মো. আনোয়ার হাবিব কাজল:
প্রতি বছর জুন মাসের তৃতীয় রবিবারকে বাবা দিবস হিসাবে পালন করা হয়। মা দিবস নিয়ে যতটা মাতামাতি হয়ে থাকে বাবা দিবস ততটা গুরুত্বসহকারে পালন করা হয় না। কিন্তু আমার কাছে মা-বাবা উভয়ের গুরুত্বই সমান। আজ ২০ জুন। মাসের তৃতীয় রোববার। বিশ^ বাবা দিবস। সারা পৃথিবী জুড়ে পরম ভালবাসায় সন্তানরা পালন করবে এ দিনটিকে। সব বাবারাই সন্তানদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়, ভাল ও অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে স্বীকৃত। আমরা প্রতিনিয়ত বলে থাকি প্রতিটি মানুষের জীবনে কাজে-কর্মে ও আচার-আচরণে পারিবারিক শিক্ষার প্রভাব পড়ে থাকে সবচেয়ে বেশী। পারিবারিক শিক্ষা বলতে আমরা মূলত বাবা-মায়ের কাছ থেকে পাওয়া নীতি, নৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধের শিক্ষাকেই বুঝি। আজ ১ বছর ১ মাস ১ দিন হতে চলল। মাত্র ৯ ঘন্টার ব্যবধানে আমি আমার বাবা-মা দুজনকে হারিয়েছি। গতবছর ১৯ মে করোনার প্রথম আঘাতে আমাদের গোটা পরিবারকে স্তম্ভিত করে দিয়ে সন্ধ্যায় প্রথমে মা রাবেয়া বেগম ও তাকে মাটি দিয়ে আসার পরপরই ভোর রাতে বাবা মজিবুর রহমান পাটোয়ারী না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। আজ বিশ^ বাবা দিবসে আমার জীবন চলার পথে অন্যতম অনুস্মরণীয় আদর্শ আমার বাবার স্মুতি খুবই মনে পড়ে। আমার বাবা আমার জীবনে দেখা একজন সৎ, নির্লোভ, নিরহংকার, সহজ-সরল ও সাদা মনের মানুষ ছিলেন। যে ধরনের মানুষকে এখনকার সমাজে টেলিভিশনে বিজ্ঞপন দিয়ে খুঁজতে দেখা যায়। তার সন্তান হিসেবে নয়, সমাজের অন্য দশজনের, প্রতিবেশীদের এমনকি চাঁদপুর জেলা শহরে যারা তাকে ‘পাটওয়ারী সাহেব’ হিসেবে চিনেন-জানেন ও তার সহকর্মীদের মূল্যায়নের ভিত্তিতেই এ কথা বলছি।
আমাদের সুশিক্ষায় মানুষ করতে গিয়ে কি অমানবিক পরিশ্রমটাই না তিনি করেছেন কিন্তু সততা ও আদর্শ থেকে এক চুলও বিচ্যূত হননি। তিনি এমন এক ডিপার্টমেন্টে (গণপূর্ত) চাকরি করেছেন যার নাম শুনলে অনেকে রীতিমত প্রশ্ন ছুড়ে দেন ঢাকায় তিনি কয়টা বাড়ি করেছেন। জীবনে সেসব কিছুইতো করেননি বরঞ্চ সাত সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ যোগাতে গিয়ে শহরের প্রাণকেন্দ্রে চাঁদপুর সরকারি কলেজের মাঠের দক্ষিণ পাশের গোল পোস্টের পিছনের ১৪ শতক জায়গা ধাপে ধাপে বিক্রি করেছেন।
কঠোর পরিশ্রম আর সততাই ছিল আমার বাবার জীবনের আদর্শ ও ব্রত। তাই সরকারি চাকুরির সীমিত বেতনের টাকা দিয়ে সংসার চালাতে প্রায়শঃই হিমশিম খেতেন তিনি। তারপরও স্বামীকে নীতিভ্রষ্ট হতে অনুপ্রানিত করেননি আমার পরম শ্রদ্ধেয় মা জননী। স্বামীর সততাই ছিল তার বড় অহংকার। প্রতি মাসের শেষের দিকে ছোট হয়ে আসত বাজারের ব্যাগ। আর তখন মা রাবেয়া বেগম তার বিচক্ষণতা আর বুদ্ধিমত্তা দিয়ে পার করে নিতেন