রিয়াজ শাওন
শান্তি শৃঙ্খলা নিরাপত্তা প্রগতি এই মন্ত্রকে হৃদয়ের গহীনে ধারণ করে দেশও জাতির সেবায় সবর্দা দায়িত্ব পালন করে আসছে বাংলাদেশ পুলিশ। দেশের আইন শৃঙ্খলাকে স্বাভাবিক রাখতে প্রতিটি মুহূর্তে নিরলসভাবে যুদ্ধ করে যাওয়া একদল যুদ্ধা হলেন এই বাহিনীর সদস্যরা।
বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা দেশের মানুষের বিপদে আপদে পাশে থেকে মানুষের আস্থার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কুড়িয়ে এনেছে দেশের মানুষের ভালোবাসা। স্থাপন করেছেন মানবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। দেশের একঝাঁক দেশপ্রমিক চৌকস পরিশ্রমী মেধাবী পুলিশ অফিসারাএই বাহিনীকে করেছে আলোকিতএবং উজ্জীবিত। তেমনই একজন দেশপ্রেমিক চৌকস পরিশ্রমী পুলিশ অফিসার হলেন হাজীগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সোহেল মাহমুদ (পিপিএম)। তিনি অদম্য সাহসিকতার জন্য ২০১৫ সালে অর্জন করেছেন র্যাবের সাহসিকতার পদক, ২০১৬ সালে পেয়েছেন পিপিএম পদক। ২০১৯ সালে পান আইজিপি ব্যাচ।মেধাবী এই পুলিশ অফিসার ইংরেজি সাহিত্যের উপর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মাস্টর্স অব পুলিশ সাইন্স ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ৩০তম বিবিএসের মাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে যোগদান করেন।
চাঁদপুর জেলায় তিনি দুই দুই বার দায়িত্ব পালন করেছেন। ফলে সাধারণ মানুষের আস্থার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছেন তিনি।বিপদে পড়া মানুষের বিশ্বাস ও ভরসার নির্ভরযোগ্য পথনির্দেশক। কর্মনিষ্ঠ এবং সৎ মানুষ হিসেবে কর্মক্ষেত্রে ব্যাপক প্রশংসা কুঁড়িয়েছেন। অসাধারণ ব্যক্তিত্ব এবং আন্তরিক ব্যবহারের মাধ্যমে সকল ধর্ম-বর্ণ শ্রেণী-পেশাকে হার মানিয়ে তার কর্ম এবং মোহনীয় গুণে জয় করে নিয়েছেন জেলার সব শ্রেণীর মানুষের মন। জায়গা করে নিয়েছেন সাধারণ মানুষের হৃদয়ের অন্তস্থলে। স্বচ্ছ মনের অধিকারী এই মানুষটি খোলামেলা কথা বলেছেন এ প্রতিবেদকের সাথে।
দৈনিক শপথ: কেমন আছেন?
সোহেল মাহমুদ: আলহামদুলিল্লাহ; আল্লাহর রহমতে ভালো আছি।
দৈনিক শপথ: আপনার পরিবার সম্পর্কে জানতে চাই ?
সোহেল মাহমুদ: আমার বাবা ২০০২ সালে মারা গেছেন। আলহামদুলিল্লাহ মা জীবিত আছেন। আমরা চার ভাই তিন বোন। সবাই চাকরি করছি। আমার স্ত্রী ৩৩তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে চাকুরি করছেন। আমার একটি সাড়ে পাঁচ বছরে কন্যা সন্তান আছে। আমার গ্রামের বাড়ি যশোর জেলার মনিরামপুর থানার মনোহরপুর ইউনিয়নের কোপালিয়া গ্রামে।
দৈনিক শপথ: পেশাগত জীবনের পাশাপাশি ব্যক্তিগত জীবনে করোনার প্রভাব কেমন পড়ছে?
