বিশেষ প্রতিনিধি:
মহামারি করোনায় দৃষ্টিসীমানার বাইরে যেন হাজার হাজার পল্লী চিকিৎস
ক। অথচ তারাই নিয়মিত সাধারণ মানুষকে প্রাথমিক চিকৎসা দিয়ে থাকেন। করোনার যে উপসর্গ বাংলাদেশে তা নিয়মিত অসুখ হিসেবে পল্লী চিকিৎসকদের মাধ্যমেই প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে থাকে সাধারণ মানুষ। মহামারি করোনায় এ সম্মুখযোদ্ধারাই যেন অপাংতেয়। অথচ তাদের ভূমিকা কোনোভাবেই অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
চাঁদপুর সদর উপজেলার কামরাঙ্গা গ্রামের পল্লী চিকিৎসক (আরএমপি) আ
বদুর রব। প্রত্যন্ত গ্রামের জনসাধারণকে দীর্ঘ প্রায় ১৫বছর চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন। এর আগে তার বাবা আলী আহমেদ মিজি সাধারণ মানুষকে চিকিৎসা দিয়েছেন। তিনি পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের অধীনে ফিল্ড সুপারভাইজার ছিলেন। চাঁদপুর সদর উপজেলার উত্তর কামরাঙ্গা গ্রামে তার একটি ছোট্ট ফার্মেসী। পৈত্রিকসূত্রে পাওয়া সেই ফামের্সীতেই বিগত ১৫বছর রোজ সকাল বিকেলে বসেন আবদুর
রব। এলাকায় কেউ অসুস্থ হলেই খবর পেয়ে ছুটে যান বাড়িতে। দেন প্রাথমিক চিকিৎসা। ব্লাড প্রেসার ঠিক আছে কিনা দেখে নেন। সাধারণ জ্বর কাশ সর্দি হলে দেন পরামর্শ পাশাপাশি প্রাথমিক চিকিৎসা। বিনিময়ে নেন না কোনো ভিজিট। নেই সরকারি কোনো বেতন। শুধুমাত্র ওষুধ বিক্রি করে যা লাভ হয় তা দিয়েই চলে তাদের জীবিকা। ধারণা করা হয় চাঁদপুরের প্রায় পাঁচ হাজার পল্লী চিকিৎসক রয়েছে। তবে পল্লী চিকিৎসকদের হিসেব মেলানো সম্ভভ হয়ে উঠছিলো না। কারণ আরএমপি, এলএমএএফসহ পল্লী বিকিৎসার জন্যে রয়েছে বিভিন্ন কোর্স। এছাড়া কেউ কেউ ফার্মাসিস্ট কোর্স কমপ্লিট করেই দিয়ে বসেছেন র্ফামেসী। দিচ্ছেন প্রাথমিক চিকিৎসা বা পরামর্শ। এছাড়া কেউ কেউ কোনো চিকিৎসকের সহকারী ছিলেন কয়েক বছর। তারপর নিজে থেকে এসে দিয়েছেন গ্রামে ফার্মেসী। হয়ে গেছেন পল্লী চিকিৎসক। যে কারণে এর সঠিক হিসেবে করা মুশকিল।চাঁদপুর পল্লী চিকিৎসক এশোসিয়েসন নামে একটি সংগঠন রয়েছে জানা
গেছে। কিন্তু আদতে এর অস্তিত্ব আছে কিনা সন্দেহ। অনেক পল্লী চিকিৎসক বললেন, যেহেতু এমন সংগঠনের কোনো কার্যক্রম নেই সেহেতু কেউ নাম মাত্র সংগঠনের নাম ব্যবহার করলে সে দায়ভার তাদের।
পল্লী চিকিৎসকরা শহরতলী বা গ্রামের মানুষের প্রাথমিক চিকিৎসার জন্যে আশ্রয়স্থল হিসেবে পাশে থাকেন বলা চলে এটা ঐতিহ্যগত চিত্র। চলমান মহামারি করোনায় থেমে নেই তাদের বিনিময়হীন সেবা। সেবা দিতে গিয়ে ঘটছে বিপত্তি। তবু যেন তারা অকুতভয় নাবিক। চাঁদপুরের প্রথম করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান কামরাঙ্গা গ্রামের জামাই ফয়সাল। তিনি নারানগঞ্জে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। অসুস্থ হয়ে চলে আসেন চাঁদপুর সদর উপজেলার উত্তর কামরাঙ্গা গ্রামের শশুর বাড়ি। এখানে তিনি গত ১১এপ্রিল বিকেলে অসুস্থ হলে খবর দেয়া হয় রব ডাক্তারকে। তিনি দ্রুত ছুটে যান। গিয়ে প্রেসার ঠিক আছে দেখতে পান। তারপর উন্নত চিকিৎসার পরামর্শ দিয়ে তিনি ফিরে
আসেন। সন্ধ্যায় জানতে পারেন ফয়সাল মারা গেছেন। পরে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে তার নমুনা পরিক্ষা করা হলে করোনা পজেটিভ আসে। তারপর ফয়সালের শালিকা ও শশুরও করোনা আক্রান্ত হন। করোনা মুক্ত হয়ে সপ্তাহখানেকের মাথায় মারা যান তার শশুরও। ওদিকে ১৪দিনের জন্যে হোম কোয়ারেন্টাইনে চলে যেতে হয় পল্লী চিকিৎসক আবদুর রবকে। এমনই প্রশিক্ষণ নেয়া (আরএমপি) পল্লী চিকিৎসক অ
