শুয়ে থেকেই বৃষ্টির শব্দ শুনতে পেল সুবল ডাক্তার। টিনের চালে র্ঝর্ঝ করে পড়ছে বৃষ্টির ফোঁটা। শব্দ শুনে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে বৃষ্টির তাণ্ডব আগের মতো নেই, কমে এসেছে। তবুও সুবল ডাক্তারের মন খারাপ হয়ে গেল এই সাঁঝ ভোরে। সে মালসী কাঁথাটা আরেকটু বাড়িয়ে কোড়ামুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকলো। বৃষ্টির সাথে বাইরে শা-শা করে বাতাস বইছে। তীব্র শীত অনুভব করছে এই মুহূর্তে সুবল ডাক্তার।
আজ নিয়ে টানা তিনদিন ধরে ঝরছে এই বৃষ্টি। কোথাও বেরুবার জো নেই এতোটুকু। সুবল ডাক্তারের তো ক্ষেতগেরস্তি নেই, হাঁটার মাঝেই তার রুজি। অথচ সেই রুজিই তার বন্ধ হয়ে আছে। তার বিশ^াস ছিল আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে সে আর এই বিরক্তিকর বৃষ্টির শব্দ শুনবে না। কিন্তু তাই শুনতে হলো এখন। মন খারাপ না হয়ে আর উপায় কী!
নেহায়েত গরিব মানুষের ডাক্তার সুবল। নিজেও গরিবার্থ, ভাগ্যের সন্ধানে এই তল্লাটে এসেছিলো আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগে। উঠেছিলো নিজের এক আত্মীয়ের বাড়ি। সম্পর্কে এই আত্মীয়টি ছিল সুবলের মামা। হোমিওপ্যাথ ডাক্তারি করতেন। তিনিই সুবলকে এই লাইনে আনেন। হোমিওপ্যাথি দিয়ে শুরু করলেও ধীরে ধীরে এলোপ্যাথিতেও ভালো নাম করে। এলাকার গরিব মানুষগুলোর কাছে এখন বলতে গেলে সুবল হলো দেবতা। এক টাকা, পাঁচ টাকা, পঞ্চাশ টাকা যাই নিয়ে আসুক না কেনো সুবল কাউকে ফিরাবে না। টাকা কম হলে প্রথমে কিছুটা বকাঝকা করবে কিন্তু ঔষধটি পরে ঠিকই হাতে ধরিয়ে দিবে।
‘যা এগুলো দিলাম। কাল এসে পয়সাগুলো দিয়ে যাবা মনে করে।’
‘আচ্ছা ডাক্তারবাবু’।
বলে তারা একসময় বিদেয় হবে ডিসপেনসারি নামক ক্ষুদ্র খুপরী থেকে।
না, পয়সাপাতি সবসময় দিতে পারে না সবাই। কেউ চাল, কেউ ডাল, লাউ-কুমড়ো এমনকি বেচা-বিক্রির জন্যে ধরে আনা খুচরো মাছ পর্যন্ত ধরিয়ে দেয় সুবল ডাক্তারের হাতে। গ্রাম থেকে ফেরার পথে এসব নিয়েই ঘরে ফিরে সুবল। সবমিলিয়ে একরকম খারাপ যাচ্ছিল না সুবল ডাক্তারের দিনকাল। কিন্তু এবারেই যেন বড় বাখড়া হয়ে দাঁড়ালো তার ভাগ্য। বৃষ্টি-বন্যা দিয়ে বছর শুরু। উপোস করিয়ে ছাড়বে কিনা কে জানে।
শুয়ে থেকেই সুবল ডাক্তার শুনতে পেলো তার স্ত্রী গীতারানী বিছানা ছেড়েছে। তিরিক্ষি মেজাজ নিয়েই যে উঠেছে তাও বুঝতে পারল পরিষ্কার। প্রথম ঝাপটা গেল ছেলে-মেয়েদের ওপর দিয়ে।
এই উঠস্ নাই। পড়তে বসবি না। বাপের মতো সবাই পড়ে পড়ে ঘুমুবি? জমিদার হয়েছো না?