সোহেল মাহমুদ: আসলে ব্যক্তিগত জীবন পেশাগত জীবনের বাহিরে নয়। ব্যক্তিগত জীবনে করোনা আমাদেরকে বিপদগ্রস্ত করে তুলেছে। বাচ্চাদের বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ, মার্কেটে যাওয়া বন্ধ, বিনোদন কেন্দ্রে যাওয়াও বন্ধ। বিভিন্ন মানুষের সাথে মেলামেশা করাটাও এখন প্রায় বন্ধ। সব কিছু মিলেয়ে বলা চলে করোনার প্রভাব ব্যাপকভাবে পড়েছে।
দৈনিক শপথ: করোনার প্রভাব থেকে নিজের এবং পুরো ইউনিটের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কি ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছেন?
সোহেল মাহমুদ: পুলিশের কাজই হল মানুষ নিয়ে। ফলে মানুষের সাথে চলতে হয়, কথা বলতে হয়। সব জাগায় লকডাউন থাকলেও আমাদের কিন্তু পেশাগত দায়িত্ব পালনে মানুষের কাছ থেকে দূরে থাকার কোনো সুযোগ নেই। সেজন্য আমরা থানা ফাঁড়িগুলো জীবানুমুক্ত করার জন্য হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা করেছি এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যবিধি মেনে কার্যক্রম পরিচালনা করার চেষ্টা করছি।
দৈনিক শপথ: সংকটকালীন সময়ে আপনি দেশ ও জাতির সেবায় নিজেকে কতটুকু উজাড় করে দিয়েছেন?
সোহেল মাহমুদ: আমি বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর সদস্য হিসেবে সবসময় চেষ্টা করছি মানুষের পাশে দাঁড়ানোর। যখন করোনার প্রকোপ শুরু হয় আমি তখন র্যাব-৭ চট্টগ্রামে কর্মরত ছিলাম। তখন মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি মাস্ক বিতরণ, লিফলেট বিতরণ ও দরিদ্র অসহায় মানুষকে খাবার বিতরণ এবং মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করাসহ ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনা করেছি। আমি চাঁদপুরে যোগদানের পরেও এসব কার্যক্র অব্যাহত রেখেছি। এই সংকটকালীন সময়ে মানুষ যখন ঘরবন্দী ছিলো তখন তাদের নিরাপত্তা দেয়া, মার্কেটগুলোর নিরাপত্তা জোরদার করার চেষ্টা করেছি। বাংলাদেশ পুলিশের একজন সদস্য হিসেবে মানুষের জন্য কাজ করতে পেরে আমি গর্বিত।
দৈনিক শপথ:সম্প্রতি আপনি চাঁদপুর জেলায় যোগদান করেছেন। চাঁদপুরের মাটি ও মানুষ সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?
সোহেল মাহমুদ: চাঁদপুর মানেই হল চাঁদের হাট। বাংলাদেশের অনেক জ্ঞানী গুণী, কবি-সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, সমাজিক, প্রশাসনিক দেশের বিশিষ্টজনের জন্ম এ চাঁদপুরে। আমি এখানে যোগদানের পরে দেখেছি এখানের মানুষ অনেক আন্তরিক। এখানকার মানুষ অনেক অতিথিপরায়ন। আমরা যেখানে গিয়েছি মানুষ আমাদেরকে সাদরে গ্রহণ করে। অনেক সাহায্য করে। চাঁদপুরের মানুষ যথেষ্ট শান্তি প্রিয়। অন্যান্য জেলার তুলনায় বড় কোন অপরাধ এখানে নেই বললেই চলে।
দৈনিক শপথ: অতীতের এএসপির তুলনায় আমরা আপনার কাছ থেকে ব্যতিক্রম কি দেখবো?