মাসের বাকী দিনগুলো। তবুও কখনো ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার ব্যাপারে এতটুকু কমতি করেননি। বরং নিজের গলার হার বিক্রি করেও উৎসাহ যুগিয়েছেন সন্তানদের লেখাপড়ায়। ঋণ করে ছেলেমেয়েদের পড়ার খরচ জুগিয়েছেন। শেষের দিকে এসে বাবা জীবনের শেষ সম্বল পেনশনের টাকা পর্যন্ত ব্যয় করেছেন সন্তানদের উচ্চশিক্ষার জন্য। বাবা তুিম প্রায়ই বলতে টাকা পয়সা বাড়ি-গাড়ী আমি তোমাদের দিতে পারব না, তোমাদের শিক্ষিত করে দিয়ে যাব, এটাই আমার দর্শন।
বাবা তুমি প্রায়শই আমাদের লেখাপড়ায় উৎসাহ জোগাতে বলতে প্রয়োজনে গ্রামের বাড়ির জমিজমাও বিক্রি করে ফেলবো , তবুও তোমাদের লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে যাব। আমাদের উদ্দেশ্যে তুমি প্রায়ই বলতে, তোমরা আমাকে শুধু সাতটি গ্র্যজুয়েশন সার্টিফিকেট এনে দাও। তোমাদের কাছে আমার শুধু এই প্রত্যাশা। কে কি চাকরি করবে না ব্যবসা করবে তা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। বাবা তোমার প্রত্যাশা ছাপিয়ে আমরা তোমাকে চৌদ্দটি গ্র্যজুয়েশন সার্টিফিকেট উপহার দিয়েছি। তাই তুমি সবসময় আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে পরম তৃপ্তিতে বলতে যে, তোমার প্রতিটি সন্তান সৎ কর্ম করছে এবং সৎ উপার্জন দিয়ে জীবন নির্বাহ করছে। বাবা তোমার শিক্ষা ও আদর্শ হৃদয়ে লালন করেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। কারন, আমরাতো সততা ও আদর্শের সাথে আপোষহীন আমার বাবাকে দেখেছি নিম্নমানের কাজ করায় বা কাজে ফাঁকি দেয়ায় জেলার নাম করা ঠিকাদারদের কিভাবে কঠোর হস্তে তুমি শাসন করতে। জীবনে উৎকোচের বিনিময়ে কাজের মান বা গুনাগুনের সাথে তুমি কোনদিন সমঝোতা করোনি। তাইতো পুরো ডিপার্টমেন্টে তোমার সততার একটা সুনাম ছিল। অথচ মাসের ১৫ তারিখের পর তোমার আর বাজারে যাওয়ার সামর্থ্য থাকতো না। আমার মা’ই তার বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতা দিয়ে ধার দেনা করে বাকী মাসটা চালিয়ে নিতেন। এতে আমাদের কোন আক্ষেপ ছিল না বাবা। তবে আমার মাকে খুব বেগ পেতে হত। মাঝে সাঝে মা তোমার সততা নিয়ে উপহাস করতো।
আমার মনে আছে বাবা, মা একদিন আক্ষেপ করে তোমাকে বলেছিলেন, মানুষ সংসার করে অনেক কিছুই পায়, লক্ষ লক্ষ টাকার মালিক, ব্যাংক ব্যালেন্স ও গাড়ী বাড়ির মালিক হয় , ‘আর আমি কি পেয়েছি?’। সেদিন বাবা তুমি আমাদের চার ভাইকে দেখিয়ে মাকে জবাব দিয়েছিলে, এই হচ্ছে তোমার চারটি ব্যাংক ডিপোজিট (এফ ডি আর)। আজ শহরের চিত্রলেখার মোড়ের ‘গোল্ডেন প্লাজা’ তোমার সেদিনকার সে কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। তোমার সেদিনকার নিঃস্বার্থ ত্যাগের ফল হিসেবেই আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ‘গোল্ডেন প্লাজা’।