তিন মেয়ে, এক ছেলে সুবলের। সবাই ছোট। বড় দুটো মেয়ে তারপর ছেলে, তারপর আবার মেয়ে। বড় মেয়ে দুটো এবং ছেলে স্কুলে যায়। টানটানির সংসার। ছেলে-মেয়েদের প্রতি তেমন একটা নজর দিতে পারে না সুবল। তার ওপর আজ নিয়ে তিনদিন বৃষ্টির কারণে একটানা রোজগার বন্ধ। ওইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে এবং স্ত্রী গীতা রানীর মেজাজের কথা চিন্তা করে সুবল ডাক্তারের মনে হলো তার আর শুয়ে থাকা উচিত না। উঠা দরকার। আড়মোড়া ভেঙে ওঠে পড়লো সুবল ডাক্তার।
দো-চালা টিনের ঘর। মুলির বেড়া। ঘুণেধরা পুরনো কাঠের দরোজা খুলে বাইরে আসতেই শো-শো করে বাতাস ঠেসে ধরে। সাথে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির আঁচড়। তারপরও সুবল ডাক্তার কতক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলো বারান্দায়। পুবদিকে নজর ফেরাতেই চোখে পড়ল সুবিশাল কাউয়াদিঘি হাওর। শুকনো মৌসুমে কাউয়াদিঘী হাওরের বুকে অনেক হেঁটেছে সুবল। গিয়েছে দূরবর্তী গ্রাম সোনাকান্দি। সোনাকান্দি এখন জলে ভাসছে, জার্মানি ফেনার মতো। কাউয়াদিঘি এখন প্রমত্তা, পদ্মা-মেঘনার মতো। বড় বড় ঢেউ উঠছে-নামছে। গতকালই কারা যেন ওয়াপদার বাঁধ কেটে দিয়েছে। সেই সুবাদে হাওড়-কাউয়াদিঘি এখন সংহারমূর্তি ধারণ করেছে। সে ভাসিয়ে দেবে, ডুবিয়ে দেবেÑকেবল সোনাকান্দি গ্রামের মানুষগুলোকেই নয়, আশপাশের গ্রামের মানুষদেরও। ভয় সুবল ডাক্তারেরও আছে। ঢেউ আছড়ে পড়তে পারে তার ভিটেতেও।
সুবল ডাক্তার ঘরের ভেতর যায়। ছাঁই দিয়ে দাঁত ঘষে। হাতমুখ ধুয়ে স্নানকার্য সম্পন্ন করে তড়িৎ। তারপর নাকেমুখে চারটে পানতা গুঁজে সোজা চলে যায় মোড়ের ডিসপেনসারিতে। আজ আর বৃষ্টি-বাদল মানবে না সে। যেভাবেই হোক গাঁয়ে যাবে। ছেলে-মেয়েদের উপোস দেয়া যাবে না।
কিন্তু ডিসপেনসারি খুলতেই মন খারাপ হয়ে যায় সুবল ডাক্তারের। পাশের রসুলপুর গ্রামের আঁতরজান বুড়ি এসে হাজির। ‘ও বাবা আমার সাথে একটুখান চলনারে বাবা। আমার জামাইডারে বাঁচারে বাবা’।
বুড়ি কাঁদতে থাকে প্যাঁচ-প্যাঁচ করে। কাঁদে আর সাদা-ছেঁড়া ময়লা কাপড়ে নাক মুছে। এমনিতেই বুড়ি ভিজে জ্যাবজ্যাবে। একটি আধা পুরনো পলিথিন মাথায় চড়িয়ে এসেছে। সাথে ৭/৮ বছরের নাতি।
বালাগঞ্জ হয়ে বারইকান্দি গ্রামে যেমন সুবল ডাক্তার এসেছে সুদূর বরিশাল জেলা থেকে, তেমনি আশপাশের রসুলপুর, মুক্তারপুর গ্রামের বেশিরভাগ মানুষজন এসেছে সুদূর ময়মনসিংহ জেলা থেকে। এলাকাটি এককালে ছিলো ঝোঁপ-জঙ্গলে ভরা। বাইরের লোকজন ঝোঁপঝাড় পরিষ্কার করে এখন এখানে বসবাস করছে।
স্থানীয় লোকজন তাই নতুনভাবে বসবাস করা বাইরের লোকজনদের বলে ‘আবাদী’। বর্ষার সময় এদের অধিকাংশ মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। শুকনো মৌসুমে মাটি কাটার কাজসহ অন্য টুকটাক কাজ করে চলে এরা। শুকনো মৌসুমের শেষের দিকে বোশেখ মাসে বোরো ধান উঠলে কিছুটা সচ্ছল জীবন থাকে এদের। সেই সাথে সুবল ডাক্তারেরও। কিন্তু অনেক সময়ই ওই ফসল উঠে না। বান-ভাসিতে নষ্ট হয়ে যায়। বিশেষ করে ওয়াপদার বাঁধ যে বছর কেটে দেয়া হয় বা ভেঙে যায় সে বছর আর দুর্গতির সীমা থাকে না গ্রামবাসীর। এবার তেমনি এক বছর। সামনে দুর্দিন হা করে আছে বুঝতে পারে সুবল।
নিজের ভাগ্যের কথা চিন্তা করে কিছুটা আনমনা হয়ে গিয়েছিলো সুবল ডাক্তার। এদিকে বুড়ি কেঁদেই চলেছে। সুবল ডাক্তার খিঁচিয়ে উঠলো।
ও বুড়ি, ট্যাহা-পয়সা কিছু আনছো?
