এইচএম জাকির:
ঈদ আরবি শব্দ। যার অর্থ- আনন্দ, খুশি, উৎসব। মুসলমানদের জন্য বছরে দুটি ঈদ। এর একটি হলো ঈদুল ফিতর, অপরটি ঈদুল আযহা। দুটি ঈদই প্রতি বছর বারবার ফিরে আসে। উভয় ঈদেরই রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন তাৎপর্য বা গুরুত্ব। প্রত্যেক ঈদেই আমরা গুরুত্ব অনুযায়ী নানান কাজ সম্পাদন করে থাকি। যেহেতু সামনে কোরবানীর ঈদ বা ঈদুল আযহা, তাই ঈদুল আযহায় করণীয় বিষয়গুলোকেই গুরুত দিবো। তবে বর্তমান করোনাকালে এই গুরুত্বে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে।
বিশ্ব মহামারি করোনা ভাইরাস সম্পর্কে আমরা ইতোমধ্যে কমবেশি অবগত। এটি এখন মানবজীবনে এক আতঙ্কের নাম। যদিও আতঙ্ক নয়, সচেতনতাই পারে করোনাকে রুখতে। করোনাকালের ঈদ পৃথিবীর ইতিহাসে ভিন্নতা বহন করে। বিশ্ব মুসলিম জাতি করোনাকালীন এমন ঈদ ২০২০ সালের আগ পর্যন্ত আর কখনো দেখেনি। যুগে যুগে মানুষের বিবর্তণ ঘটেছে। বংশধরের পর বংশধর এসেছে। বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কারের ফলে মানুষের মন-মানসিকতায় আধুনিকতা এসেছে, মানুষ বিনোদনের মাত্রায় বাড়তি আকর্ষণ যুক্ত করে চলছিলো। কখনোই বিনোদনে ঘাটতি ঘটে নি। কিন্তু ইতিহাসে এই প্রথম প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাসের কারনে বিনোদনে নামলো ধ্বস। বিশ্বের সমগ্র মুসলিম জাতি ২০২০ সালের দুটো ঈদ ও ২০২১ সালের ঈদুল ফিতরকে ঘরে বসে পালন করলো। মুসলিম জাতি মেনে নিলো ঈদের বিনোদনের চেয়ে করোনার থাবা থেকে মুক্ত থাকাই শ্রেয়। করোনায় মৃত্যুপুরী ও কোভিড-১৯ রোগের চলন্ত চাকা বিশ্ব জুড়ে দিন দিন বেড়েই চলছে। এমন দূর্দশায় সামনে পবিত্র ঈদুল আযহা। করোনা থেকে বাঁচতে আমাদেরকে এই ঈদেও নানা নিয়ম-কানুন মেনে ঈদ উদযাপন করতে হবে। সেজন্যে কিছু করণীয় বিষয়ে আমাদেরকে নজর রাখতে হবে। যেমন- ঈদে বাড়ি/কর্মস্থলে ফেরায় : কর্মজীবী মানুষ নাড়ীর টানে এবং পরিবার ও পরিজন নিয়ে ঈদ আনন্দকে ভাগাভাগি করতে শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে আসে, আবার গ্রাম ছেড়ে কর্মস্থলে ফিরে। এক্ষেত্রে রাস্তাঘাট ও যানবাহনে করোনার ভয় চরম আতঙ্কের জন্ম দেয়। করোনা থেকে বাঁচতে প্রয়োজন সুরক্ষা। শতভাগ সুরক্ষা সামগ্রী ব্যবহার করে শহর ছাড়া হবে উত্তম সিদ্ধান্ত। ঈদে যানবাহনে ঘরমুখো মানুষের ভীড় থাকলেও যতটা নিরাপদ নিজেকে রাখা যায়, সে চেষ্টাই করতে হবে। অবশ্য ঈদ পরবর্তী কর্মস্থলে ফেরায়ও একই নিয়ম অবলম্বন করলে ঈদের আনন্দটা বিষাদে পরিনত হবে না।
