে না। তাকে নিয়ে সমালোচনা কী করবে?
আমার একটা বদ অভ্যাস আছে। আমার কাছের বা আপন কেউ যদি বড় পদে বা উচ্চ পদস্থ হয় তবে আমি তার কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখি। কারণ তাঁর পদমর্যাদা হয়তো আমার স্ট্যাটাসের সাথে যায় না। আর সহজ কথায় বললে, পদের কারণে দায়িত্ব বেড়ে যাওয়াও স্বাভাবিক। তাঁর ব্যস্ততা বাড়বে তা নিতান্তই সত্য। এ কারণে আমি আমার দূরত্ব বজায় রাখি। যে কারণে তার সাথে আমার দূরত্বও বাড়তে থাকে। কারণ চোখের আড়াল তো মনের আড়াল। তবে ইচ্ছে করলে ফোন করে তো কথা বলা যায়। প্রয়োজন বা পরামর্শ নেয়া যায়। কিন্তুতাতেও আমি সংকোচ বোধ করি। কারণ কাছের, আপন বা প্রিয় মানুষ যদি কলটি রিসিভ না করে স্বভাবতই মনে কষ্ট পেতে পারি। একারণে কল করি না। প্রয়োজন বোধে বিকল্প পদ্ধতিতে সমস্যা নিরসনে পদক্ষেপ নেই। তবুও কাছের মানুষটি দূরে থাকলেও মনের ভেতর থাকুক। বুকের ভেতর প্রিয়জনের জিকির চলুক।