বাবা মনে পড়ে এরশাদ সরকারের আমলে যখন টেন্ডার বাক্স ছিনতাই এবং ঘূপচ্ িটেন্ডারের প্রচলন শুরু হয় তখন এসবের সাথে আপোষ করতে না পেরে বা মানিয়ে নিতে না পেরেই স্বেচ্ছায় অবসরে চলে আস তুমি। অথচ আমরা সাত ভাই-বোন একসাথে তখন বিশ^বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিভিন্ন স্তরে পড়াশুনা করছি। কি যে এক কঠিন সময় তোমাকে পাড় করতে দেখেছি। ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। কখনো মতলবের উদমদী চরের পাম্প হাউজের সুপারভিশন, কখনো হাইমচরের হাজীমারা সেচ প্রকল্পের সুপারভিশনে আবার কখনো চাঁদপুর সরকারি কলেজের কাজে বা আত্মীয় স্বজনদের কনস্ট্রাকশন তদারকিতে আবার কখনো রাত জেগে জেগে টেন্ডারের এনালাইসিস করতে করতে অনেক সময় মাঝ রাতে অসুস্থ হয়ে পড়েছো তুমি। তোমাকে নিয়ে হাসপাতাল ডাক্তার দৌড়াদৌড়ি সেসব ভাবলে মনের অজান্তে এখনও চোখের কোনে পানি এসে যায়।
বাবা তোমার দর্শন মিছে নয়। তুমিই আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছ সাময়িক কষ্ট হলেও, শত কষ্টের মধ্যে থেকেও জীবনে সৎ ভাবে চলা সম্ভব এবং সৎ উপার্জন দিয়েও জীবন সুন্দরভাবে নির্বাহ করা যায়। আজ তোমার ৭ ছেলেমেয়ের সবাই সততা ও আদর্শ নিয়ে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। তারা প্রত্যেকে এক একজন সম্পদে পরিণত হয়েছে। হয়তো বেপরোয়াভাবে অন্যায় পথে অগাধ বিত্ত বৈভবের মালিক আমরা হতে পারিনি। বাবা তোমার নিজের জীবনে বাড়ি গাড়ি কিছুই করতে পারনি বরঞ্চ, সন্তানদের লেখাপড়া করাতে গিয়ে খুইয়েছো অনেক সম্পত্তি, কিন্তু সন্তানরা এখন তোমাকে দুহাত ভরে সবকিছু দেয়ার সামর্থ্য রাখে। দেশে বিদেশে তোমার ছেলেমেয়ে নাতি নাতনীরা আজ সুনামের সঙ্গে কাজ করছে।
আজ এক বছর হয়ে গেল তোমার সাথে দেখা হয় না। এখনো আমি নিয়মিত ঢাকা থেকে চাঁদপুরে যাই, কিন্তু তোমার মত এমন ব্যাকুল হৃদয়ে কেউ আমার জন্য অপেক্ষা করে বাসার গলিতে পায়চারি করে না বা আসার সময় গেট অব্দি কেউ এগিয়ে দিয়ে রিক্সা উঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করে না। এখন আর শুক্রবারে সকালে মসজিদে যাওয়ার আগে তোমার মত রুমাল বাড়িয়ে দেয় না। বাবা সত্যিই তোমাকে ভীষণ মিস করি।
বাবা, তোমার অবদান আমরা সন্তানরা কোনদিন ভুলব না। তোমার এ আদর্শিক শিক্ষা, তোমার অবদান, ত্যাগ তিতিক্ষা ভুলার নয়। আমিও তোমার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সরকারি চাকরি না নিয়ে সৎপথে ভাল উপার্জনের আশায় বেসরকারি চাকরি বেছে নিয়েছি। যারা তোমাকে কাছ থেকে দেখেছে তারা তোমাকে ঠিকই মূল্যায়ন করেছে। তাইতো আত্মীয়-অনাত্মীয় সর্বমহলে তোমার একচ্ছত্র গ্রহণযোগ্যতা ও সুখ্যাতি ছিল। তারপরও দোয়া করি আলেমুল গায়েব বলে যদি কেউ থেকে থাকে তার দরবারে তোমার যথাযথ মূল্যায়ন হবে এবং তোমার কীর্তি ও অবদান চিরদিন সোনার হরফে লেখা থাকবে।