নারে বাবা না। তয়…
বাকি কথা পুরো করতে পারেনি বুড়ি। সুবল ডাক্তার ধমকে ওঠে।
‘তা আনবা কেনো? আমিতো হাওয়া খাইয়া বাঁচি। ক্যান আমার পেট-পিঠ নাই, মেয়ে-ছাওয়াল নাই? আমাগো কারোরই ভাত খাওন লাগে না? আইছি তোমগো সেবা করতে। সেবা করলেই পেট ভরবে।’
তুমি আমার লগে আও বাবা। আমার জামাইরে বাঁচাও। আমি তুমারে টেকা দিমু। ভিক্ষা কইরা হইলেও দিমু।
বুড়ি একগাদা বলেই চলেছে। সুবল ডাক্তার সেসব আর শুনলো না। ব্যাগ গুছিয়ে দোকানের ঝাপ বন্ধ করলো।
‘আর প্যাঁচ-প্যাঁচ করিস না বুড়ি, চল্’ বলেই রওনা দিলো।
কাঁদায় থিক্থিক্ করা রাস্তায় হাঁটা যায় না। ওদিকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি এখনো হচ্ছে। বাতাসও আছে একটু-আধটু। অনেক লোক আবার রাস্তায় ঠাঁই নিয়েছে। অস্থায়ী ঘরদোর তুলে গরু-ছাগল ধান-পাটসহ পুরো পরিবার নিয়ে গাজাগাজি করে আছে। এদের বেশিরভাগই সোনাকান্দি গ্রামের মানুষ। বড় কষ্ট মানুষজনদের। এদের অনেকেই সালাম-আদাব দিচ্ছে ডাক্তারকে। সুবল ডাক্তারও ভালোমন্দ দু-চার কথা বলছে। এভাবেই কোনোরকমে নিজেকে ঠেলে-ঠুলে এসে উপস্থিত হলো বুড়ির বাড়ি।
বাড়ি না বলে একে বস্তি বলাই ভালো। একহারা লম্বা ভিটির কয়েকটি ঘর-উদোম অথবা সাপটানো। ঘরগুলোর বেশিরভাগই খড়নাড়া দিয়ে তৈরি। মাটি দিয়ে লেপটানো বেড়া। এরই একটি ঘরে সুবল ডাক্তারকে নিয়ে ঢুকে বুড়ি।
ভেতরে ঢুকেতো সুবল ডাক্তারের চোখ চানাবড়া। একটা লোক কুঁজো হয়ে বসে এপাশ-ওপাশ করছে। হারগিলে শরীর। চোখ ঠিকরানো। দম নিতে কষ্ট হচ্ছে। গা দিয়ে দরদর করে ঘাম বেয়ে পড়ছে। একটি মেয়ে পাখা দিয়ে বাতাস করছে তবু ঘাম বন্ধ হচ্ছে না। সুবল ডাক্তার তাড়াতাড়ি ব্যাগ খুলে বুকে স্টেথিস্কপ্ চেপে ধরলো লোকটির বুকে-পিঠে।
‘হ্যাঁ, যা ভেবেছিলাম, তাই। শক্ত নিমোনিয়া বাঁধিয়ে বসে আছে। রোগী বাঁচাতে হলে এক্ষুণি হাসপাতালে নিতে হতে। দ্বিতীয় কোনো বিকল্প নেই।’ সাফ জানিয়ে দিলো সুবল ডাক্তার।
লাগাতার বৃষ্টির প্রথম রাতে ওয়াপদার খালে মাছ ধরতে গিয়েছিলো ময়না মিয়া। ভোরে জ¦র নিয়ে ঘরে ফিরে। সেই থেকেই বিছানায় শুয়ে। পয়সার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারেনি সময়মতো। ঘরে ৭ জনের পরিবার। একমাত্র রুজিদার ব্যক্তি ঘরে পড়ে থাকলে অন্যরা কী করবে? তাদেরতো ভাতই জুটছে না। এ অবস্থায় ময়না মিয়াকে হাসপাতালে নিবে কীভাবে? বুড়ি একগুচ্ছ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে ডাক্তারের দিকে তাকায়।
‘আমার করণীয় সীমা পার হয়ে গেছে মা। আমাকে মাপ করে দাও’। ব্যাগ গোছাতে গোছাতে ঠাণ্ডা গলায় জবাব দিলো সুবল।
সুবল ডাক্তার রাস্তায় এসে দাঁড়ালো। হাঁটতে থাকলো ধীর লয়ে। রাস্তার অবস্থা দেখে সুবল ডাক্তারের মনে হলো বৃষ্টি যেন ধরে এসেছিলো এর মধ্যে কিছুটা। সুবল ডাক্তার আকাশের দিকে তাকালো। নাহ্, আজই বৃষ্টি থেমে যাবে এমনটা মনে হলো না তার। উত্তর আকাশে এখনও গাঢ়-কালো মেঘ, জমাট বেঁধে উপরে উঠছে। এই মেঘ যে কোনো সময় আছড়ে পড়তে পারে। তছনছ করে দিতে পারে আরো অনেক কিছু।
সুবল ডাক্তার তার হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয়।
আজ,
বুধবার , ৪ অক্টোবর, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ , ১৯ আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম:
প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।