উপহার হিসেবে সুরক্ষা সামগ্রী প্রদান : ঈদে ছোট-বড় সবারই উপহারের প্রতি একটা আকর্ষণ থাকে। তবে সেটা ঈদুল আযহায় কোরবানির কারণে কিছুটা কম থাকলেও করোনাকলীন এই ঈদে ছোট-বড় সবাইকে করোনা ভাইরাস থেকে মুক্ত রাখতে বিভিন্ন ব্যবহার্য সুরক্ষা সামগ্রী উপহার হিসেবে প্রদান করা যেতে পারে। যেমন : মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাবস, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, সার্জিক্যাল ক্যাপ ইত্যাদি। এতে ঈদের খুশি যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি করোনা থেকে সুরক্ষা পাবে।
কোরবানির পশু কেনায় : ঈদুল আযহা মানেই পশু কোরবানি দেওয়া। বাজার গিয়ে আমাদেরকে এই পশু ক্রয় করে আনতে হয়। এক্ষেত্রে কিছু সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে আমারদেরকে। বাজারে যত কম মানুষ যাওয়া যায় ততই ভালো। অংশীদারিত্ব কোরবানিতে প্রয়োজনে একজন বাজারে গিয়ে অন্য ভাগিদারকে মোবাইল ভিডিও কলের মাধ্যমে পশু দেখিয়ে ও পশুর দাম নিশ্চিত করে পশু কেনা যেতে পারে। তবে যিনি বাজারে যাবেন তিনি অবশ্যই মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাবস, সার্জিক্যাল ক্যাপ পরিধান করে যাবেন এবং কিছুক্ষণ পরপর হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করবেন। বেশি সময় বাজারে থাকা যাবে না এবং অবশ্যই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। তবে পশু কেনার ক্ষেত্রে অনলাইন মাধ্যমে কেনা উত্তম সিদ্ধান্ত বলে আমি মনে করি।
নিরাপদে চাঁদ দেখা : ঈদের বিশেষ আকর্ষণ হলো চাঁদ দেখা। বিশেষ করে ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখার চেয়ে ঈদুল আযহার চাঁদ দেখায় একটু বেশিই আনন্দ লাগে। কারণ ৩০ রোজা শেষ মানে অটো ঈদ উদযাপন হয়। তখন চাঁদ দেখার প্রতি তেমন আকর্ষণ কাজ করে না। তাই চাঁদ দেখার আকর্ষণটা ঈদুল আযহাতেই একটু বেশি আনন্দের হয়। সেজন্যে চাঁদ দেখতে আমরা অনেকে একত্রিত হই এবং বিভিন্ন লোকেশনে ছুটাছুটি করি। এক্ষেত্রে আমাদেরকে অবশ্যই করোনার কথা মনে রাখতে হবে এবং মাস্কের ব্যবহার নিশ্চিত করে নিরাপদে চাঁদ দেখতে হবে।
ঈদগাহে করণীয় : ঈদুল আযহার দিন আমরা যতদ্রুত সম্ভব ঈদের নামাজ আদায় করি। এক্ষেত্রে আমরা সকাল সকাল গোসল করে নতুন জামা পরিধান করি। তারপর ঈদগাহে রওয়ানা দিই। যাওয়ার সময় অবশ্যই সুরক্ষা সামগ্রী পরিধান করবো এবং নিরাপদ দূরত্ব নিয়ে যাবো। নিরাপদ দূরত্বে বসবো। নামাজ আদায় করবো। ঈদের নামাজের পর আমরা একে অপরের সাথে আলিঙ্গনে সিক্ত হবো। করোনাকালীন সময়ে আমরা আলিঙ্গন করবো না। ভালোবাসায় বুকে বুক মিলাবো না। পূর্ববর্তী সমস্ত হিংসা, বিদ্বেষ দাফন করে সম্প্রীতি আর সৌহার্দ্যের বন্ধনে আবদ্ধ হলেও এ সময়ে আমরা দূরত্ব বজায় রেখে তা করবো। নিরাপদ দূরত্বে বাসায় ফিরবো।