মল ধর। হাজীগঞ্জ উপজেলার বাকিলা বাজারে তিনি নিয়মিত রোগী দেখেন। অসুস্থদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। কখনোই বুঝতে পারেন না কে করোনাযুক্ত আর কে করোনামুক্ত। এমনই অপর এক পল্লী চিকিৎসক (এলএমএএফ) প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আবু ইউসুফ। চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার বাসাবাড়িয়া গ্রামের তিনি সাধারণ মানুষকে দেন প্রাথমিক চিকিৎসা। মানুষ জ্বর কাশ সর্দি নিয়ে এলে পরামর্শ ও প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। কখনো ভাবেন না তিনি করোনা আক্রান্ত হতে পারেন। এভাবেই নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছে চাঁদপুরের হাজার হাজার পল্লী চিকিৎসক। অথচ সাধারণ মানুষকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া এ পল্লী চিকিৎসকরা করো ধন্যবাদটুকুও পান না। অথচ জেলা শহর বা উপজেলা শহরের ডিগ্রিধারী চিকিৎসকরা যখন এমন জ্বর কাশ, সর্দি, গলা ব্যাথা নিয়ে রোগীরা ছুটে যান যান তখন সর্বোচ্চ সর্তকর্তা অবলম্বন করেন চিকিৎসকরা। অথচ ঠিক উল্টো চিত্র পল্লী চিকিৎসকদের বেলায়।
এ বিষয়ে একাধিক পল্লী চিকিৎসকদের সাথে আলাপকালে তারা জানায়, আমাদের দেশে ১২মাসই কেউ না কেউ জ্বর কাশ, সর্দি, গলা ব্যাথা নিয়ে চিকিৎসা নিতে আসেন। আমরা চিকিৎসা দিই। তখনো ভাবিনি তারা করোনা রোগী কি না। এখনো ভাবিনি। এভাবেই মানুষের জন্যে আমরা কাজ করে যাই। কিন্তু বিনিময়ে সরকারি বা বেসরকারি কোনো সহায়তা পাই না।
এমনকি একটা মাস্ক পর্যন্ত উপহার হিসেবে আমাদের ভাগ্যে জোটে না।
চাঁদপুর জেলা অফিস তত্ত্বাবধায়কের কার্যালয়ে কর্মরত উচ্চমান সহকারী মোঃ মোস্তফা জামান জানান, চাঁদপুর জেলা প্রায় ২২হাজার ফার্মেসী রয়েছে। এরমধ্যে অনেগুলোর ট্রেড লাইসেন্স আছে। আমাদের কাছে নিবন্ধন নিয়েছে কেউ কেউ। নিবন্ধনের বাইরে অনেক ফার্মেসী রয়েছে। আর মূলত এসব ফার্মেসী দিয়ে থাকে সাধারণ পল্লী চিকিৎকরা। অবশ্য অনেক ফার্মাসিস্টও দোকান দিয়ে
বসে। সর্বপরি চাঁদপুরে কি পরিমান পল্লী চিকিৎসক আছে তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) এর চাঁদপুর জেলার শাখার সভাপতি অধ্যক্ষ মোশারফ হোসেন বলেন, পল্লী চিকিৎসকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এ করোনা মৌসুমেও প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের যথাযত মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। আমরা চাই তারাও মূল্যায়িত হোক।
চাঁদপুরের সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ শাখাওয়াত উল্ল্যাহ বলেন, যে কোনো মানুষ অসুস্থ বোধ করলে প্রথমেই পল্লী চিকিৎসকের সরণাপন্ন হয়। তারা প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে থাকে। মহামারি করোনা সময়েও তাদের চিকিৎসায় অনেকেই হয়তো ভালো হয়ে যাচ্ছে। যা আমাদের জানা নেই। এ কঠিন দুর্যোগের সময়ে তাদের চিকিৎসা সেবা অব্যাহত রায় ধন্যবাদ জানাই।
করোনাভাইরাস আতঙ্কের কারণে সারা দশে হাসপাতাল, প্রাইভেট হাসপাতা
ল, ক্লিনিক যেখানে সাধারণ রোগী দেখা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। সেখানে চাঁদপুরে প্রায় পাঁচ হাজার পল্লী চিকিৎসক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিয়মিত গ্রামের সাধারণ রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তারা ব্যবহার করছেন না নূন্যতম সুরক্ষা সামগ্রী।