বিশেষ প্রতিনিধি:
কচুয়া উপজেলা সহকারি শিক্ষা কর্মকর্তা সুভাষ চন্দ্র সরকার নানা অনিয়ম আর স্বেচ্ছাচারিতার সীমা অতিক্রম করেছেন। তার কাছে অনিয়মই যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। অনিয়মের সঙ্গেই যেন তার পরম ঘর বসতি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক থাকাকালীনও সহকারীদের প্রতি করেছেন নির্দয় আচরণ। তার অনিয়মের প্রতিবাদও করতে পারে না অধীনস্থ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা। সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে, সুভাষ চন্দ্র শিক্ষকদের চিকিৎসাজনিত ছুটি ও মাতৃকালীন ছুটি সুপারিশের জন্য ভুক্তভোগী শিক্ষকদের কাছ থেকে বিভিন্নভাবে টাকা হাতিয়ে নেয়। এমনকি কোন কোন শিক্ষকের প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে টাকা উত্তোলনের জন্য আবেদনকৃত দরখাস্তে টাকার বিনিময়ে সুপারিশের স্বাক্ষর করেন। আবার কেউ টাকা না দিলে বিভিন্ন অজুহাতে গড়িমসি শুরু করেন। সম্প্রতি সুভাষ চন্দ্র সরকারের ঘুষের টাকা নেয়ার সময় করা ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ হয়। এ নিয়ে চাঁদপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের মাধ্যমে তদন্ত চলছে।
কে এই সুভাষ: সুভাষ চন্দ্র সরকার চাঁদপুর সদর উপজেলার বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের দামোদরদি গ্রামের সরকার বাড়ির শুক রঞ্জন সরকারের ছেলে। সুভাষ এডিবি প্রকল্পে ২০০৩ সালে সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। চাকুরি শুরু করেন দামোদরদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তারপর দীর্ঘ আন্দোলনের ফসল হিসেবে এ প্রকল্পের শিক্ষকরা রাজস্বখাতে স্থানান্তরিত হয়। সে সুযোগি তিনিও সরকারি চাকুরি করার সুযোগ পান। তারপর ২০০৮সালের দিকে প্রধান শিক্ষা হিসেবে লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে পদোন্নতি পান। চাকুরির দুই বছর পার না হতেই তদবির করে নিজ এলাকার রামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে চাকুরি চালিয়ে যান। এরপর থেকেই শুরু হয় তার স্বেচ্ছাচারিতা ও অনিয়ম। এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকাকালীন সময়ে দায়িত্বে অবহেলা এবং অধীনস্থ সহকারী শিক্ষকদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ এবং উৎকোচ গ্রহণের অভিযোগ উঠে। আর বিষয়টি তদন্ত করে সত্যতা পানয় তৎকালীন চাঁদপুর সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ মজুমদার। তিনি সাজা হিসেবে চাঁদপুর সদরের দুর্গম চরে প্রশাসনিক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে বদলি করেন। সেখানে চলতে থাকে চাকুরি। কিন্তু চতুর এই সুভাষ ঝোক বুঝে কোপ মারতে পারদর্শী। জানা যায় উপজেলা সহকারি শিক্ষা কর্মকর্তার পদ লুফে নিয়েছেন বড় অংকের টাকার বিনিময়ে। প্রথমে তিনি উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে কুমিল্লা জেলার হোমনা উপজেলায় যোগ দেন।সেখান থেকে তিনি নানান অনিয়মের অভিযোগে চৌদ্দগ্রাম উপজেলায় বদলি হন। কিন্তু চৌদ্দগ্রাম উপজেলায়ও তাকে যোগদান করতে দেওয়া হয়নি। পরে তিনি অধিদপ্তরে তদবির করে বদলি হয়ে নিজ জেলার কচুয়া উপজেলায় এসে দায়িত্ব নেন। তারপর নতুন রূপে শুরু হয় পুরানো কৌশল।
যত অভিযোগ: সুভাষ চন্দ্র সরকার গত ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে কচুয়া উপজেলায় সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি সাচার, সদর ও মনোহরপুরের ক্লাস্টারের দায়িত্বে আছেন। তিনি উপজেলায় যোগদানের পর থেকে তার ক্লাস্টারের বিভিন্ন স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের সাথে শিষ্টাচার বহির্ভূত আচরণ শুরু করেন এবং বিভিন্নভাবে হয়রানি করেন।