কোরবানি ও পশু বানানোয় : ঈদুল আযহার মূল আকর্ষণ পশু কোরবানি। পশু কোরবানি দিতে পশুকে জবাইকালে অবশ্যই নিরাপত্তা ও নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। পশু সম্পূর্ণ মৃত নিশ্চিত হওয়ার পর পশু বানাতে হবে। এক্ষেত্রে জীবানুনাশক ছিটিয়ে পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন যায়গা ও বিছানায় কাজ করতে হবে। পশু বানানোর কাজে ব্যবহৃত সকল সরঞ্জাম অবশ্যই জীবানুমুক্ত করে নিতে হবে এবং নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে কাজ করতে হবে।
আবর্জনা অপসারণ ও স্থান জীবানুমুক্ত করা : পশু জবাইয়ের স্থান এবং পশুর আবর্জনা এবং পশু বানানোর স্থানে দ্রুত জীবানুনাশক ছিটিয়ে সেই স্থানগুলো পরিস্কার ও পরিচ্ছন্ন করে নিতে হবে। এছাড়া এ কাজে ব্যবহৃত সকল সরঞ্জাম জীবানুমুক্ত করে নিতে হবে।
সালামি আদান-প্রদান : বড়দের সালাম করা এবং তাদের থেকে সালামি নেওয়া ছোটদের একটি রেওয়াজ। বড়রাও আনন্দের সাথে সালামি দিয়ে থাকে। ছোটদের স্নেহময় ভালোবাসা দিয়ে কাছে টেনে নেওয়া ও সালামি দেওয়াতেও আমাদেরকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।
জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা : গ্রামে জনসচেতনতা শহরের তুলনায় কিছুটা কম। আবার গ্রামের শিক্ষিত জনগোষ্ঠী কর্মের তাগিদে শহরে চলে যায়। ঈদে সকলের বাড়ি বা গ্রামে ফেরা হয়। সে জন্যে শিক্ষিত ও সচেতনজনেরা গ্রামের বা বাড়ির মানুষদেরকে আরো বেশি সচেতন করনে সচেতনতামূলক বিভিন্ন পরামর্শ প্রদান করতে পারে। এতে প্রিয়জনের পরামর্শগুলো বাড়ির বা গ্রামের লোকজন সানন্দে গ্রহণ করবে এবং মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ হবে।
নিরাপদে থাকুক কোভিড-১৯ রোগী : করোনা ভাইরাসের আক্রমণে দিন দিন কোভিড-১৯ রোগী বৃদ্ধি পাচ্ছে। শহর-গ্রাম সবখানেই এখন এই রোগী রয়েছে। ঈদে স্বজনরা ঘরমুখো হয়। স্বজনের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে কর্মস্থলে করোনায় আক্রান্ত রোগীকে ঈদে গ্রামে না যাওয়ার পরামর্শ থাকলো। আর গ্রামে আক্রান্ত কোভিড-১৯ রোগীকে অবশ্যই পরিজন থেকে আলাদা থাকতে হবে। কোন পরিবারেই যেন বিষাদের ঈদ না হয়।
সবমিলিয়ে আমাদেরকে করোনাকালীন এই সময়ে সুরক্ষা সামগ্রীর ব্যবহার নিশ্চিত করে ঈদ উদযাপন করতে হবে। ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে গিয়ে কোন কারনেই যেন করোনার ট্রান্সমিশন না ঘটে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ‘ঈদের খুশি ঘরে ঘরে, সচেতনতা ও স্বাস্থবিধি মেনে’-এই চিন্তাধারা মাথায় রেখে ঈদ আনন্দ হোক ভাগ। স্বজন ও প্রতিবেশী সকলের ভালোবাসায় একে অপরের সাথে ঈদ কাটুক আনন্দে। সবাই নিরাপদ ও সুস্থ থাকুক- এই প্রত্যাশায় ঈদ মোবারক।