সোহেল মাহমুদ: আসলে করোনার কারণে আমি এবং আমরা আমাদের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড করতে পারছি না। তারপরেও এখানে যোগদানের পর থেকেই চেষ্টা করছি মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর। আমি এখানে আসার পরে কয়েকটা ব্যতিক্রমি কাজ করেছি। তারমধ্যে গত ঈদুল ফিতরে আমার দায়িত্বপূর্ণ দুই থানার সকল গ্রাম পুলিশকে ঈদের জন্য নতুন পোশাক এবং কিছু খাবারে ব্যবস্থা করেছি। এছাড়াও সাম্প্রতিক এখানে একটি গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। যে খবরটি আমরা একজন সিএনজি চালাকের কাছ থেকে পাই। তারপর সেই চালককে উপহার হিসেবে কিছু নগদ অর্থ পুরষ্কার দেই। এরমধ্যে আমরা এই বার্তা দিতে চাই পুলিশকে সহযোগিতা করলে পুলিশ আপনার পাশে থাকবে।
দৈনিক শপথ: আপনি কাজ করার ক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলোকে বেশি প্রধান্য দিবেন?
সোহেল মাহমুদ: আমি এখানে যোগদানের পর দেখেছি এখানে প্রবাসীর সংখ্যা বেশি। দেখা গেছে এই লোকগুলো বিদেশে অনেক কষ্ট করে কিছু টাকা রোজগার করে। অল্প সময়ের জন্য দেশে আসে। জমির কাগজপত্র না দেখেই সেই টাকা দিয়ে জমি ক্রয় করে। দিনশেষে দেখা যায় সেই জমি নিয়ে অনেক ঝামেলার সৃষ্টি হয়। এখানে মূলত জমিজমা নিয়েই ঝামেলা বেশি। আমি চাই এসব মানুষগুলোকে সচেতন করতে। যাতে কোন অর্থনৈতিক লেনদেন করার আগে বিষয়গুলো যাচাই-বাছাই করে। এসমস্যাটা যেহেতু এখনে বেশি তাই এটিকেই আমি প্রাধান্য দিবো। পাশাপাশি মাদক, ইভটিজিং, কিশোর গ্যাংয়ের বিষয়েও আমি কাজ করবো।
দৈনিক শপথ: আপনি যোগদানের পর এখানকার কি ধরনের সমস্যা আপনার চোখে পড়েছে?
সোহেল মাহমুদ: আসলে এখানে বেশি দেখা যায় সম্পত্তি নিয়ে বাবা-ছেলের, ভাই-বোনের, চাচা-ভাতিজার মধ্যে ঝামেলা। এখানে জমি নিয়ে অনেক রকমের ঝামেলা হয়। এখানে যে মারামারি ঘটে অধিকাংশগুলোইহয় মূলত জমি-জমাকে কেন্দ্র করে।এখানে আরেকটি বিষয় হল প্রবাসী বেশি হওয়ায় তাদের স্ত্রী কিংবা ছেলে মেয়েরা প্রেমে জড়িয়ে পড়ে। আবার অনেকে প্রেমের সম্পর্ক করে ঘর ছেড়ে চলে যায়। এখানে মূলত এই ধরণের সমস্যাগুলোই অনেক বেশি দেখছি।
দৈনিক শপথ: আপনার নেতৃত্বধীন এলাকাকে কিভাবে গঠে তুলতে চান?
সোহেল মাহমুদ: আমাদের পুলিশ সুপার মিলন মাহমুদ স্যার এখানে যোগদান করেই আমাদের ডেকে বলেছেন তিনি অচিরেই এই জেলাকে মাদকমুক্ত দেখতে চান। আমরা সেই লক্ষ্যে কাজ করছি। মাদকমুক্ত এলাকায় হিসেবে গড়ে তোলাই আমার প্রধান লক্ষ্য।
দৈনিক শপথ: এর আগে আপনি কোথায় কোথায় দায়িত্ব পালন করেছেন?