অভিযোগ সুত্রে আরো জানা যায়, সুভাষ চন্দ্র শিক্ষকদের চিকিৎসাজনিত ছুটি ও মাতৃকালীন ছুটি সুপারিশের জন্য ভুক্তভোগী শিক্ষকদের কাছ থেকে বিভিন্নভাবে টাকা হাতিয়ে নেয়। এমনকি কোন কোন শিক্ষকের প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে টাকা উত্তোলনের জন্য আবেদনকৃত দরখাস্তে টাকার বিনিময়ে সুপারিশের স্বাক্ষর করেন। আবার কেহ টাকা না দিলে বিভিন্ন অজুহাতে গড়িমসি শুরু করেন।
সুত্র মতে, উপজেলার ২৪নং আইনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন সহকারী শিক্ষকের কাছ থেকে চিকিৎসাজনিত ছুটির মোট ৩হাজার ৫শ টাকা নিয়েছেন। ৮নং ভাটিছিনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একন শিক্ষকের প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে টাকা উত্তোলনের জন্য দরখাস্তে সুপারিশ করেন ৫শ টাকার বিনিময়ে।
এছাড়া বিভিন্ন বিদ্যালয়ে পরিদর্শনে গিয়ে পরিদর্শন রেজিস্ট্রারে বিভিন্ন ধরণের ভয়ভীতিমূলক কথা লেখে শিক্ষকদের শোকজ করে জিম্মি করেন বলে অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সম্প্রতি উপজেলার ৩ নং বজরীখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একজন শিক্ষককে শোকজ করে ২হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়ার পাশাপাশি অশোভন আচরণের অভিযোগ রয়েছে।
শুধু তাই নয়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কচুয়া উপজেলার ৩৯ টি বিদ্যালয়ের ক্ষুদ্র মেরামতের জন্য নগদ ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং ২ লাখ টাকার কাজ আসে। এবং রুটিন মেনটেনেন্স বাবদ কোন কোন বিদ্যালয়ে ৪০ হাজার টাকা, ওয়াস ব্লক বাবদ ২০ হাজার টাকা করে আসে। এছাড়াও ১৭১ টি বিদ্যালয়ে স্লিপ এবং প্রাক-প্রাথমিকের জন্য ৭০ হাজার টাকা, ৫০ হাজার টাকা এবং ১০ হাজার করে টাকা আসে। ওই সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার তার অধীনের ক্লাস্টার সমূহে গিয়ে বিভিন্ন কাজের অনিয়মের অজুহাত বের করে টাকার বিনিময়ে তা প্রত্যাহার করেন। এমনকি টাকা না দিলে মেরামত ও সংস্কারের প্রত্যায়নও দেন না বলে জানা গেছে।
সূত্রে আরো জানা গেছে, উপজেলার ২৮নং ভূঁইয়ারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ৫ হাজার টাকা, ২৭নং আশারকোটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ৫হাজার ১শ টাকা, ৩২নং বকসগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রত্যায়ন বাবদ ৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন। আর এভাবে প্রায় তার অধীনস্থ প্রতিটি বিদ্যালয় থেকে তিনি বিভিন্ন অংকের টাকা হাতিয়ে নেন বলে সুত্র জানায়।
এমনকি ২০২০ সালের কর্মসম্পাদন চুক্তি তার নির্ধারিত লোকের কাছ থেকে স্পাইরাল বাইন্ডিং বাবদ প্রতি বিদ্যালয় থেকে ৪শ থেকে ৫শ টাকা হারে নিয়েছেন বলে জানা গেছে। শুধু তা-ই নয়, তিনি মোটর সাইকেল ব্যবহারকারী শিক্ষকদের নিয়ে বিভিন্ন স্কুল পরিদর্শনে যান। এতে ওই শিক্ষকের বিদ্যালয়ের পাঠদান ব্যাহত হয়। অথচ ওইসব্ শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের কথা ভেবে না যেতে চাইলে তিনি ওই শিক্ষকের সাথে অসদাচরণের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের ভয়ভীতি দেখান বলে একাধিক শিক্ষক জানিয়েছে। কিন্তু ভয়ে কেহই মুখ খুলছে না বলে জানায়।
এই বিষয়ে সহকারী শিক্ষা অফিসার সুভাষ চন্দ্র সরকারের মুঠোফোনে কল করে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তিনি কলা রিসিভ করেননি।
এ বিষয়ে চাঁদপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ সাহাব উদ্দীন জানান, আমরা কিছু অভিযোগ পেয়েছি। ওসব অভিযোগ তদন্ত করা হচ্ছে। ঠিক এই মুর্হূতে আর বেশি কিছু বলতে পারছি না।