সোহেল মাহমুদ: আমি ২০১২ সালে ২৩জুন ৩০তম বিসিএসের মাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশে যোগাদান করি। তারপর বাংলাদেশ পুলিশের এক বছরের মৌলিক প্রশিক্ষণ শেষ করি। তারপর বাস্তব প্রশিক্ষণের জন্য ফরিদপুর জেলায় যোগদান করি। সেখানে ৬ মাস ছিলাম। তারপর আমার প্রথম পদায়ন হয় র্যাব-১১ নারায়ণগঞ্জে। সেখানে চারমাস কর্মরত ছিলাম। তারপর সেখান থেকে র্যাব-৭ এ বদলি করা হয়। সেখানে সাড়ে তিন বছর কর্মরত ছিলাম। তারপর সেখানে থেকে বদলি হয়ে আসি চাঁদপুরে এএসপি সদর হিসেবে এক বছর কর্মরত ছিলাম। তারপর ২০১৮ সালে ১৮ জানুয়ারি আমার পদন্নোতি হয় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদে। আমি পদন্নোতি সূত্র আবার র্যাবে তিন বছর চাকরি করার পর ২০২১ সালের ২৮ জানুয়ারি হাজীগঞ্জ সার্কেলে যোগদান করেছি।
দৈনিক শপথ: আপনার কর্মময় জীবনে কর্মস্থলে স্মরণীয় ঘটনা বলুন। যেটা আপনাকে আনন্দ দেয় কিংবা দুঃখ দেয়?
সোহেল মাহমুদ: আমার ছোট চাকরির জীবনে একটি স্মরণীয় ঘটনা হলো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে বিপিএম সাহসিকতার পদক গ্রহণ। এটার পেছনে গল্প যদি বলি। আমি যখন র্যাব-৭ চট্টগ্রামে কর্মরত ছিলাম। সেখানে সন্দীপ নামে একটা উপজেলা আছে। যেখানে সড়কপথে যাতায়াতের কোন ব্যবস্থা নেই। সাগরবেষ্টিত এলাকা হওয়ার ফলে সেখানে জলদস্যু ডাকাত এবং সন্ত্রাসীদের অভয়শ্রমে পরিণত হয়েছে। তৎকালীন সময়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত একজন জলদস্যু ছিলো নাম মোশারফ। তার নামে প্রায় ৩০ টির অধিক মামলা ছিলো। তার কাছে সব সময় দুইটা পিস্তল থাকতো। তাকে পুলিশ ধরতে গেলে পুলিশকে পায়ে ধরে গুলি করেছে এমন মামলাও আছে। এই রকম একটা ভয়ংকর জলদস্যু বিরুদ্ধে আমরা ছদ্মবেশ গিয়ে অভিযান পরিচালনা করেছি। একটা কথা জানিয়ে রাখি ওখানে যেহেতু নদী পথে যেতে হয় আপনি যদি ছদ্মবেশও যান আপনাকে ওরা চিনে ফেলবে। তাদের লোক ঘাটে ঘাটে থাকে। তো আমরা সেখানে কৌশল অবলম্বন করেছি। আমরা শিল্পীর বেশ ধরে সন্দীপে প্রবেশ করি। সেখানে আমাদের কর্নসাট আছে। এমন একটা অভিনয় করেছি। আর গিটারে বাক্সে করে অস্ত্র নিয়েছি। সেখানে আমাদের সাথে একেবারে দিনদুপুরে বন্দুকযুদ্ধ হয় তাদের। সেই যুদ্ধে সে নিহত হয়। আমরা তার নিকট হতে সম্ভবত ২৫ টা অস্ত্র উদ্ধার করি। এই অভিযানটা আমার নেতৃত্ব হয়েছে। আমি সরাসরি অংশগ্রহণ করেছি।
দৈনিক শপথ: আপনার পেশাগত জীবনে দায়িত্ব পালনের জন্য কি কি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন?
সোহেল মাহমুদ: আমি র্যাব সাহসিকতার পদক ২০১৫ সালে, ২০১৬ সালে পিপিএম ও ২০১৯ সালে আইজিপি ব্যাচ পেয়েছি। আর পেয়েছি অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা।
দৈনিক শপথ আপনার সফলতা কামনা করে। দৈনিক শপথকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
সোহেল মাহমুদ: দৈনিক শপথকে অনেক ধন্যবাদ।